ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

রেষারেষির যাতাকলে পিষ্ট ঢাকাই চলচ্চিত্র

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৬, ১৪ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রেষারেষির যাতাকলে পিষ্ট ঢাকাই চলচ্চিত্র

রাহাত সাইফুল : ঢাকাই চলচ্চিত্রের সোনালী অতীত এখন শুধুই স্বপ্নের মতো মনে হয়। সিনেমা দেখতে এখন আর হলে ভিড় জমান না দর্শক। লাইট, ক্যামেরার ঝলকানী আর পরিচালকের কণ্ঠে ‘অ্যাকশন-কাট’ শোনা যায় না এফডিসিতে আগের মতো। কোলাহলপূর্ণ সেই এফডিসি এখন অনেকটাই নীরব-নিস্তব্ধ। কাজহীন অভাব-অনটনে দিনযাপন করছেন রুপালি জগতের এক্সট্রা শিল্পী, মেকআপম্যান, স্ট্যান্টম্যানরা। অন্য দিকে ক্ষমতা আর আমিত্ব প্রকাশে ব্যস্ত চলচ্চিত্রের কিছু মানুষ। এদের সংখ্যা কম হলেও এরা একে অন্যের সঙ্গে রেষারেষি, ক্ষমতা প্রদর্শনে ব্যস্ত।

‘শীল পাটায় ঘষাঘষি মরিচের জীবন শেষ!’ এমনটাই ঘটছে বর্তমান ঢাকাই চলচ্চিত্রে। রাঘব বোয়ালরা তাদের কথার ফুলঝুড়ি আর একে অন্যের প্রতি ক্ষমতা প্রদর্শন করছেন। চলচ্চিত্রের এ অস্থিরতায় ইউটিউবে সিনেমা দেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনার  ঝড় তুলে নিজেদের বোদ্ধা ভাবছেন অনেকে। শিল্পীর সঙ্গে শিল্পীর, নির্মাতার সঙ্গে নির্মাতার, প্রযোজকের সঙ্গে প্রযোজকের যেন নেই কোনো আত্মিক সম্পর্ক। দিন দিন বেড়েই চলছে তাদের রেষারেষি। মাত্রা বেড়ে গিয়ে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ আবার মামলা, পাল্টা মামলা করা হয়। মামলাতেই থেমে থাকেনি, হামলার ঘটনাও ঘটেছে। ক্ষমতা প্রদর্শন আর নোংড়া রাজনীতি বাড়লেও দিনে দিনে কমে যাচ্ছে সিনেমা নির্মাণের সংখ্যা। ফলে হলে সিনেমা মুক্তির সংখ্যাও কমে গিয়েছে। অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায়-এক সপ্তাহে কয়েকটি সিনেমা মুক্তির জন্য প্রস্তুত থাকতো। সেখান থেকে প্রযোজক সমিতি নির্ধারণ করে দিতেন কোন দুটি সিনেমা মুক্তি পাবে। আর এখন কে কার সিনেমা মুক্তির তারিখ ঠিক করবে? চলচ্চিত্রের ‘মাদার সংগঠন’ নামে খ্যাত ‘প্রযোজক সমিতি’ সেই কবেই মামলা করে কমিটির নির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে এটি এখন নেতৃত্বশূন্য। 

এই কমসংখ্যক সিনেমা নিয়েও চলে নোংড়া প্রতিযোগিতা। দেখা গেছে সারা বছর সিনেমা শূন্য থাকে হলগুলো কিন্তু নির্দিষ্ট কোন তারিখে সিনেমা মুক্তি দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে প্রযোজকগণ। সম্প্রতি এমন ঘটনা ঘটেছে। সাতাশে আশ্বিন। মনে হচ্ছে এই দিনটিতে সিনেমা মুক্তি দিতে পারলেই যেন নিশ্চিত সুপারহিট! অথবা গিনেস বুক নাম উঠবে! আর তাইতো দেশীয় চলচ্চিত্রের কয়েকটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এই দিনে সিনেমা মুক্তি দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। ফলে তৈরি হয় অসুস্থ প্রতিযোগিতা। চলচ্চিত্রের সংগঠনগুলোর মাধ্যমে এর কোনো সঠিক সমাধান হয়নি। শেষ পর্যন্ত সমাধান পেতে প্রযোজক আদলতের দারস্থ হয়েছেন।

গত সাতাশে আশ্বিন, বারো অক্টোবর ‘মেঘকন্যা’ ও ‘আসমানী’ সিনেমা দুটি মুক্তির ঘোষণা দেন এর প্রযোজক। একই দিন ‘মাতাল’ ও ‘নায়ক’ সিনেমাও প্রদর্শনের কথা রয়েছে। এদিকে নামেমাত্র পুরনো সিনেমা ‘মাতাল’ ও ‘নায়ক’ প্রচারণা ও বেশিসংখ্যক হল পেয়ে যায়। অন্যদিকে ‘মেঘকন্যা’ সিনেমার প্রযোজক হল না পেয় মামলা দায়ের করেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ‘মাতাল’ ও ‘নায়ক’ সিনেমা গত শুক্রবার মুক্তি দেয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেন। অন্যদিকে ‘আসমানী’ সিনেমাটি মুক্তির মিছিল থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। ‘মেঘকন্যা’র প্রযোজক মামলা করেও মাত্র ৮ হল পেয়েছে তার সিনেমার জন্য। ধারণা করা যাচ্ছে সিনেমাটি এসবে না জড়িয়ে প্রেক্ষাগৃহে অন্য যে কোনো সময় মুক্তি দিলে আরো বেশি হল পেত। শোনা যাচ্ছে- ‘মাতাল’ ও ‘নায়ক’ সিনেমার প্রযোজকও ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা দায়ের করবেন ‘মেঘকন্যা’ সিনেমার প্রযোজকের বিরুদ্ধে। কারণ ‘মাতাল’ ও ‘নায়ক’ এই দুটি সিনেমা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে বুকিং করেছে। এছাড়া পোস্টার, ব্যানার দিয়ে প্রচারণা করেছে। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে মূলত ক্ষতির মুখে পড়েছে তিনটি সিনেমাই।

‘মাতাল’ ও ‘নায়ক’ দুটি সিনেমা কৌশল করে এর আগে মাত্র একটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দিয়েছে। কথিত পুরনো সিনেমা হিসেবে ১২ অক্টোবর তারা এটি দেশযোগে মুক্তি দিতে চেয়েছে। সিনেমা মুক্তি নিয়ে এ কৌশল কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে হয়তো আসবে ব্যবসায়ীকভাবে সফল হওয়ার জন্য। কিন্তু এতে করে কেউ কেউ ক্ষতির মুখে পড়ছে। লোকশানটা ইন্ড্রাষ্ট্রির হচ্ছে।যদিও এর আগেও এমন নোংড়া কৌশল অবলম্বন করে প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা মুক্তি দিয়েছেন বতর্মমান সময়ের অনেক নীতিনির্ধারকগণ। বছরের শুরুর দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়- বছর শুরুর প্রথম মাসের দুই সপ্তাহ চলেছে দেশীয় সিনেমা। ‘দেমাগ’, ‘পুত্র’, ‘পাগল মানুষ’, ‘হৈমন্তী’ সিনেমাগুলো মানহীনতার কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে। মাসের তৃতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে দেশীয় সিনেমা মুক্তি পায়নি। এ সময় সাফটা চুক্তির মাধ্যমে কলকাতার ‘জিও পাগলা’ ও ‘ইন্সপেক্টর নটি কে’ সিনেমা দুটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। দর্শক এ দুটি সিনেমা প্রত্যাখ্যান করেছেন। দর্শকদের হলমুখী করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে এসে দেশীয় ও বিদেশি সিনেমা না থাকায় সিনেমা শূন্য হয়ে পড়েছে প্রেক্ষাগৃহগুলো। প্রথম সপ্তাহে নতুন কোনো সিনেমা মুক্তি না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে পুরোনো সিনেমা আর ময়ূরী, পলির অশ্লীল সিনেমা দিয়েই হলগুলো চালাতে হচ্ছে মালিকদের। দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে মুক্তি পায় ‘ভালো থেকো। এই সিনেমাটিও প্রযোজক ও হল মালিকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। তৃতীয় সপ্তাহ আর্থাৎ ১৬ ফেব্রুয়ারি এসে বিগবাজেটের দুটি সিনেমা মুক্তি পায়। দেশীয় সিনেমা ‘আমি নেতা হব’ ও যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ‘নূরজাহান’ মুক্তি পায়। এরপর আবার সিনেমা শূন্য হয়ে পরে প্রেক্ষাগৃহ। পরপর চার সপ্তাহ নতুন কোন সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়নি। বলা চলে একমাস সিনেমা শূন্য প্রেক্ষাগৃহ।

সপ্তাহের পর সপ্তাহ সিনেমা শূন্য থাকে প্রেক্ষাগৃহে তার পরও সিনেমা মুক্তি নিয়ে কেন এত কাড়াকাড়ি। ‘আসমানী’ ও ‘মেঘকন্যা’র মুক্তির জন্য অনেক আগেই প্রস্তুত ছিলো। এই দুটি সিনেমা আগেই মুক্তি দিতে পারতো। অন্যদিকে ‘মাতাল’ ও ‘নায়ক’ সিনেমাগুলিও আগে কোনো এক সপ্তাহে মুক্তি দিলে হয়তো এই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতো না। বছরের মাঝামাঝি বিভিন্ন কারণে শাকিব খানকে বয়কট ও জাজ মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধার আব্দুল আজিজকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা, পরিচালক গাজী মাহবুব, নৃত্য পরিচালক জাকির ও অভিনয়শিল্পী কমল পাটকেরের সদস্য পদ বাতিলসহ কয়েকজনকে নোটিশ পাঠায় সংশ্লিষ্ট সংগঠন। এর পরই ‘চলচ্চিত্র পরিবার’ ও ‘চলচ্চিত্র ফোরাম’ নামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়। কমল পাটকেরে বাদে অন্যদের সকল সমস্যা দৃশ্যমান সমাধান হয়েছে। চলচ্চিত্রের পরিবারের লোকজন জাজ মাল্টিমিডিয়ার কাজ করছে না বা নেয়া হচ্ছে না।

প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া নিয়মিত সিনেমা প্রযোজনা করে যাচ্ছে। এতে জাজের হাত ধরে আসা ও চলচ্চিত্র ফোরামের শিল্পী ও কলাকুশলীরা কাজ করে যাচ্ছেন। চলচ্চিত্র পরিবার থেকে দু’একজন জাজের সিনেমায় কাজ করলেও তাদের দিকে বাঁকা চোখে তাকান চলচ্চিত্র পরিবারের কিছু লোক। এই ভয়ে অনেকেই জাজের কাজ না করে বেকার দিন কাটাচ্ছেন। অন্য দিকে চলচ্চিত্র পরিবারের নেতৃত্বে দেয়া প্রযোজকগণ এখন পর্যন্ত কোন সিনেমা নির্মাণ করেনি। কিছু মৌসুমী প্রযোজক চলচ্চিত্র পরিবারের কিছু শিল্পীদের নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু তুলনামূলক খুবই কম। এদিকে শাকিব খান একটার পর একটা শাপলা মিডিয়ার সিনেমায় কাজ করে যাচ্ছেন। এতে চলচ্চিত্র ফোরাম ও শাকিবের পছন্দের লোকজনই কাজের সুযোগ পাচ্ছে।

নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে অনেককে বেকার থাকতে হচ্ছে। যেহেতু চলচ্চিত্রে কয়েকটা পক্ষ দৃশ্যমান। আর এ কারণেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য শুটিং বন্ধ করে দেয়া, সিনেমা সেন্সর বোর্ডে জমা পরার আগেই নামে বেনামী চিঠিতে অভিযোগ দায়ের, সিনেমা মুক্তির আগে মামলা ঠুকে দেয়া, নিয়মের মারপ্যাঁচে ফেলে সিনেমা আটকে দেয়া। মোট কথা প্রতিপক্ষকে ক্ষতি করতে যতগুলো পথ খুঁজে পাওয়া যায় ততগুলোই ব্যবহার করা হয়। একটি সিনেমা শুটিং শেষ করে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি দেয়া যেন রাজ্য জয় করার মত সস্তি। কিন্তু মুক্তির পরে অধিকাংশ সময়ই লোকশানে পরতে হয় প্রযোজকদের। এদিকে বুকিং এজেন্টদের দৌরাত্মে কুপোকাত প্রযোজক। এত নিয়ম নীতি নিয়ে অভিযোগ তোলেন চলচ্চিত্র বোদ্ধরা কিন্তু বুকিং এজেন্ট নিয়ে তাদের পরিষ্কার কোনো বক্তব্য দেন না।

অন্য দিকে চলচ্চিত্র মুক্তি দিতে গিয়ে প্রজেকশন মেশিন কম্পানির কাছেও জিম্মি হয়ে থাকতে হয় প্রযোজককে। বিএফডিসিতে সেন্ট্রাল সার্ভেয়ারের মাধ্যমে সিনেমা চালালে এসব সমস্যা অনেকটাই দূর করা যায়। ই-টিকেটিং ব্যবস্থা করে প্রযোজকের ন্যায্য পাওনা মেটানো সম্ভব। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টরা পরস্পরের প্রতি কাদা ছোঁড়াছুড়ি বেশি করছেন, কাজ কম করছেন। ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় অসহায় হয়ে পরছে চলচ্চিত্রের স্বল্প আয়ের মানুষগুলো। যাদের জীবিকা চলচ্চিত্র থেকে তারা বড় বড় রাঘব বোয়ালদের রেষারেষির যাতা কলে পিষ্ট হয়ে অর্থাভাবে দিনযাপন করছেন। চলচ্চিত্রের শুটিং বন্ধ বা সিনেমা মুক্তি বন্ধ করে নয়, নিয়মের মধ্যে থেকে চলচ্চিত্রে প্রযোজনায় সুযোগ করে চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব। চলচ্চিত্রের স্বার্থে সকল ভেদ ভুলে এখন প্রয়োজন বেশি বেশি মানসম্পন্ন সিনেমা নির্মাণ করা। তাহলেই চলচ্চিত্রে আবারো সুবাতাস বইবে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ অক্টোবর ২০১৮/রাহাত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়