ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সাহিত্যে বিকল্প নোবেল

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৪, ৩০ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাহিত্যে বিকল্প নোবেল

মাছুম বিল্লাহ : এ বছর মে মাসে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল যে, ২০১৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়া হবে না। কারণ হিসেবে বলা হয় যে, যারা পুরস্কারজয়ীদের মনোনীত করেন সেই জুরীদের একজন কবি কাতারিনা ফ্রসতেনসনের স্বামী প্রখ্যাত আলোকচিত্রী জ্যঁ ক্লদ আর্নোর যৌন কেলেঙ্কারী এবং দুর্নীতির জের ধরে জুরিবোর্ডের সদস্যগণের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগে গিয়েছিল। বোর্ডের সভাপতি সারা দানিউস পদত্যাগ করেছিলেন। এই পরিস্থিতিতে নোবেল কমিটির ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। মানুষের আস্থায় চিড় ধরেছে। জুরিবোর্ডের সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কারের পরে ২০১৮ ও ২০১৯ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার একসঙ্গে দেয়া হবে।

সুইডিশ একাডেমির ফটোগ্রাফার জ্য-ক্লদ আর্নল্ট হচ্ছেন সুইডিশ একাডেমির সদস্য ও লেখিকা ক্যাটরিনা ফ্রসটেনসনের স্বামী। তার বিরুদ্ধে অন্তত আঠারোজন নারী ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আছে। এর মধ্যে কিছু ঘটনা সুইডিশ একাডেমির মালিকানাধীন স্থাপনা ও সম্পত্তির ভেতর ঘটেছে। আর্নল্ট ও ফ্রসতেনসন স্টকহোমে একটি সংস্থা পরিচালনা করেন। আর সেটির অর্থায়ন করেছে সুইডিশ একাডেমি। স্টকহোমের একটি আদালতে আর্নল্টের ধর্ষণ মামলার শুনানী শেষ  হয়েছে এবং তিনি এখন আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষা করছেন যদিও তিনি সব সময়ই নিজেকে এ বিষয়ে নির্দোষ বলে দাবি করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সাহিত্যে নোবেলজয়ীর নাম ফাঁস করে দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। ওই কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর ফ্রসতেনসন ও আর্নল্টের ভবিষ্যত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয় সুইডিশ একাডেমির সদস্যরা। ফলে একাডেমির সদস্যদের মধ্যে মতানৈক্য দেখা দেয়। এমনকি একাডেমির সদস্যরা একে অপরকে অপমানও করে। এদিকে ফ্রসতেনসনকে তার পদ থেকে অপসারণ করা হবে না- একাডেমির এমন সিদ্ধান্তে সংস্থাটির আঠারোজন সদস্যদের মধ্যে তিনজন পদত্যাগ করেন। একাডেমির স্থায়ী সচিবও প্রতিবাদ জানিয়ে পদত্যাগ করেন। পরে ফ্রসতেনসন নিজেও একাডেমি ছেড়ে যান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সুইডিশ সোসাইটির একশজন গুরুত্বপূর্ণ কালচারাল সদস্য ‘নিউ একাডেমি প্রাইজ’ নামে একটি অ্যাওয়ার্ড চালু করে। তবে এখানে কোনো প্রার্থীর মনোনয়ন প্রক্রিয়া সুইডিশ একাডেমির মতো গোপন নয়। বরং উন্মুক্ত। এবার এই বিরল ও বিকল্প নোবেল পুরস্কার পান মেরিস কন্ডে।

আলেকাজান্দ্রা পাসকালিদো নামের রোমানিয়ান বংশোদ্ভূত এক সুইডিশ নারী সাংবাদিক সুইডিশ একাডেমিসংশ্লিষ্ট ক্লদ আর্নোর যৌন ও অর্থ কেলেঙ্কারীর খবর নিয়ে কয়েকমাস যাবত প্রতিবেদন প্রকাশ করছিলেন। সুইডেনের নাগরিক হিসেবে তিনি এবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার না দেয়ার বিষয়টিতে বিব্রত বোধ করছিলেন। তিনি এক টিভি চ্যানেলে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি ভেবে দেখলাম একজন-দু’জনের কুকর্মের জন্য লেখকদের কেন খেসারত দিতে হবে? একজনের চরিত্র স্খলনের জন্য পুরস্কারই বাতিল হয়ে যাবে- এ কেমন কথা?’ কাজেই তিনি এ বিষয়ে একটি মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি একশজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে বিকল্প নোবেল দেয়ার কাজ শুরু করলেন। তাঁদের মধ্যে কবি, লেখক, অভিনয়শিল্পী, সংগীতশিল্পী রয়েছেন। তারাই মূলত ঠিক করেছেন ‘নিউ একাডেমি প্রাইজ’। এই নব্যসৃষ্ট একাডেমি লিটারেচার নামে একটি প্রাইজ প্রদান করবে। পুরস্কারের অর্থমূল্য হবে দশ লাখ ক্রোনার অর্থাৎ এক লাখ বারো হাজার ডলার। পুরো অর্থ এই একশজন এবং অন্যরা চাঁদা হিসেবে দিয়েছেন। গত ১৪ অক্টোবর এই পুরস্কার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয়।

এবার পুরস্কারের তালিকায় ছিলেন মার্গারেট অ্যাটউড, অ্যান কারসন এবং কিম থু নামের তিনজন কানাডীয় নারী লেখক। এ ছাড়াও ভারতের অরুন্ধতী রায়, জাপানের মুরাকামি হারুকি, কেনিয়ার ওয়া থিয়ংগো নগুগি, ওয়াডেলুপিয়ার মেরিস কন্ডে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মোট ১৩ লেখকসহ সুইডেনের ১২ জন লেখক। এ পুরস্কারের জন্য চূড়ান্ত মনোনয়ন পান চারজন। চূড়ান্তভাবে তিনজনের নাম লিস্টে থেকে যায়। কারণ মুরাকামি চূড়ান্ত তালিকা থেকে তাঁর নাম প্রত্যাহার করেন। তিনি গণমাধ্যমের অন্তরালেই তার সাহিত্যচর্চা করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। মেরিসে কন্ডে ‘দেসিরাদা’, ‘সাগু অ্যান্ড ক্রসিং’, ‘দ্য ম্যাংগ্রোভ’সহ মোট বিশটি উপন্যাস রচনা করেছেন। অ্যান প্যালসনের মতে তিনি একজন ‘গ্রান্ড স্টোরিটেলার’ যার গল্পগুলো বিশ্বসাহিত্যেরই অংশ। প্যালসন বলেন, তিনি ঔপনিবেশিক শাসনের ধ্বংসলীলা এবং ঔপনিবেশ পরবর্তী বিশৃঙ্খলার কথা যথাযথভাবে এবং চমৎকারভাবে তার ভাষায় তুলে ধরেছেন। তার গল্পে জীবনগুলো খুব সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়েছে  এবং শ্রেণি-বর্ণ-লিঙ্গের ধরনের নুতন মাত্রা পেয়েছে।

মেরিসে কন্ডে জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৭ সালের  ১১ ফেব্রুয়ারি। ১৯৮৪-৮৫ সালে প্রকাশিত তার উপন্যাস ‘সেগু’র জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এ ছাড়াও তিনি কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসিভাষার অধ্যাপক। তিনি ১৯৮৬ সালে গ্রান্ড প্রিক্স লিটারেয়ার ডি লা ফেমে এবং ১৯৮৮ সালে প্রিক্স দে ল আকাদেমি ফ্রাঞ্চাইজ পুরস্কার লাভ করেন। কন্ডে পুরস্কার পাওয়ার পর তার অনুভূতি ব্যক্ত করেন এভাবে: ‘আমি খুশি এবং গর্বিত। তবে দয়া করে এই পুরস্কারটি আমার পরিবার, বন্ধু এবং সবার উপরে গোয়াডেলপুরের মানুষের সাথে ভাগাভাগি করার সুযোগ দিন। আমাকে এই পুরস্কারটি স্পর্শ করতে দেখলে তারা শিহরিত হবেন। আমাদের দেশটির নাম শুধু ঘুর্ণিঝড় আর ভূমিকম্পের নামের সাথে শোনা যায়। কিন্তু এখন আমাদের এই দেশের নাম অন্যকিছুর জন্যও শোনা যাবে। এতে আমরা সত্যিকার অথেই আনন্দিত।’ তিনি আরও বলেন, ‘একশরও বেশি লাইব্রেরি প্রায় ৩৩০০০ সদস্যের কাছ থেকে পাবলিক ভোট নেয়। এটি আশ্চর্যজনক ছিল। এই রকম ঘটনায় একতাবদ্ধভাবে কাজ করা একটি বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। মানুষ যে সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের প্রতি এখনো কতটা নিবেদিত তা এই ঘটনা প্রমাণ করে।’

আমরাও মেরিসের সঙ্গে আনন্দিত ও উৎফুল্ল কারণ মূল্যবোধের অবক্ষয়, পৃথিবীজুড়ে নিরীহ মানুষদের নিজ বাসস্থান থেকে বিতারণ এবং যৌন কেলেঙ্কারীর এই মুহূর্তেও মানুষ সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ হারায়নি এবং নোবেলের পরিবর্তে তার সমতুল্য একটি পুরস্কারের ব্যবস্থা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এবং নিজ দায়িত্ববোধ থেকে করেছেন একদল মানুষ, আমরা তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। নিউ একাডেমি প্রাইজ-এর বিজয়ী নির্বাচন আর নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর মধ্যে পার্থক্য ছিল। মোট তিনটি ধাপে বিচারকাজ হয়েছে। প্রথম ধাপে নিউ একাডেমি থেকে লেখক মনোনয়ন করার জন্য সুইডেনের সব গ্রন্থাগারকে অনুরোধ করা হয়। তারা বিশ্বের যে কোন স্থানের যে কোন লেখককে মনোনয়ন করার প্রস্তাব করতে পারবে। শর্ত হলো যে লেখকের নাম প্রস্তাব করা হবে, তার কমপক্ষে দুটি বই থাকতে হবে। তার মধ্যে অন্তত একটি বইকে গত দশ বছরের মধ্যে প্রকাশিত হতে হবে। একশরও বেশি লাইব্রেরির ৩৩০০০ সদস্যের কাছ থেকে পাবলিক ভোট নেওয়া হয়। ভোটিং প্রক্রিয়ায় পাঠকদের ভোট বা সমর্থন একটি অভিনব পদ্ধতি। ফলে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত ৪৭জন লেখক এই ভোট প্রক্রিয়ায় অনলাইনে অংশ নেন। ভোটের সময়সীমা শেষ হয় ১৪ আগস্ট। পুরস্কার প্রদান করা হবে ১০ ডিসেম্বর। পুরস্কার প্রদানের পরের দিনই অর্থাৎ ১১ ডিসেম্বর এ সংস্থাটির বিলুপ্তি ঘটবে বলে আয়োজকরা জানান।

যৌন কেলেঙ্কারির কারণে সুইডিশ একাডেমিতে অস্বস্তি বিরাজ করছিল। ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি আন্দ্রেস উলসন বলেছিলেন, ‘কমিটির সদস্যদের পরষ্পরের প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাওয়ায় এবং নোবেল পুরস্কারের গৌরব ও তার প্রতি বিশ্বের মানুষের বিশ্বাস কমে যাওয়ায় নোবেল কমিটি এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না।’ প্রথা অনুযায়ী সাহিত্যে নোবেলজয়ীর নাম ঘোষণা হয় মূলত বৃহস্পতিবার। এ বছর যেহেতু সাহিত্যে নোবেল দেয়া হয়নি তাই ৪ অক্টোবর বৃহস্পতিবার দিনটি খালি রাখা হয়। নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের বছর থেকে অদ্যাবধি মোট সাতবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ‘না দেয়ার ঘোষণা’ দিয়েছিল সুইডিশ একাডেমি এবং বছরগুলো হচ্ছে- ১৯১৫, ১৯১৯, ১৯২৫, ১৯২৬, ১৯২৭, ১৯৩৬ এবং ১৯৪৯ সাল। এই বছরগুলোর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার না দেয়াকে ‘রিজার্ভ প্রাইজ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ছয়বার নির্ধারিত বছরে পুরস্কার না দিয়ে পরের বছর একসঙ্গে দুজন বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। একইভাবে ২০১৮ সালের পুরস্কারটি ২০১৯ সালের বিজয়ীর নামের সঙ্গে ঘোষণা করা হবে বলে সুইডিশ একাডেমি বিশ্ববাসীকে এ বছরের মে মাসে জানিয়েছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যারা বিকল্প নোবেল প্রাইজের আয়োজন করেছেন তাদের বিশ্ববাসী শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়