ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

উন্নয়ন পরিকল্পনায় উপকূলের অগ্রাধিকার থাকুক

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৩, ২৮ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
উন্নয়ন পরিকল্পনায় উপকূলের অগ্রাধিকার থাকুক

রফিকুল ইসলাম মন্টু: লবণ পানি ফসল নষ্ট করে দেয়। কপালে হাত ওঠে চাষির! ঘূর্ণিঝড় এবং সতর্কীকরণ সংকেতের সংখ্যা অগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে জনজীবনে। ঘনঘন সতর্কীকরণ সংকেতের ফলে সমুদ্রগামী জেলেদের মাছধরা বন্ধ থাকে। ফলে তাদের রোজগারে ভাটা পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূল অঞ্চলে জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা বাড়ছে। জোয়ারে পানির উচ্চতাও বাড়ছে। আর এই প্রবণতা নদী ভাঙন বাড়িয়ে তুলছে। উপকূল অঞ্চলে এগুলো একেবারেই চেনা কিছু দৃশ্য। বছরে বছরে দেখা যায় একই চিত্র। উপকূল অবহেলিত এবং একটা সীমারেখায় বাঁধা। এ কারণে উপকূলের উন্নয়ন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় এগোচ্ছে না। অগ্রগতির ধারা থমকে পড়ছে। 

‘উপকূল’ শব্দটি কল্পনায় এলেই চোখে ভাসে শহর-নগর থেকে দূরের কোনো জনপদ। যেখানে সমুদ্র মিলেছে লোকালয়ে। নোনাজল ছুঁয়েছে মাটি। নদনদীর ভাঙাগড়ার খেলা। একপ্রান্তে ভাঙন মানুষদের নিঃস্ব করছে, আবার অন্যপ্রান্তে পলিমাটি সৃষ্টির খেলা। উত্তাল ঢেউয়ের মাঝেই জাগছে ভূখণ্ড। সীমারেখায় বন্দি বলেই এখানে ভরসা নিয়তিতে। কপালে ছিল বলেই হয়তো জন্মটা বিপন্ন জনপদের কোন এলাকায়। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ, সেও কপালের লিখন। তাইতো বিপদের মৌসুম আসার আগে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা। বিশ্বাসের ওপর ভর করে উপকূলবাসী ঝড়ের মৌসুম, মাছের মৌসুমের পূর্ব মুহূর্তে প্রার্থনায় বসেন। তারা ভালো থাকতে চান। কিন্তু ভালো থাকতে পারেন কী? উপকূলের সংজ্ঞার দিকে চোখ ফেরালেও সেই সীমারেখার বিষয়টিই সামনে আসে। তিন নির্দেশকের ওপর ভর করে উপকূল অঞ্চল চিহ্নিত করা হয়। ১. ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি; ২. জোয়ার-ভাটার বিস্তৃতি; এবং মাটি, ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততার প্রভাব। এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার ইঙ্গিত দেয়। এটাও উপকূলের সীমারেখা।

প্রান্তিকতার গন্ধ আছে বলেই হয়তো শহরও একটু অবজ্ঞার চোখে দেখে উপকূলকে। নাগরিকেরা বাঁকা চোখে তাকান। শহুরে শীতল কক্ষের পরিকল্পনা সভায় প্রান্তিক উপেক্ষিত। যেন বিপন্ন জনপদে জন্ম নেয়াই উপকূলবাসীর পাপ। সেখানে রাস্তা হবে না, কারণ সেখানকার মানুষেরা রাস্তায় হাঁটতে জানেন না। সেখানে স্কুল হবে না, কারণ সেখানকার শিশুরা একটু বড় হলেই কাজে নামবে। সেখানে চিকিৎসক প্রয়োজন নেই, কারণ সেখানকার মানুষদের অসুখ হয় না। যেন উপকূলের মানুষেরা সীমারেখার বাইরে। ওদের নেই কোনো অধিকার। অথচ হিসাবের খাতায় ওরাও এই দেশের নাগরিক। প্রতিটি ক্ষেত্রে ওদেরও আছে সমান ভাগ। 

সীমারেখার বাইরে। বলা যায় বৃত্তের বাইরে। অদৃশ্য একটা বৃত্ত হয়তো আছে, যেটা প্রান্তিককে নগর থেকে আলাদা করে দেয়। আর বিভাজনে আটকে যায় উন্নয়ন-অগ্রগতির চাকা। উপকূল কীভাবে সীমারেখার বাইরে, বা বৃত্তের বাইরে? খানিক আলোকপাত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভবন করছি। সাধারণভাবে ‘উপকূল’ শব্দটি কল্পনায় এলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক বিপন্ন-বিধ্বস্ত জনপদের চিত্র। যেখানকার মানুষের সংকটের কোন শেষ নেই। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা উপকূলকে ক্রমাগত পিছিয়ে রাখে। ভয়াল নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হয় উপকূলের অনেক স্থানে। রাস্তাঘাট নেই। অবকাঠামোগত উন্নয়ন নেই। বহু দাবির বিনিময়ে একটা বাঁধ কিংবা সড়ক জুটলেও বিধ্বস্ত হলে আর মেরামত হয় না। উপকূলের মানুষেরা এটাকেও নিয়তি হিসাবে মানেন। সীমারেখার বাইরে বলেই হয়তো উপকূলবাসীর এই পরিণতি!

বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের সীমারেখা সরকারই নির্ধারণ করে দিয়েছে। পূর্বে কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ আর পশ্চিমে সুন্দরবন। সমুদ্রতীরের এই তটরেখার দৈর্ঘ্য ৭১০ কিলোমিটার। সরকারি হিসাবে উপকূল অন্তর্ভূক্ত জেলার সংখ্যা ১৯টি। এর মধ্যে তিনটি জেলা যশোর, নড়াইল ও পোগালগঞ্জ উপকূলের প্রত্যক্ষ ঝড়-ঝাপটা থেকে অনেক দূরে। বাকি ১৬টি জেলা উপকূলের সীমারেখায় বন্দি। অর্থাৎ এই জেলাগুলোর একটি বড় অংশ বিচ্ছিন্ন-বিপন্ন জনপদ। পূর্ব-উপকূলে রয়েছে ৫ জেলা- কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও ফেনী। মধ্য-উপকূলে ৮ জেলা- বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি, চাঁদপুর ও শরীয়তপুর। এবং পশ্চিম-উপকূলে ৩ জেলা- খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা। এসব জেলার অধিকাংশ এলাকা সমুদ্রের নোনাজলের ঝাপটায় প্রতিনিয়ত ঝুঁকির মুখে থাকে। শহুরে জনপদে উন্নয়নের নানান রূপ দেখা গেলেও উপকূলের এই প্রান্তিকের চিত্রটা একেবারে উল্টো। দুর্যোগের ঝুঁকি থাকার কারণে বড় ধরণের উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হয় না। বহু এলাকায় বেড়ি বাঁধের অভাবে জোয়ারের পানিতে ভাসে বাড়িঘর। নাগরিক সেবা পাওয়া যে নাগরিকের ন্যায্য অধিকার, সে বিষয়ে উপকূলবাসীর মাঝে সচেতনতার মাত্রাও অনেক কম। ফলে নিয়তিকেই তারা বড় ভরসার স্থল বলে মনে করে।



নাগরিক সেবার সবই বৈষম্যহীনভাবে বন্টন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান, কর্মসংস্থান, অবকাঠামোসহ সব সুবিধা দেশের অন্যান্য এলাকার মতো উপকূলেও পৌঁছানোর কথা। কিন্তু এইসব ক্ষেত্রে সীমারেখা বন্দি উপকূলের চিত্র একেবারেই আলাদা। সময়মত ট্রলার না পাওয়ায় ভয়াল নদী পাড়ি দিয়ে মুমূর্ষু রোগীকে চিকিৎসকের কাছে নেয়া সম্ভব হয় না। এভাবে বহু রোগীর মৃত্যুর খবর আমার নোটবুকেই আছে। দ্বীপগুলোতে কান পেতে শুনি হাজারো মানুষের কান্না। কালেভদ্রে দু’একজন সংবাদকর্মী কাছে পেলে ওই মানুষদের আকুতির শেষ থাকে না। ঝড়-ঝাপটায় বারবার বিপন্ন মানুষ সংবাদকর্মীর খাতায় তাদের নাম লেখাতে চান। গণমাধ্যম এদের সমস্যার কথা তুলে ধরতে পারে মাত্র। কিন্তু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় দায়িত্বটা সরকারকেই নিতে হবে। কোন একটি এলাকাকে সীমারেখায় বন্দি করে রাখলে চলবে না।

আমরা জানি, পৃথিবীর অনেক দেশেই উপকূলীয় অঞ্চল নিয়ে রয়েছে ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনা। সেসব দেশের উপকূল অঞ্চল সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ এবং সবচেয়ে উন্নত। ইউএনডিপি’র হিসাবে বলা হয়েছে, পৃথিবীর মোট জনবসতির শতকরা ৪০ ভাগ সমুদ্র উপকূলের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে বাস করে। আগামী ৫০ বছরে এই হার খানিকটা বাড়বে বলেই সংশ্লিষ্টদের ধারণা। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার সঙ্গে পৃথিবীর অন্য দেশের উপকূলের একটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এদেশের উপকূলীয় এলাকা এখনও মূলত পল্লী এলাকা। এখানকার উপকূলে নগরায়নের ছোঁয়া তেমন লাগেনি। তবে কিছু কিছু স্থানে পরিবর্তনের হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। পরিসংখ্যান বলছে, সর্বশেষ আদমশুমারিতে উপকূলীয় অঞ্চলের লোকসংখ্যা ৫ কোটির কাছাকাছি। ২০০১ সালে এই সংখ্যা ছিল ছিল ৩ কোটি ৫১ লাখ; আর ১৯০১ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৮১ লাখ। এদেশে উপকূলীয় জনবসতির শতকরা ৪৯ ভাগ হচ্ছে নারী। মোট জনসংখ্যার ৪১ শতাংশের বয়সই ১৫ বছরের নিচে।

সীমারেখায় বন্দি বাংলাদেশের উপকূলে সংকট যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সম্পদ ও সম্ভাবনা। সমুদ্রতীরের জনপদ ঘিরে গড়ে উঠতে পারে বিরাট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। আর সেই সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলতে হলে উপকূল অঞ্চলকে সীমারেখার বাইরে নিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য এলাকার সঙ্গে সমান তালে উন্নয়নের গতি এগিয়ে নিতে হবে। উপকূলে জনশক্তি গড়ে তুলতে শিক্ষার মান বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। সেই সঙ্গে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। একইসঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে। উপকূলবাসী যেভাবে নিয়তি নির্ভর, ঠিক সেভাবেই শহুরে নাগরিকদের অনেকে উপকূলের প্রান্তিকতাকে বাঁকা দৃষ্টিতেই দেখেন। প্রান্তিক জনপদে জন্ম নিয়েছে বলে যেন ওখানকার মানুষেরা অধিকার হারিয়েছে। এই চিন্তা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। পরিকল্পনা প্রণয়নকারী, সরকারি সকল দপ্তর, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং গণমাধ্যম সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে উপকূলের উন্নয়নে। নীতি নির্ধারণ ও পরিকল্পনায় থাকতে হবে উপকূলের মানুষের কথা। গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত থাকতে হবে প্রান্তিকের প্রতিফলন। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাকে উপকূলের সীমারেখা ভেদ করে ছুটতে হবে বিপন্ন জনপদে। কষ্টে থাকা মানুষদের পাশে দাঁড়াতে হবে। উপকূলবাসীর জন্য সব ধরণের নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে। সামগ্রিকভাবে উপকূল অঞ্চলকে নিয়ে গ্রহণ করতে হবে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা। তাহলেই সীমারেখার বন্দিদশা কেটে গিয়ে উপকূলের অগ্রগতির চাকা ঘুরতে শুরু করবে।   



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জানুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়