ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

একটি ভাষণ অতঃপর অমর কবিতা

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৯, ৭ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একটি ভাষণ অতঃপর অমর কবিতা

অলোক আচার্য : ‘শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/ রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্তপায়ে হেঁটে/ অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/... গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর কবিতাখানি’- কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ কবিতায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ কাব্যিক নিপুণতায় চিত্রায়ন করেছেন। কবিতা! কবিতাই বটে। এর চেয়ে ছন্দময় কাব্য আর কোনো কালে রচিত হয়নি। এমন সাহস জাগানিয়া অমর শব্দমালা রচিত হয়নি কখনও।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ; সেদিন ঢাকা হয়ে উঠেছিল মিছিলের শহর। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ যে যেভাবে পেরেছে সমবেত হয়েছে রেসকোর্স ময়দানে। সমবেত লাখ লাখ মানুষ বারবার গর্জনে ফেটে পরছিল। একটি ভাষণ তাদের উদ্দীপ্ত করেছিল। তারা সেদিন নেতার মুখ থেকে যা শুনতে চেয়েছিল ভাষণে তার সবই ছিল। ফলে বাঙালি এই ৭ তারিখে পেয়ে গেল পথের দিশা, স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। এ কারণে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ আমাদের জন্য সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভাষণ; ঐতিহাসিক এক মহাকাব্য। ফলে এটি শুধু আর ভাষণ নেই, হয়ে উঠল এক অমরগাঁথা। ভাষণটি সেদিন এতোটাই উদ্দীপ্ত করেছিল যে, বাঙালির অন্তরে ঠাঁই করে নিয়েছে চিরকালের জন্য। চোখ বুজলেই যেন সেদিনের সেই জনসমুদ্র, বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভীত কাঁপিয়ে দেয়া বজ্রকণ্ঠ শুনতে পাই। কবি নির্মলেন্দু গুণ তাই বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে ‘অমর কবিতা’ বলেছেন। পশ্চিমা বিশ্ব তাকে বলেছে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’।

বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। এই দিনটি বাঙালি জাতির জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এই দিনটির জন্য মুক্তিকামী মানুষ অপেক্ষায় ছিল। প্রিয় নেতার মুখ থেকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা, ভয় ও শঙ্কার বাইরে এসে সর্বোচ্চ প্রতিরোধ করার মূলমন্ত্র পাওয়ার জন্য ছিল প্রতীক্ষা। ২৫ মার্চ নিরস্ত্র বাঙালি আক্রান্ত হওয়ার পর সশস্ত্র প্রতিরোধের স্পৃহা এসেছিল বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ থেকে। আজও যখন টিভি পর্দায় সেই দিনের কোনো ভিডিও চিত্র দেখি রক্তে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করি।  ভাষণটি অসংখ্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। লেখক, ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ড-এর বিশ্বসেরা ভাষণ নিয়ে লেখা ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচ দ্যাট ইনস্পায়ার্ড হিস্টোরি’ গ্রন্থে এই ভাষণ স্থান পেয়েছে। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর এই ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো। ডকুমেন্টারি হেরিটেজ হলো সেই সব নথি বা প্রামাণ্য দলিল, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যার ঐতিহ্যগত গুরুত্ব রয়েছে। আর সেসব ঐতিহ্যের তালিকা হলো ‘মেমোরি অফ দি ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার।’ এসব দলিল সংরক্ষণের পাশাপাশি বিশ্বের মানুষ যাতে এ বিষয়ে জানতে পারে সেজন্য ১৯৯২ সালে এ কর্মসূচি শুরু করে ইউনেস্কো। গবেষকরা বলছেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর সার্বজনীনতা এবং মানবিকতা। এই ভাষণ যে কোনো নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য অনুপ্রেরণাদায়ী হিসেবে কাজ করে। এই ভাষণ একটি জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছে। এই ভাষণ একটি দেশের সব মানুষকে একসঙ্গে শত্রুর মোকাবেলা করার সাহস যুগিয়েছে। লাখ লাখ মানুষের মনে যে বিশ্বাস, যে চাওয়া, যে আকাঙ্খা ছিল বঙ্গবন্ধু সেদিন সে কথাই তাদের শুনিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমন এক সময় এই ভাষণ দিয়েছিলেন যখন প্রতিটি পদক্ষেপে তার জন্য বিপদ অপেক্ষা করছিল। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তাকে ভাষণ দিতে হয়েছিল। ইতিহাসে এ কারণে তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ নেতা হিসেবে বিবেচিত। ভাষণটি বিশেষজ্ঞরা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। এত দিকের সমন্বয়, এত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চেতনা পৃথিবীর আর কোনো ভাষণে আছে কি না জানা নেই। তিনি তার ভাষণে বাংলার নিপিড়ীত মানুষের শোষণ ও বঞ্চনার কথা তুলে ধরেন, অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেন, গণতান্ত্রিক চেতনার কথা বলেন এবং সবশেষে বলেন প্রতিরোধের কথা। মুক্তি যার মূল লক্ষ্য। উত্তাল জনসমুদ্র যখন স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তখন বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন তার চূড়ান্ত নির্দেশ: ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে প্রতিরোধের ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ সেদিন চূড়ান্তভাবে সংগঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল স্বাধীনতার জন্য। অথচ আমাদের হাতে তখন কোনো অস্ত্র ছিল না। কিন্তু মনোবল ছিল অসীম। অসাধারণ দেশপ্রেমে জাতি বিজয় ছিনিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর ছিল সেদিন। এর পেছনে ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। ফলে এই ভাষণ এক অনুপ্রেরণার নাম, উদ্দীপনার নাম।

লেখক : সাংবাদিক ও কলাম লেখক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ মার্চ ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়