ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নায়িকাদের সংগ্রাম আছে সম্মান নেই

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৫, ৮ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নায়িকাদের সংগ্রাম আছে সম্মান নেই

‘মডেল গার্ল’ ও ‘লাগাও বাজি’ সিনেমার দৃশ্য

রাহাত সাইফুল : আজ বিশ্ব নারী দিবস। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে দিনটি। নারী-পুরুষের সমান অধিকারের কথা আমরা মুখে বলি। কিন্তু সমাজের দর্পণ চলচ্চিত্রাঙ্গনে নারী বৈষম্যের শিকার। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এই বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। চলচ্চিত্রে নারীরা কি সমান সুবিধা পাচ্ছেন? নারী দিবস এলেই এমন প্রশ্ন মনে নাড়া দেয়।

চলচ্চিত্রের নায়িকা যেন পুরো সমাজের নায়িকা। রুপালি পর্দায় নিজে অন্যায় করেন না, অন্যের করা অন্যায়কে তিনি প্রশ্রয়ও দেন না। তবে বাস্তব জীবনে অনেক অন্যায়ের সঙ্গে তাকে আপোস করতে হয়। এমন উদাহরণ অনেক পাওয়া যাবে। দর্শকদের আর্কষণ করার মোহনীয় ক্ষমতা থাকে নায়িকাদের। মিষ্টি মুখের হাসি দিয়ে হাজারো দর্শক হৃদয় জয় করতে পারেন তারা। দর্শক মনে করেন, নায়িকাদের বাহ্যিক সৌন্দর্যের মতো মনটাও সুন্দর। নায়িকার নাম শুনেই প্রেক্ষাগৃহে ভিড় জমান সিনেমাপ্রেমীরা। অনেক সময় হল মালিকগণ নায়িকার নামের উপর সিনেমা বুকিং দিয়ে থাকেন। এই দিক থেকে চলচ্চিত্রে নারীর গুরুত্ব কম নয়। এ তো মুদ্রার এ পিঠ। মুদ্রার অপর পিঠে নারী শিল্পী তথা নায়িকাকে অনেক বিভীষিকাময় পথ পাড়ি দিয়ে সুপারস্টার হতে হয়। তাদের এই যুদ্ধের গল্প হয়তো ভক্তদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না।

বর্তমানে অধিকাংশ নায়িকা হওয়ার গল্পগুলো প্রায় একই রকম। তবে ধনীর দুলালীদের জন্য নায়িকা হওয়ার গল্পটা একটু সহজ। কারণ তাদের কাঠখর পোড়াতে হয় না। বাবার টাকায় সিনেমা প্রযোজনা করে খুব সহজেই নায়িকা বনে যান। তবে বাবা অথবা বয়ফ্রেন্ডের টাকায় নায়িকা হয়ে খুব বেশি দিন চলচ্চিত্রে টিকেছেন এমন নজির নেই বললেই চলে। অতীতের দিকে তাকালে দেখা যাবে এক্সট্রা শিল্পী থেকে কিংবদন্তি অভিনেত্রী হয়েছেন শাবানা। তিনি অভাবের তাড়নায় নয়, চলচ্চিত্রকে ভালোবেসে এক্সট্রা হিসেবে এ অঙ্গনে পা রেখেছিলেন। ১৯৬২ সালে ৯ বছর বয়সে ‘নতুন সুর’ সিনেমায় শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন। ১৯৬৩ সালে ‘তালাশ’ সিনেমায় নৃত্যশিল্পী এবং ‘আবার বনবাসে রূপবান’, ‘ডাকবাবু’সহ বেশকিছু সিনেমায় এক্সট্রা হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৭ সালে ‘চকোরী’ সিনেমার মাধ্যমে নায়িকা হিসেবে যাত্রা শুরু তার। এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় অভিনেত্রী অঞ্জু ঘোষ। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমার নায়িকা তিনি। তার প্রকৃত নাম অঞ্জলি ঘোষ। তিনিও যাত্রা দলের নৃত্যশিল্পী থেকে জনপ্রিয় নায়িকা হয়েছেন। স্বাধীনতার আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভোলানাথ অপেরা যাত্রা দলে নৃত্য পরিবেশন করতেন এবং গাইতেন এই নায়িকা। ১৯৭২ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের মঞ্চনাটকে জনপ্রিয়তা ধরে রেখে অভিনয়ও করেছেন। ১৯৮২ সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা এফ কবির চৌধুরীর ‘সওদাগর’ সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে পা রাখেন তিনি। এরপর ঢালিউডে প্রায় অর্ধ শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করে তারকা হয়ে ওঠেন অঞ্জু ঘোষ। ১৯৮৯ সালে অঞ্জু অভিনীত ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ মুক্তির পর আকাশচুম্বি দর্শকপ্রিয়তা পায়। এরপরই অঞ্জুর দর্শক চাহিদা দুই বাংলায় সমানভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। দুই বাংলার দর্শকপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। এক্সট্রা থেকে নায়িকা হয়েছেন এমন নজির ঢাকাই চলচ্চিত্রে আরো অনেক রয়েছে।

তবে বর্তমান প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। এখন আর কেউ অভিনেত্রী হতে আসেন না। সরাসরি নায়িকা হতে আসেন। তাই মঞ্চ বা এক্সট্রা শিল্পী হতে হয় না তাদের। সারাসরি নায়িকা হওয়ার জন্য কেউ কেউ যেকোনো কিছুর বিনিময় করতেও প্রস্তুত। এতে করে কেউ কেউ সফল হচ্ছেন, আবার কেউ হচ্ছেন প্রতারিত। তবে বিনিময়ের জায়গা থেকে নায়করা একদমই নিরাপদ। নতুন মুখের সন্ধানের মতো প্রতিযোগিতা নেই বলেই, নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে চলচ্চিত্রের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয় নবাগতাদের। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিষয়টি পরিবার স্বাভাবিকভাবে নেয় না। চলচ্চিত্রের পরিচালকের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে সব কিছু ঠিকই থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় বৈঠকে বিনিময়ের শর্তে অনেক নবাগতাকেই সিনেমা থেকে সরে দাঁড়াতে হয়। এভাবে কয়েক পর্যায়ে মিটিং করলেও তাদের অনেকেই একই ধরনের শর্তের কারণে মানসিকভাবে হতাশ হয়ে পড়েন।  অনেকে আবার সব শর্ত মেনে নিয়েই চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। সবাইকেই যে এমন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে চলচ্চিত্রে আসতে হয় আমি তা বলছি না। এরপর সংবাদ মাধ্যমগুলোতে খবরও প্রকাশ পায় নতুন নায়িকার। কিন্তু দুইদিন না যেতেই শোনা যায়- অজানা করণে সিনেমা থেকে বাদ পড়েছেন নায়িকা কিংবা নায়িকা নিজেই সরে দাঁড়িয়েছেন। এসব কারণ খুঁজতে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জানা যায়, অনৈতিক কাজের কারণেই সিনেমার কাজ শেষ হয় না। একটা সময় এই বিভীষিকাময় অবস্থা থেকে সরে দাঁড়াতে চেয়েও অনেকে পারেন না। এভাবেই যুদ্ধ করে একজন নায়িকা চলচ্চিত্রে কাজ করেন। উচ্চশিক্ষিত অনেক নারী চলচ্চিত্রে আগ্রহী হলেও এসব আপত্তিকর শর্তের কারণে তারা আর অগ্রসর হন না। এমন উদাহরণও কম নেই।

হলিউড, বলিউডসহ ঢালিউডেও কাস্টিং কাউচের শিকার হতে হয় নারী শিল্পীদের। অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়ে শুটিং স্পটে কিংবা অন্য কোথাও নায়িকাদের ওপর পরিচালক-প্রযোজকদের লোলুপ দৃষ্টির বিষয় বিভিন্ন সময় শোনা যায়। কিছুদিন আগে বলিউডে ‘মি টু’ ঝড় উঠেছিল। ‘মি টু’-এর মতো ঘটনা বাংলাদেশেও কম হয় না। কিন্তু অন্তরালেই এ সব ঘটনা চাপা পড়ে থাকে। এছাড়াও শুটিং সেটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী শিল্পীদের পোহাতে হয় ভয়াবহ বিড়ম্বনা। আবার সিনেমার সঙ্গে জড়িত নারীদের বাঁকা চোখে দেখে সমাজ। সে হিসেবে বলা যায়, এখনো নারীরা তার সঠিক প্রাপ্য বুঝে পাননি। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থার কারণে সিনেমায় নারীদের জন্য সমস্যা রয়েই গেছে। অশ্লীলতার দায়ে কথা শুনতে হয় নায়িকাদেরই। অথচ সিনেমার পরিচালক কিংবা প্রযোজকই অধিক লাভের আশায় চাপ সৃষ্টি করে এসব করিয়ে থাকেন। এমনো ঘটেছে শুটিং সেটে পিস্তল ঠেকিয়ে অভিনেত্রীকে ছোট পোশাক পরিধান করতে বাধ্য করা হয়েছে। আবার কাটপিস বসিয়েও কোনো কোনো অভিনেত্রীর চরিত্রে কালিমা লেপন করা হয়েছে। ঢাকাই চলচ্চিত্রে নব্বই দশকের শেষের দিকে এমন ঘটনা বেশি ঘটেছে। তখন নোংরা চরিত্রে অভিনয় করে আলোচনায় এসেছেন নায়িকারাই। তবে এদের বিপরীতে যে নায়ক অভিনয় করেছেন, তারা এ অপবাদ থেকে অনেকটা মুক্ত। এদের মধ্যে কেউ কেউ সুপারস্টার খ্যাতি নিয়ে এখনো অভিনয় করছেন। এসব নোংরা সিনেমার নির্মাতারাও এখন সিনেমা নির্মাণ করে যাচ্ছেন। কেবল হারিয়ে গেছেন তাদের নায়িকারা। কেন এই অসমতা? বদনামের ভাগ কেন সবার সমান নয়? কবে সমতায় ফিরবে সিনেমার নারীরা?

এক শ্রেণির দর্শক আকৃষ্ট করতে সিনেমার পোস্টারেও নায়িকার অশ্লীল ছবি সেঁটে দেওয়া হয়। এসব পোস্টার একজন নারী অভিনেত্রীর সম্মানহানী ঘটায়। এ ছাড়া নানা স্ক্যান্ডাল রটনা-ঘটনা তো রয়েছেই। যাতে কেবল নারীদেরই হেনস্তা হতে হচ্ছে পদে পদে। এসব বাজে সংস্কৃতির পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। এতটা যুদ্ধ ও অবহেলার পর একজন নারী শিল্পী কতটা মূল্য পাচ্ছেন?  একজন নায়িকা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে খুব বেশি দিন টিকেও থাকতে পারছেন না। এর কারণ নানাবিধ। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিয়ে করে সংসারী হওয়া। বিয়ের পর সাধারণত স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির লোকের আপত্তি থাকে। এছাড়া তারা ফিটনেস ধরে রাখতে ব্যর্থ হন। স্বাভাবিক কারণেই ক্যারিয়ারের ৫-৭ বছরের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছেন জনপ্রিয় নায়িকারা।

নারী শিল্পীদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হলে ঢাকাই চলচ্চিত্রে মেধাবী নারীদের আগমন বাড়বে। নির্মাণ হবে কালজয়ী চলচ্চিত্র। নারী-পুরুষ অসমতা দূর করে ঢাকাই সিনেমা এগিয়ে যাক। নারীদের সম্মানের জায়গাগুলো আরো বিস্তৃত হোক। নারীকেন্দ্রীক সিনেমা নির্মাণ বৃদ্ধি পাক। বেগম রোকেয়ার নারী জাগরণের স্পর্শে দশ দিক হোক আলোকিত।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ মার্চ ২০১৯/রাহাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়