ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ইশতেহার: ‘ভুলগুলো’ ও ‘ফুলগুলো’

কমলেশ রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২৬, ২০ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইশতেহার: ‘ভুলগুলো’ ও ‘ফুলগুলো’

কমলেশ রায় : ইশতেহার কী? অভিধানে শব্দটির বেশ কিছু অর্থ রয়েছে। তবে মোটা দাগে ইশতেহার হচ্ছে জনগণ বিশেষ করে ভোটারদের কাছে রাজনৈতিক দলের অঙ্গীকার। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের বড় দুই দল ও জোট সম্প্রতি নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে। এরপর থেকেই শুরু হয়েছে আলোচনা, সমালোচনা। বিচার-বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন। সাধারণ মানুষ থেকে বিশিষ্টজন কমবেশি সবাই শামিল ইশতেহার ব্যবচ্ছেদে। বিভিন্ন শ্রেণি- পেশার মানুষ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ইশতেহার কাঁটাছেঁড়া করছেন, ভিন্ন ভিন্ন মতামত দিচ্ছেন। একপক্ষ আরেকপক্ষের প্রতি ছুঁড়ছেন বাক্যবাণ। এই তীব্র শীতেও তেঁতে উঠছে আলোচনার আসর। কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলের ইশতেহারেই এবার বেশ কিছু নতুনত্ব আছে। কেউ আবার নিজ সমর্থিত দলের ইশতেহারকেই সেরা মনে করছেন। অন্যকিছুকে আমলে নেওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না। অনেকে আবার বিজ্ঞসুলভ ভাব বজায় রেখে বলছেন, ইশতেহারে শুধু ভালো ভালো প্রতিশ্রুতি লিপিবদ্ধ থাকলেই হবে না, বিজয়ী হলে সেগুলোর বাস্তবায়নও করতে হবে। সেটাই সবচেয়ে জরুরি।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ৩৫ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে ১৭ ডিসেম্বর। একদিন বাদে ইশতেহার ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আওয়ামী লীগের বিশেষ অঙ্গীকার ২১ দফা। আর বিএনপির প্রতিশ্রুতি ১৯ দফা। আওয়ামী লীগের ইশতেহারের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। বিএনপি অঙ্গীকার করেছে ‘রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা সুদৃঢ়’ করার। একই সঙ্গে ক্ষমতায় গেলে ভোটের সময়ের গণতন্ত্রকে ‘নিত্যদিনের অনুশীলনে’ পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে দলটি। আর ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বিএনপির ইশতেহারের অনেকটা মিল থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক। বরং অমিলটাই এখন আলোচনার বিষয়।

আওয়ামী লীগের ইশতেহারে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে তারুণ্য এবং  গ্রাম উন্নয়নকে। দলটির ইশতেহারে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় যেতে পারলে দেশের প্রতিটি গ্রাম আধুনিক নগরের সুবিধাসম্পন্ন করে গড়ে তোলা হবে। চাঙ্গা করা হবে গ্রামের অর্থনীতি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে থাকবে জিরো টলারেন্স নীতি। একই সঙ্গে ইশতেহারে বিশেষ বিবেচনায় রাখা হয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গ সমতা ও শিশুকল্যাণ, সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ ও মাদক নির্মূল,  পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তাকে। পাশাপাশি দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি ধরে রাখতে মেগা প্রকল্পগুলোর দ্রুত ও মানসম্মত বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

এদিকে ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য ও পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে না থাকার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা, প্রশাসনিক সংস্কার ও বিকেন্দ্রীকরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল, পিএসসি এবং জেএসসি পরীক্ষা বাতিল, পুলিশ ও সামরিক বাহিনী ছাড়া চাকরিতে প্রবেশের বয়স সীমা না থাকা, নারীর নিরাপত্তা এবং ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিহিংসার রাজনীতি দূরীকরণ, নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, দুর্নীতি দমন ও সুশাসনসহ ১৪টি বিষয়ে দৃশ্যমান ও জোরাল পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে জোটটির পক্ষ থেকে।

ইশতেহারে বিএনপি বলেছে ক্ষমতায় গেলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করাসহ সব কালো আইন বাতিল করা হবে। ঐকমত্য, সবার অন্তর্ভূক্তি এবং প্রতিহিংসাহীনতা হবে দলটির রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। পাশাপাশি তারা প্রতিবছর প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপিদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ এবং প্রবৃদ্ধির হার ১১ শতাংশে উন্নীত করবে। এছাড়াও সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আইন করবে দলটি।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির ইশতেহারে বেশ কিছু ভালো উদ্যোগের কথা রয়েছে । রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা, সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা উঠিয়ে দেওয়া, পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলসহ বেশ কিছু বিষয়ে একই ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট। আবার অনেক মিলের সঙ্গে কিছু অমিলও আছে। বিএনপির ক্ষেত্রে স্পষ্ট হয়েছে আপাত বিরোধিতা। ঐক্যফ্রন্ট ইশতেহারে উল্লেখ করেছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চালিয়ে যাবে। বিএনপি এ বিষয়ে ইশতেহারে কিছুই বলেনি। বরং যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারে সাজাপ্রাপ্তদের সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের ধানের শীষ মার্কায় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, ঐক্যফ্রন্ট যুদ্ধাপরাধের বিচার অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করলেও আপনারা কেন বিষয়টি রাখেননি? প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গিয়ে তিনি শুধু বলেছেন, পরে ওয়েবসাইটে  ইশতেহারের বিস্তারিত তুলে ধরা হবে। সচেতন মহল অবশ্য মনে করেন, জামায়াতের কথা বিবেচনা করেই বিএনপি যুদ্ধাপরাধ নিয়ে কোনো কথা বলেনি। ভোটের অংক মাথা রেখেই এ কাজ করেছে তারা।  তবে তাদের এই বিবেচনায় ঝুঁকিও রয়েছে। এবার প্রচুর নতুন ভোটার। বলা বাহুল্য, তারা বয়সে তরুণ। আর আমাদের তরুণদের সিংহভাগই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব বোধ করে।

এদিকে ইশতেহারে বিএনপি তাদের কারাবন্দি নেত্রী খালেদা জিয়া এবং  লন্ডনে অবস্থানকারী তার ছেলে তারেক রহমানকে যেভাবে তুলে ধরেছে, সেই তুলনায় এ বিষয়ে ঐক্যফ্রন্ট ছিল একবারে চুপচাপ। তারেকের প্রসঙ্গই তারা তোলেনি। আর খালেদার বিষয়ে তারা জবাব দিয়েছেন বেশ কৌশলে। ঐক্যফ্রন্ট নেতারা বলেছেন,  আমাদের ঐক্যের ভিত্তি হচ্ছে পাঁচ দফা। পাঁচ দফার মধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তির কথা রয়েছে। আবার আরেকটি বিষয়ে সরব হয়েছেন অনেকেই। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, ওয়ান-ইলেভেনের পর যেসব রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল, তার কিছু ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহারে প্রতিফলিত হতে দেখা গেছে। বিএনপি এর সঙ্গে কতটা একমত? অনেকেই মনে করছেন, সত্যি এই প্রশ্নটা ভেবে দেখার মতো।
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট ইশতেহারে যা বলেছে সেটাও কী বাস্তবসম্মত? বর্তমান বয়সসীমা যৌক্তিক না হলে তা বাড়ানো যেতে পারে, কিন্তু তুলে দেওয়া কি সম্ভব? অবসর নিয়েও তখন কেউ যদি ফের চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ভেবে বসে! এমন রসিকতাও করছেন কেউ কেউ।

পরিসংখ্যান বলছে, এবারের নির্বাচনে নতুন ভোটার রয়েছে দুই কোটির উপরে। আর তাই আওয়ামী লীগ, বিএনপি দুই দলই তাদের ইশতেহারে তরুণদেরকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। তাদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেছে। বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ তো তাদের ইশতেহার বলছে, ‘সোনার বাংলা স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রধানতম শক্তি হচ্ছে যুব শক্তি’।
এদিকে গত দশ বছরে দেশের অর্থনীতি ও মানুষের জীবনে যে ব্যাপক গুণগত পরিবর্তন এসেছে, সেটা আওয়ামী লীগ দারুণ দক্ষতায় তুলে ধরেছে তাদের এবারের ইশতেহারে। নিজেদের শাসন আমলের অর্জন ও সাফল্য চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি এতে তারা উল্লেখ করেছে আগামী পাঁচ বছরের লক্ষ্য ও পরিকল্পনার কথা। আওয়ামী লীগের এবারের ইশতেহারের অভিনব দিকটি হচ্ছে, ব-দ্বীপ পরিকল্পনার অধীনে সমন্বিতভাবে মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী এসডিজি (২০৩০) এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ (২০৪১) গড়ার অঙ্গীকারগুলো এতে খুবই স্পষ্ট ও সুন্দরভাবে উঠে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে দেশ পরিচালনার অঙ্গীকার করেছে দলটি। রূপকল্প ২০২১ এবং ২০৪১-এর আলোকে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের লক্ষ্যগুলো অর্জনে একটি উপযুক্ত ও দক্ষ প্রশাসন গড়ে  তোলার পরিকল্পনার কথা এবারের ইশতেহারে স্থান পেয়েছে জোরালোভাবে। পাশাপাশি ইশতেহারে দলটি উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়নের কথা বলেছে। এতে দারিদ্র্য আরও কমবে, এগিয়ে আসার সুযোগ পাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। নারীর ক্ষমতায়ন আরও বেশি করে হবে। আর বাড়বে বয়স্কদের সুবিধা।

আওয়ামী লীগের ইশতেহার ঘোষণার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘মানুষ মাত্রই ভুল হয়। কাজ করতে গিয়ে আমার বা আমার সহকর্মীদের ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকতে পারে। আমি নিজের এবং দলের পক্ষ থেকে আমাদের ভুল-ভ্রান্তিগুলো ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখার জন্য দেশবাসীর প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাচ্ছি।’ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। আর এ ধরনের ভুল স্বীকার আমাদের সংস্কৃতিতে বিরল। প্রতীকী গুরুত্বের কথা বিবেচনায় নিয়ে বলতে হয়, ‘ভুল’ এভাবে স্বীকার করে নিলেই তা ‘ফুল’ হয়ে ধরা দেয়।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যসেবক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়