ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

চারদিকে হইচই, ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৭, ৩ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চারদিকে হইচই, ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই

মাছুম বিল্লাহ: বিগত দশ বছর দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যান্য দিকের সঙ্গে আরো একটি নতুন দিক যুক্ত হয়েছে। সেটি হলো শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যবই তুলে দেয়া। অন্যান্য সব বিষয়ের সঙ্গে এ বিষয়টিরও কিছু সমালোচনা আছে। কিন্তু সেসব সমালোচনা ছাপিয়ে এই কর্মসূচির মাধ্যমে নতুন এক দিক বাংলাদেশে উন্মোচিত হয়েছে। এটি সত্যি প্রশংসাযোগ্য। এ ধরনের উদাহরণ বিশ্বের অন্য কোনো গরিব দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই। আমাদের দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা বছরের প্রথম দিন নতুন বই হাতে নিয়ে আনন্দে হাসতে হাসতে, নাচতে নাচতে দিবসটি উদযাপন করে এবং বাড়ি চলে যায়। রাজধানী ঢাকা থেকে বিভাগ, জেলা শহর, উপজেলা ও গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যায় এই আনন্দের ঢেউ। রাজধানীতে দুটি বড় উৎসবের মধ্যে দিয়ে বিনামূল্যে বই বিতরণ অনুষ্ঠান পালিত হয়েছে এবার। একটি অজিমপুর সরকারি গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে, অন্যটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে।

শিশু শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে দেয়ার প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ১৯৭২ সালে। তখন বঙ্গবন্ধু সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান করা হবে এবং ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ৪০ শতাংশ কম দামে বই সরবরাহ করা হবে। স্বাধীন দেশের উপযোগী করে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপিয়ে তা সোনালী ব্যাংকের শাখার মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করার ব্যবস্থা করা হয়। বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের মাঝে বিনামূল্যে বই খাতা, পেন্সিল, দুধ, ছাতু, বিস্কুট বিতরণ করার নির্দেশ দেন। তারপর আমাদের দেশে বাধ্যতামূলক শিক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার ১৯৮৩ সাল থেকে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে কিছু বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ শুরু করে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত নির্ধারিত কয়েকটি ক্যাটাগরির কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের অর্ধেক নতুন ও অর্ধেক পুরনো পাঠ্যবই বিনামূল্যে দেয়া হতো। কিন্তু বইগুলো শিক্ষার্থীরা সময়মতো হাতে পেত না। বই হাতে পেতে শিক্ষার্থীদের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। অনেককে উচ্চ মূল্যে বই কিনতে হতো। শতভাগ বিনামূল্যের পাঠ্যবই প্রদান শুরু হয় ২০১০ সালে শেখ হাসিনা সরকারের সময়। ঐ বছর ১৯ কোটি ৯০ লাখ ৯৬ হাজার ৫৬১কপি বই শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হয়। এ বছর ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮২কপি বই বিনামূল্যে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ বই বিতরণের সংখ্যা ক্রমে বেড়েছে। এভাবে গত দশ বছরে সরকারের দেয়া বিনামূল্যের বইয়ের পরিমাণ ২৯৬ কোটি ৭ লাখ ৮৯ হাজার ১৭২কপি। এতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। দেশের শিক্ষা বিস্তারে নিঃসন্দেহে এটি একটি অনন্য উদ্যোগ। বছরের প্রথম দিন খালি হাতে স্কুলে যাওয়া, আর সহপাঠীদের সঙ্গে পাঠ্যপুস্তক উৎসবে অংশগ্রহণ করে এক সেট ঝকঝকে নতুন বই নিয়ে আমাদের ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের বাড়ি ফেরা- এ এক অন্যরকম আনন্দ! অন্যরকম অনুভূতি! এই শিশুরা যেদিন বড় হবে সেদিন তারা হয়তো তাদের অনুভূতি সঠিকভাবে ব্যক্ত করতে পারবে। তাদের বর্তমান অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছে তারা কত আনন্দিত! কেউ কেউ তাদের আনন্দ প্রকাশও করেছে বিভিন্নভাবে।

এত আনন্দ ও খুশীর মাঝেও বই বিপণন নিয়ে নানা ধরনের ঘটনা পূর্বে ঘটেছে। যেমন- বই কালোবাজারে বিক্রি, বইয়ের সঙ্গে নোট বই কিনতে স্কুল হতে অভিভাবকদের বাধ্য করা, মাধ্যমিকের বিভিন্ন শ্রেণির বই বছরের পর বছর সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়া, পাঠ্যপুস্তকের মান নিয়ে সংশয়। দেশে পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ ও বিতরণ ঘিরে যে কায়েমি চক্র গড়ে উঠেছিল তারা পুরোপুরি নিস্ক্রিয় হয়নি। তারা এই পুরো প্রক্রিয়ায় একটা ঝামেলা বাধানোর তালে থাকে। বিষয়টি সরকারকে দেখতে হবে। শুধু তাই নয়, সরকারের এই শুভ উদ্যোগ যেন ব্যর্থতায় পর্যবসিত না হয় এ কারণে কঠোর হাতে তাদের দমন করতে হবে। আর একটি দুর্ঘটনা হচ্ছে পাঠ্যপুস্তক বিতরণের পরেও কিন্তু উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। এই সমস্যা এখন দূর করা দরকার।

এক সময় আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরাই শুধু নয়, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরাও পুরনো বই দিয়ে বছর পার করে দিত। তখন হতদরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা নতুন পাঠ্যপুস্তক হাতে পাওয়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত ছিল। বিনামূল্যের বই বিতরণ কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর এখন বছরের শুরুতেই প্রাথমিকের সব শিক্ষার্থী নতুন বই হাতে পাচ্ছে। নতুন বই হাতে পেয়ে শিক্ষার্থীরা যে স্বস্তির হাসি হাসে তার তুলনা হয়না। এই উচ্ছ্বাস তাদের বইমুখী হতে উদ্বুদ্ধ করবে আমরা আশা করি। এই আবেগ পড়াশোনার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়াবে। শিক্ষার্থীদের এই আগ্রহ যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে এরাই একদিন ব্যতিক্রমী সাফল্য অর্জন করতে পারবে। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এই শিক্ষার্থীরাই দক্ষ জনশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের দক্ষতা অর্জন করতে হবে। আগামীতে সব দেশেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে। তখন যে ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হবে, তা বিবেচনায় রেখে এখন থেকেই আমাদের শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের দক্ষতা অর্জনের প্রস্তুতি নিতে হবে। তা না হলে তাদের পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সারাদেশের শিক্ষার্থীদের অভয় দিয়ে বলেছে, বছরের প্রথম দিন কোনো কারণে বিদ্যালয়ে যেতে না পারলেও কিংবা কোনো কারণে বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলে উদ্বেগের কিছু নেই। বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ক্লাসে গেলেই শিক্ষার্থীরা হাতে পাবে নতুন বই। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা পাস করা শিক্ষার্থীদেরও চিন্তা নেই। পরবর্তী ক্লাসে ভর্তি হলেও তারা পাবে নতুন পাঠ্যবই। নির্বাচনের কারণে এবার বইয়ের কাজ আগে শেষ করার টার্গেট নির্ধারণ করেছিল সরকার। ভালোভাবে সে কাজ সম্পন্ন হয়েছে। রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যেও তাই বছরের প্রথম দিনই শিক্ষার্থীর হাতে বিনমূল্যে নতুন ঝকঝকে বই পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। পুরো প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত সবাই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এনসিটিবির তথ্যমতে ২০১৯ সালে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভাষার ১০,৬০,১৫,৭০৩টি এবং অন্ধ-প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর ব্রেইল পাঠ্যপুস্তক ৫,৮৫৭টি, শিক্ষক নির্দেশিকা ১,২৪,২৬১টিসহ মোট ৩৫,২১,৯৭,৮৮২টি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে বিতরণ করা হচ্ছে। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের যখন অভ্যূদয় হয়, তখন ৮৫শতাংশ মানুষ ছিল দরিদ্র। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি শিক্ষা খাতেও বরাদ্দ বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে সর্বমোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩,৬৯,৬১,৯৭৮ জন। প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট থেকে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট ১৬,৬৪,৫৭৭ জন ছাত্রছাত্রীকে সরাসরি অর্থ বা বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, মোট শিক্ষার্থীর ৪৫শতাংশই কোন না কোন প্রণোদনা বা বৃত্তি-উপবৃত্তি পেয়ে থাকে। শিক্ষাক্ষেত্রে এসব প্রণোদনা আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

লেখক: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ জানুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়