ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

দুর্যোগে কতটা প্রস্তুত উপকূল?

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩৫, ১৩ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুর্যোগে কতটা প্রস্তুত উপকূল?

রফিকুল ইসলাম মন্টু: সমুদ্র নিকটবর্তী দ্বীপের ছোট্ট বাজারে তিনটি পতাকা উড়িয়েছেন রেডক্রিসেন্ট কর্মী। পাশে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে। তাদের কাছে জানতে চাইলাম, এই তিনটি পতাকার অর্থ কী? এখন আপনার করণীয়ই বা কী? মধ্য বয়সী ১৯জনের মধ্যে মাত্র একজন ব্যাখ্যা করতে পারলেন। বাকিরা এসব বিষয়ে কিছুই জানেন না। এই একটি বা দুইটি প্রশ্ন দিয়েই ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ বিষয়ে সচেতনতার মাত্রা বোঝা যায়। এই চিত্র উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোন্তাজের।

শুধু চরমোন্তাজ নয়, এমন চিত্র উপকূলের অধিকাংশ স্থানে। তবে বিপরীত চিত্রও আছে। ২০০৭ সালে যে এলাকায় সিডর আঘাত করেছিল, সেই শরণখোলার সাউথখালীর মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ বার্তা ঘরের নারীরাও মুখস্থ বলে দিতে পারেন। কখন তৈরি হতে হবে, কখন ঘর থেকে বের হতে হবে, কখন আশ্রয়কেন্দ্রের দিকে ছুটতে হবে- সবই জানেন তারা। কিন্তু সেখানকার সমস্যা ভিন্ন। অনেকের বাড়ি থেকে আশ্রয়কেন্দ্রের দূরত্ব অনেক বেশি। আবার যাদের বাড়ির কাছে আশ্রয়কেন্দ্র আছে, তাদের সেখানে যাওয়ার রাস্তাঘাট ভালো নেই। ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ বার্তা এবং আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার ক্ষেত্রে এইসব সমস্যার মাঝে এই প্রশ্নটা আসা স্বাভাবিক- দুর্যোগে কতটা প্রস্তুত উপকূল?

দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সাফল্যের প্রশংসা করেই বলি, এখনও মাঠে অনেক স্থানে অন্ধকার রয়েই গেছে। প্রতিটি ঘূর্ণিঝড় দুর্যোগ মোকাবেলার অব্যবস্থাপনার সেই পুরনো চেহারা মনে করিয়ে দেয়। যথাসময়ে সতর্কীকরণ সংকেত না পাওয়া কিংবা শেষ মুহূর্তে উপদ্রুত এলাকার লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়ার উদ্যোগ বহু আগে থেকেই অব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবেই চিহ্নিত। মাঠ পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির নিস্ক্রিয়তা অব্যবস্থাপনার আরেকটি দিক। সমন্বয়হীনতা তো আছেই। ঢাকায় বড় আওয়াজ, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে দুর্যোগ মোকাবেলার ব্যাপক প্রস্তুতির ডামাডোল। কিন্তু মাঠের অবস্থা কী?

উপকূলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ কিংবা ‘রোয়ানু’ মোকাবেলার ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার চিত্র ভেসে ওঠে। উপকূলীয় জেলাগুলোর মধ্যে সবখানেই রোয়ানু চিহ্ন রেখে যায়। বেশি ক্ষতি হয়েছিল ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে। মাঝারি আকারের এই ঘূর্ণিঝড় ততটা বড় আকারের ধাক্কা না দিলেও বহু মানুষকে পথে বসিয়ে দিয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড়ের পরের দিন থেকে আসছে নতুন নতুন খবর। কোথাও মাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, কোথাও লবণ চাষের ক্ষতি হয়েছে। বহু মানুষের বাড়িঘর মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। বহু মানুষের ঘরে খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকটের খবর পাওয়া গেছে। অনেকের কাজ করে স্বাভাবিকভাবে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ নেই। তবে কোথাও পর্যাপ্ত সহায়তা পৌঁছেছে এমন খবর মিলেনি। ফলে এই ধাক্কা সামলাতে আরও বহুদিন লাগবে। ধারদেনা করে চলতে হবে। সাহায্যের জন্য হাত বাড়াতে হবে। ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ আঘাত করেছিল কক্সবাজার-মহেশখালী এলাকায়। ব্যাপক ক্ষতি হয় শাহপরী দ্বীপ, সেন্টমার্টিন এলাকায়।

সমুদ্র তীরবর্তী দুর্যোগপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত উপকূলে সব দুর্যোগের পরই যে চিত্রটি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে সেটা হলো, মানুষের দুর্ভোগ-দুর্গতি। দুর্যোগের পর বেশি ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের খোলা আকাশের নিচে বসবাস করতে হয়। ঘূর্ণিঝড়গুলো ছোট হোক আর বড় হোক, বহু মানুষকে খোলা আকাশের নিচে বসবাসে বাধ্য করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের হাত নেই, এটা যেমন একেবারেই সত্য, তেমনি যথাযথ প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারলে ক্ষয়ক্ষতি যে কমিয়ে আনা সম্ভব, সে কথাও কারও কাছে অবিশ্বাস্য নয়। দুর্যোগের পর বারবারই প্রশ্ন আসে প্রস্তুতির নানান বিষয় নিয়ে। সংশ্লিষ্টরা ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন পরিকল্পনা করেন দুর্যোগ মোকাবেলার। কিন্তু বারবারই যদি একই ভুল করা হয়, ব্যবস্থাপনায় যদি একই ধরণের ত্রুটি থেকে যায়, তাহলে অব্যবস্থাপনার সেই পুরনো বৃত্ত ভাঙবে কীভাবে?

দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতি আরও জোরালো ঘূর্ণিঝড়ের গতিবিধি সম্পর্কে উপকূলের বাসিন্দাদের সচেতন করা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এবার রোয়ানু উপকূল অতিক্রম হওয়ার পর বহু মানুষকে বলতে শুনেছি, ঝড়ের গতিবিধি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। যে রোয়ানু ১৭-১৮ মে শ্রীলংকায় আঘাত করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, সেই ঘূর্ণিঝড়টির খবর আমাদের এখানে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছে ১৯ মে। ঠিক এ বিষয়টি এর আগের ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার ক্ষেত্রেও লক্ষ্য করা গেছে। এক্ষেত্রে যথাযথভাবে প্রান্তিকের মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছানো এবং তাদেরকে সচেতন করার কোনো বিকল্প নেই। শুধু রোয়ানু নয়, আরও কিছু ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার বিষয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতা আগের চেয়ে কিছুটা বাড়লেও আশ্রয়কেন্দ্রের অব্যবস্থাপনার কারণে বহু মানুষ সেখানে যেতে অনীহা দেখান। আশ্রয়কেন্দ্রে কিছু সময় থাকার জন্য যেসব ব্যবস্থা থাকার কথা, তা নেই। অতি প্রয়োজনীয় টয়লেট ও পানির ব্যবস্থা একেবারেই অপ্রতূল। অনেকে বাড়িঘর থেকে কিছু মালামাল এমনকি গরু-ছাগল নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চান। কিন্তু সে ব্যবস্থা অধিকাংশ কেন্দ্রে থাকে না। অন্যদিকে বহু আশ্রয়কেন্দ্র বিভিন্ন ধরণের মালামালে ভর্তি থাকে। কিছু আশ্রয়কেন্দ্র থাকে তালাবদ্ধ। তালা খোলার লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। এইসব কারণে জরুরি সময়ে বিপন্ন মানুষ সেখানে আশ্রয় নিতে পারে না। বেশকিছু ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতের সময় এ ধরণের খবর এসেছে উপকূল থেকে। তাহলে অতীতের অভিজ্ঞতা আমাদের কী শেখালো?

উপকূল অঞ্চলে পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র না থাকার বিষয়টি অনেক পুরনো তথ্য। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে এ অঞ্চলে আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। সিডরের পরেও বেশকিছু আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো যথাযথভাবে হচ্ছে না। যেখানে প্রয়োজন সেখানে নেই, আবার যেখানে প্রয়োজন নেই, সেখানে আছে একাধিক। ভোলার দ্বীপ উপজেলা মনপুরায় প্রায় সোয়া লাখ মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে মাত্র ১২টি। এরমধ্যে কিছু আশ্রয়কেন্দ্র আবার প্রভাবশালীদের দখলে। দখলে থাকার কারণে অনেক স্থানে আশ্রয়কেন্দ্রে কোনো লোকজন উঠতে পারে না। আশ্রয়কেন্দ্র নিয়ে ভিন্ন আরেকটি চিত্র লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলায়। এই উপজেলার তোরাবগঞ্জ বহুমূখী উচ্চ বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ২০১৪ সালে হস্তান্তরিত এই কেন্দ্রে লোকজন আশ্রয় নেয়নি। ঠিক একইভাবে এই আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দক্ষিণে শহীদ নগরে এমন আরও একটি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে। সেখানেও কোনো লোকজন আশ্রয়ের জন্য আসেনি। অথচ প্রয়োজন থাকা সত্বেও এই উপজেলার মেঘনাতীরের মতিরহাট, লুধুয়া, জগবন্ধু, সাহেবেরহাট এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র নেই।

স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি’র বড় ভূমিকা থাকে। জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে এই কমিটি রয়েছে। সারাবছর এই কমিটি নিস্ক্রিয় থাকে। ফলে দুর্যোগের সময় অধিকাংশ স্থানেই তড়িঘড়ি করে এই কমিটি সক্রিয় করা সম্ভব হয় না। সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকা উচিত ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটি। কিন্তু এই দুই কমিটির প্রধান হচ্ছে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান অথবা ওয়ার্ড মেম্বার। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপকূলের একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, নির্বাচিত এই জনপ্রতিনিধিরা কমিটির প্রধান থাকার কারণে সবার সমন্বয়ে কমিটি পরিচালিত হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বরাদ্দ ভাগবাটোয়ারা চিন্তাটি প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার উপজেলা পর্যায়ের কমিটিগুলোর প্রধান থাকেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। কিন্তু উপকূলের অনেক স্থানে নির্বাহী কর্মকর্তারা থাকেন অতিরিক্ত দায়িত্বে। জরুরি সময়ে কমিটির প্রধান ব্যক্তির অনুপস্থিতিতে যা হবার তাই হয়।

ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের বিষয়টি তো উপকূলে অতি পুরনো বিষয়। সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে আমি দেখেছি, বহু স্থানে বেড়িবাঁধ নেই। অনেক স্থানে নতুন বেড়িবাঁধ হলেও অনেক মানুষকে রাখা হয়েছে বাঁধের বাইরে। অনেক স্থানে বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ অসমাপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে বড় ধরণের দুর্যোগের প্রয়োজন নেই, সামান্য জলোচ্ছ্বাসেই বাড়িঘর ডুবে যায়। গৃহহারা হয় বহু মানুষ। উপকূলবাসীর বহুদিনের দাবি শক্ত এবং উঁচু বেড়িবাঁধের। কিন্তু সে দাবি পূরণ হয় না। সিডর বিধ্বস্ত শরণখোলা-মোড়েলগঞ্জকে নিরাপদ করা সম্ভব হয়নি। বৃহৎ আকারের বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হলেও কাজ শেষ করতে পারছে না। নদী শাসন না করায় নির্মাণাধীন বাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছে বারবার। সে কারণে দুর্যোগ প্রশমন করতে হলে উপকূলের সব স্থানে বেড়িবাঁধ নির্মাণ জরুরি।   

বারবারই আমাদের শেখার সুযোগ আসে। ভুল থেকেই শিখতে হয়। সংশোধন করে নিতে হয়। কিন্তু আমরা শিখি না। না শেখাটা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। সিডর যা শেখালো, আইলা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল, তা থেকে কী আমরা শিক্ষা নিতে পারি না? ব্যবস্থাপনায় সব ধরণের ত্রুটি শুধরে নিয়ে আমরা উপকূলের মানুষকে বড় ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে পারি। আসুন, সবাই মিলে আমরা সে কাজটিই করি। আমাদের সক্ষমতা প্রমাণ করি।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়