ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

সৈয়দ আশরাফ : মিতবাক নক্ষত্রের বিদায়

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:১২, ৫ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সৈয়দ আশরাফ  : মিতবাক নক্ষত্রের বিদায়

অজয় দাশগুপ্ত : অপ্রত্যাশিত বটে তবে ধারণার বাইরে ছিল না এই ঘটনা। অনেকদিন থেকেই তিনি ভালো ছিলেন না। প্রায়ই চিকিৎসার জন্য ছুটে বেড়াতেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরকারি দলের সেক্রেটারি হওয়ার পর এমন সৎ ও বিবেকবান মানুষ খুব কম দেখে গেছে। আমি বলব মরহুম তাজউদ্দীন আহমেদের পর তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বন্দিত আর নন্দিত সম্পাদক। কারণ খুবই স্পষ্ট। মাইক্রোফোনের সামনে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা মানুষ ছিলেন না তিনি। কন্ঠস্বর যেমন লঘু, কথাও বলতেন পরিমিত। মনে করে দেখুন, এমন কোনো ঘটনা বা কাজ তিনি করেননি যা দেশব্যাপী কুতর্কের জন্ম দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের প্রথাগত উচ্চকন্ঠের রাজনীতির বিপরীতে এক নরম মানুষ যিনি অজান্তে মানুষের মন স্পর্শ করে কালজয়ী হয়ে গেছেন। আমি অনেক আড্ডায় খোদ বিএনপি নেতা-কর্মী বিরোধীদের ও বলতে শুনেছি তাঁর মত মানুষ রাজনীতিতে বিরল।।

সৈয়দ আশরাফ বংশ পরম্পরায় রাজনীতি করতেন। পিতার গর্বেই বুক ফুলিয়ে চলার যথেষ্ট কারণ থাকলেও মুখে তা বলতেন না। কারণ সব কথা বলার দরকার পড়ে না। তাঁর পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ থেকে বিদেশি মিডিয়ায় বাংলাদেশের জন্ম প্রক্রিয়ার সব খবর আর ছবিতে দৃশ্যমান এক ব্যক্তিত্ব। সেই মানুষের পুত্র হওয়ার পরও অহঙ্কারহীন বিনয় আর নির্মোহ মনোভাবেই তিনি আমাদের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। তফাৎ অনেক। এমন সব তফাৎ আছে যা সময় হলে বলা যাবে। আপাতত বলি, বাংলাদেশের রাজনীতির এমন কালে তাঁর মত ব্যক্তি দুটো কারণে বিরল। প্রথমত তিনি সরকারি দলের দ্বিতীয় প্রধান হওয়ার পরও গায়ে কাদা লাগাননি। শেষত তাঁর আসা-যাওয়া সবকিছু এমন নিয়মমাফিক আর গণতান্ত্রিক যে তা মুখে বলার দরকার পড়ে না।

তাঁকে টার্গেট করেছিল দেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় এক দৈনিক। তাদের টেলিফোন আলাপ ফাঁস হওয়ার পর তা শুনেই বোঝা গেছিল তাদের আক্রোশের কারণ কী। আক্রোশের কারণ ছিলো তাদের কথামত না চলা। তাদের উপেক্ষা করে নিজের মতো করে পথ চলা। সে কাহিনীর তিনি কোনো দাঁত ভাঙা জবাব দেননি। নীরবে তাদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ভুল সবই ভুল। আজ তারাও নিশ্চয়ই মাতম করবেন। এটাই আমাদের নিয়তি।

আমরা বাঙালিরা জীবদ্দশায় কাউকে সম্মান করতে জানি না। আমাদের কাজ হলো যতদিন কেউ বেঁচে থাকে ততদিন তাঁকে জ্বালিয়ে মারা। আর মৃত্যুর পর কথিত শ্রদ্ধার নামে তাঁর আত্মাকে অসম্মান করা। আমি কথা বলে দেখেছি, তাঁর মত মাটির মানুষ নেহাৎ পাওয়া যায় না।

তিনি তখন সদ্য বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক। অথচ না ছিলো কোনো বেদনা, না কোনো রাগ। এমনকি তিনি বিচলিতও ছিলেন না। তাঁর পত্নী শীলা ঠাকুর তখন গুরুতর অসুস্থ । বিলেতে তিনি পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছিলেন। সুশান্ত দাশগুপ্ত জানিয়েছিলেন তাদের অফিসে সময় কাটানো ও  আড্ডা দিতে আসা আশরাফ ভাই বিডিনিউজে আমার একটি লেখা পড়ে খুশি হয়েছেন খুব। যে লেখাটির শিরোনাম ছিলো : দল কাদের হাতে রেখে গেলেন আশরাফ ভাই। নাম্বার পাবার পর আমি ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করি। প্রথম দিন পাওয়া যায়নি তাঁকে। দ্বিতীয় দিনে বেশ সময় নিয়ে কথা হয়েছিল। অমন বিনয়ী মানুষ রাজনীতিতে বিরল। বিশেষত কথা শুনলেই যখন বোঝা যায় আন্তরিকতা কতটুকু। নিজেই বলেছিলেন দেশে গেলে যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। সম্ভাব্য যোগাযোগের সঠিক মাধ্যমগুলো বলে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে আশা আর কখনোই সত্য হবে না জীবনে।

ব্যক্তিগত বিষয় থাক। তাঁর এই অন্তিম যাত্রা এমন এক সময়ে যখন আওয়ামী লীগ টানা তিন বারের জন্য দেশ শাসনের দায়িত্ব পেয়েছে। বলা বাহুল্য শেখ হাসিনার একক ইমেজ আর নেতৃত্বই এর চাবিকাঠি। সঙ্গে এটাও বলব, তারা মানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যেন সেই ছবি ও কথাগুলো মনে রাখেন। যে ছবিতে শেখ হাসিনা ও আশরাফ ভাই পাশপাশি বসে দুজনে দুজনার হাত ধরে আছেন। এর নাম সখ্যতা। এই হাতধরা নির্ভরতার। ছবি দেখলেই আপনি বুঝবেন এমন নির্ভরতা বা আন্তরিকতা সবার সঙ্গে হয় না । ডাকসাইটে বা প্রভাবশালী নেতাদের কেউ সমানে বিনয় বা অতি বিনয়ে ঢলে পড়লেও এমন সম্পর্কে নাই। এটাই সমঝোতা। এটাই বিশ্বাস। যে কথাটা মনে রাখতে বলব, আশরাফ ভাই বলেছিলেন, দল  একটি অনুভূতির নাম। যে অনুভূতি রক্ত ত্যাগ আর ভালোবাসার সঙ্গে জড়িয়ে আওয়ামী লীগকে এমন জায়গায় নিয়ে এসেছে। নিজের সম্পর্কে তাঁর মৃদ ভাষণ ছিলো এই, তাঁর রক্ত পরীক্ষিত। যা কোনোকালে বেঈমানী করতে জানে না। এর চাইতে বেশি বলার দরকার পড়ে না।

চারদিকে ভয়-ভীতি আর প্রলোভনের রাজনীতি যখন সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে তখন তাঁর এই প্রয়াণ বিমর্ষের, মন খারাপের। বাংলাদেশের রাজনীতির সৌভাগ্য তাঁর মত মানুষ দলের শীর্ষ নেতা হতে পেরেছিলেন। মৃত্যু খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। জন্মের পর একটি নিয়তিই নির্ধারিত তা হলো মরণ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, জীবন বলে আমি তোমার মরণ তরী বাই। সে তরীর যাত্রী হয়ে অজানা অচেনা এক জগতে পাড়ি দিয়েছেন তিনি। আমাদের দেশে ভালো মানুষদের সৎ মানুষদের শুদ্ধ মানুষদের জীবনকে আমি বলি, অপমানের কাঁটায় ঘেরা গোলাপ জীবন। সে মান অপমান বা জয় পরাজয়ের অনেক ওপরে এখন তিনি। বলা সহজ করা কঠিন সমাজে সত্যিকার সেকুল্যার মানুষ আপনি পাবেন? এমন মানুষ পাবেন যিনি নেতা আবার জীবন যাপনে আধুনিক? নেতারাতো ভোটের সময় থেকে কত ঘটনায় ভোল পাল্টান। তিনি একবারের জন্যও তা করেননি। কারণ তিনি যা তিনি তাই। দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা যদি অপরাধ হয় তবে তিনি তাই করতেন। দলীয় কর্মীদের অন্যায় আবদার না রাখা যদি অপরাধ তো তিনি তাই করতেন। তাতে তাঁর ইমেজ বা ভাবমূর্তি কিছুই বিপাকে পড়েনি কোনো কালে।

মাটির মানুষ সৈয়দ আশরাফের তিরোধান আবারো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আশরাফ আর আতরাফের পার্থক্য। ছেলেবেলায় মা শেখাতেন, এমন জীবন তুমি করিবে গঠন/ মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন। আমরা আপনার জন্য চোখের জলে ভাসছি সৈয়দ আশরাফ।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ ডিসেম্বর ২০১৮/ইভা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়