‘বুলবুল’হারা হলো বাংলা গান
জেনিস আক্তার || রাইজিংবিডি.কম
জেনিস আক্তার : পৃথিবী থেকে পরিচিতজন চলে গেলে আমরা কষ্ট পাই কেন? কারণ তার সঙ্গে কিছু স্মৃতি হৃদয়ে গাঁথা থাকে। অমলিন সেই সুখস্মৃতি। দেশের সংগীতপ্রিয় প্রায় সবাই ইতিমধ্যে জেনে গেছেন গীতিকার, সুরকার এবং সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আর নেই। স্ট্যাটাসে স্ট্যাটাসে হোমপেইজ সয়লাব! ফেইসবুকে বইছে বিষণ্ণ বাতাস। একটা দুঃখবোধ সবাইকে তাড়া করে ফিরছে- একে একে না ফেরার দেশে চলে যাচ্ছেন জ্ঞানী-গুণীজন। এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। দেশ হারাচ্ছে তাদের সোনালি যুগের সন্তানদের। অসহনীয় এই দুঃখভার।
এই ব্যথা সকলেই অনুভব করছেন। কিন্তু আমি যে তার চেয়েও বেশি ব্যথাতুর। কারণ আমার স্মৃতির পাতা তাকে নিয়ে অনেক বেশি ভারী। তাই আমি ভারাক্রান্ত আজ। আমার কাছে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল শুধু একজন গীতিকার, সুরকার ছিলেন না, আমি তাকে ‘ইমু মামা’ ডাকতাম। আমি আজ স্নেহহারা হলাম।
২০০৮ সাল। ‘যায় যায় দিন’ পত্রিকায় পেয়িং রাইটার আমি। সেখানে রাফিদের সঙ্গে পরিচয়। বন্ধু রাফিদ ছিল ইমু মামার ব্যক্তিগত আকুপ্রেসার চিকিৎসক। রাফিদ নিজেও গান গাইত। রাফিদ তখন মামার বাসায় থাকত। ওর মাধ্যমেই আমার মামার সঙ্গে পরিচয়। পরিচয়ের আগেই এই মানুষটি সম্পর্কে আমি জেনেছিলাম। মাধ্যম ছিল তার সুর করা গান।
‘এই বুকে বইছে যমুনা
নীল অথৈ প্রেমের জল।
তার তীরে গড়বো আমি
আমার প্রেমের তাজমহল!’
অথবা:
‘গানে গানে চেনা হলো
চোখে চোখে দেখা হলো
কথা হলো না না না
এসো গানের আড়াল ছেড়ে
বসি মুখোমুখি
কাছে এসো আরো কাছে বুকের ভিতর
প্রাণে প্রাণে গড়ে তুলি স্বপ্ন বাসর।’
এমন অনেক গান দিয়ে তিনি ক্রান্তিকালে বাংলা চলচ্চিত্রকে ধরে রেখেছিলেন শুদ্ধতার পরিসরে। মনে রাখতে হবে তখন বাংলা সিনেমা অশ্লীলতায় আক্রান্ত। গানের কথা ও সুরে তার ছাপ পড়েছিল ভীষণভাবে। মামা এ ধরনের অশ্লীলতা শুধু পরিহারই করেননি, কাছের মানুষদের সচেতনও করতেন। তাকে এ নিয়ে আক্ষেপ করতেও শুনেছি। আজ মনে পড়ছে, যেদিন রাফিদ আমাকে মোবাইল ফোনে মামার সঙ্গে প্রথম কথা বলিয়ে দেয় সেদিন আমি আবেগে কাঁপছিলাম। আমার সব কথা আবেগে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। মহৎ, গুণী মানুষেরা অন্যের দুর্বলতা বুঝতে পারেন। সেদিন তিনি আমাকে সামলে নেয়ার সময় দিয়েছিলেন। আরো আপন করে নিতে জানতে চেয়েছিলেন, তুমি কি দিয়ে ভাত খেয়েছো? তার এই একটি প্রশ্নেই আমি অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছিলাম। পরিচয়ের শুরুতেই নাম। এরপর একটা সম্বোধন লাগে। তিনিই আমাকে এই স্বাধীনতা দিয়ে বলেছিলেন, কী ডাকতে চাও? আমি বলেছিলাম, মামা। তিনি খুশি হয়ে বলেছিলেন, বাহ্ দুইটা মা আমি তোমার!
এভাবেই মামার সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে ওঠে। মামা অনেক আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন। আমি রাফিদকে প্রায়ই বলতাম, একটু যত্ন করে চিকিৎসা করো, যাতে মামা আমাদের কাছে আজীবন থাকেন। ঢাকা আসার পর ২০১৩ সালের দিকে মামার একমাত্র ছেলে সামীরকে বাংলা শেখানোর দায়িত্ব পরে আমার উপর। তখন থেকে আরো বেশি করে তাকে জানতে পারি। বুঝতে পারি সন্তানের কাছে তিনি মা-বাবা দুটোই। তাকে নিয়ে আমার গর্ব আরো বেড়ে যায় যেদিন জানলাম, তিনি মাত্র ১৫ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ভাবা যায়! কি তারুণ্য, কি সাহস, কি বুদ্ধিদীপ্ত এক মানুষ!
সরকারের নির্দেশে ২০১২ সালে মামাকে যুদ্ধাপরাধীর ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় সাক্ষী হিসেবে দাঁড়াতে হয়েছিল। সাহসিকতার সঙ্গে সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়েছিলেন তিনি ১৯৭১ সালে ঘটে যাওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলখানার গণহত্যা নিয়ে। ওই গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া পাঁচজনের মধ্যে তিনি একজন। হত্যা করা হয়েছিল একসঙ্গে ৪৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে। কিন্তু এই সাক্ষ্য দেয়ার কারণে তার নিরাপরাধ ছোট ভাই মিরাজকে হত্যা করা হয়। তিনিও বিধিনিষেধের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে পড়েন। তাকে আরো একবার জানতে চাইলে উইকিপিডিয়ায় গিয়ে একনজর দেখলেই হবে। কত সম্মাননা, কত সম্মান তিনি দেশের মানুষের কাছ থেকে পেয়েছেন। অথচ এই শেষ দিনগুলোতে তার মনে ঘর বেঁধেছিল একরাশ দীর্ঘশ্বাস।
ইমু মামাকে আমি কবি হিসেবেও জানি। তার বেশ কিছু কবিতা আমার ডায়েরিতে আছে। ‘আলো দে দৌড়’ কবিতায় তিনি একজন ধর্ষিতার আর্তনাদ নিয়ে লিখেছেন। ‘ভৈরবী’ একটি নিখাঁদ প্রেমের কবিতা। প্রেম তার কাছে কেমন একথা বোঝার জন্য একটা উদাহরণই যথেষ্ট। তখন একমাত্র ছেলে সামির জন্মগ্রহণ করেছে। একদিন মামা বুঝতে পেরে স্ত্রীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তার ভালোবাসায় কোনো খাঁদ আছে কিনা? স্ত্রীর উত্তর না পেয়ে মামা বলেছিলেন, তুমি কেন লুকিয়ে অন্যকে ভালোবাসবে? আমার কাছে লুকিয়ে তোমার যদি ভালোবাসার মতো পবিত্র জিনিস রক্ষা করতে হয় তবে তো আমিই তোমার যোগ্য নই। এরপর মামা উদ্যোগি হয়ে স্ত্রীকে তার মনের মানুষের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। সেই থেকে তিনি একা জীবনযাপন করতেন। যাই হোক, এগুলো ব্যক্তিগত বিষয়। আমি এখানে মামার কাব্য প্রতিভার পরিচয় তুলে ধরতে চাই।
তিনি একটি কবিতায় লিখেছেন:
‘দেখ, আমার লাশটা নিয়ে কাড়াকাড়ি করিস না
এভাবে জড়িয়ে ধরিস না, ব্যথা লাগে তো!
আহা, এমনিতেই আমার সারা অঙ্গ ব্যথায় ভরা ছিল সমস্ত জীবন ভর।
দোহাই লাগে একটু আলতো করে ধর
শোন, আমি কিন্তু তোদের সাথে কোনো সরকারি গোরস্থানে যাব না
কবরের মাটি এনে দিবি? তাও যাব না ।
হ্যাঁ, এটাই আমার অনুরোধ।’
এই কবিতায় তিনি আরো লিখেছেন:
‘আমি শান্তির নিদ্রায় শুয়ে রব
আমার ভক্তের প্রতিটি জমিতে
আমার বন্ধুরা অনেক আদর করে শুইয়ে দেবে
কবরে ঘুমায়ে ঘুমায়ে বলব-
জানিস আমি খুব একা ছিলাম,
তাই আমার একা থাকার জায়গা আবার বেছে নিলাম।’
‘অনাগত শিশু’ নামে একটি কবিতার মূলভাব এরকম: অনাগত শিশু পেটের মধ্য থেকে মায়ের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে। মাকে সে বলছে, এখানে আমার তো কোনো ধর্ম নেই। কিন্তু পৃথিবীর আলো দেখামাত্র কেন আমাকে ধর্ম দিয়ে, নাম দিয়ে দাও? কেন এতো ধর্মের নামে হিংসা, মারামারি খুনাখুনি? আমি তো এখানে শিশু, পৃথিবীতে গেলেই কেন আমি হিন্দু হয়ে যাই, বৌদ্ধ হয়ে যাই, খ্রিস্টান হয়ে যাই, মুসলিম হয়ে যাই? ‘বুলবুল’ কবিতায় লিখেছেন:
‘তোর অহঙ্কার তোর পতনের মূল
ইন্দ্রীয় ক্ষোভ, ইমতিয়াজ বুলবুল
মাথা নিচু করে চল
নম্র-ভদ্রভাবে কথা বল
তা না হলে দুদিন পরেই প্লাবিত হবে
তোর চোখে কষ্ট প্লাবনের জল।’
এমন অনেক কবিতা তিনি লিখে গিয়েছেন। কিন্তু কোথাও প্রকাশ হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। এই সব কবিতার কথা হয়তো কাউকে তিনি বলেন নি। আমাদের মুখে মুখে শুনিয়েছিলেন। সেই শোনা কবিতা আমি লিখে রেখেছিলাম। আজ ডায়েরিটা হাতে নিয়ে আরো অনেক স্মৃতি পাতায় পাতায় আবিষ্কার করছি। ডায়েরি আজ মলিন হয়ে গেছে কিন্তু তার স্মৃতিগুলো মলিন হবার নয়। মনে হচ্ছে এই তো সেদিন! এভাবেই সময় চলে যায়, চলে যায় সবাই, একদিন আমরাও চলে যাব।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ জানুয়ারি ২০১৯/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন