ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

রক্তাক্ত আইডি কার্ড ও অপ্রতিরোধ্য সড়ক দুর্ঘটনা

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১১, ২০ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রক্তাক্ত আইডি কার্ড ও অপ্রতিরোধ্য সড়ক দুর্ঘটনা

অলোক আচার্য: বিইউপি’র (বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস) ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় বেপরোয়া গতির বাসের ধাক্কায় নিহত হয়েছেন। কেউ একজন আবরারের বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্তাক্ত আইডি কার্ডটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেছেন। আবরার কেবল ভালো ছাত্র ছিলেন না, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় তিনি মেধার স্বাক্ষর রাখতেন।ঠিক এই দিনেই দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও কয়েকজন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। আবরার জানতেন জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হতে হয়। কিন্তু তিনি জানতেন না এই নিয়ম অনেক চালক জানলেও মানেন না। চালকের কাছে এসব নিয়ম মেনে চলার চেয়ে প্রতিযোগিতা করে আগে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ। তাতে কারও প্রাণ গেলেও তার কিছু যায় আসে না।

এই ঘটনার পর ছাত্ররা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। নব নির্বাচিত মেয়র তিন মাসের মধ্যে সেখানে একটি ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করার অঙ্গীকার করেছেন। কিন্তু তাতে কি আদৌ সমাধান হবে? অন্য কোথাও আবার দুর্ঘটনা ঘটবে। আবার কোন আবরারের প্রাণ যাবে। বেপরোয়া গতিতে চলা যানবাহনের লাগাম টেনে ধরবে কে? ছাত্রছাত্রীরা মেয়রের কাছে লিখিতভাবে ১২ দফা দাবি পেশ করেছে। রাজধানীতে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী মারা যাওয়ার ঘটনা মানুষের মনে এখনও জ্বলজ্বলে ক্ষত তৈরি করে রেখেছে। সেই ক্ষত মুছে যাওয়ার আগেই একই ধরনের ঘটনা আবারও ঘটল। বাসচালক আরেক বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাস চালাতে গিয়ে সেই দুর্ঘটরনা ঘটিয়েছিল। ঘটনাস্থলেই দুজন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছিল। এরপর বহু ঘটনা ঘটে গেল। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করলো। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই রাস্তায় নেমে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল কিভাবে নিয়ম মেনে চলতে হয়। দেশের কর্তাব্যক্তিরা প্রশংসাও করেছিলেন তখন। শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলনকে ভিন্নখাতে নেয়ারও চেষ্টা করেছিল একটি মহল। ছাত্রছাত্রীর ঘাড়ে চরে নিজের ফায়দা আদায় করতে চেয়েছিল তারা। ছাত্রছাত্রীরা তাদের সে সুযোগ দেয়নি। তারা ঠিকই ক্লাসে ফিরেছিল। তবে তাদের সেই দাবিগুলো আজও পূরণ হয়নি। এবারো দেখলাম একটি বাসে আগুন দেয়ার সময় ছাত্রছাত্রীরা দুবৃত্তদের হাতেনাতে আটক করেছে। বাসে আগুন দিয়ে ছাত্রছাত্রীর ওপর ওরা দায় চাপাতে চেয়েছিল। ছাত্রছাত্রীরা এবারো ক্লাসে ফিরবে। কিন্তু বুকে থাকবে বন্ধুকে হারানোর দগদগে ক্ষত। যে ক্ষত কোনো প্রতিশ্রুতিতে মুছবে না। প্রয়োজন কেবল সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো।

প্রতিদিন অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটছে। উন্নত দেশেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু আমাদের দেশে যেভাবে প্রতিদিন পাখির মতো মানুষ সড়কে মারা যায় সেরকম কোনো দেশে হয় কিনা জানা নেই। উন্নত দেশে সড়ক দুর্ঘটনা মানেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাইভেট গাড়ি দুর্ঘটনা। বাসও দুর্ঘটনার কবলে পরে, তবে তার সংখ্যা অনেক কম। আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা মানে বাস, ট্রাক, নসিমন এসব। গত বছর বুলগেরিয়ায় বাস দুর্ঘটনার ঘটনায় সেই দেশের তিন মন্ত্রীকে বরখাস্থ করা হয়েছে। অনেকেই বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন। সেই মন্ত্রীত্রয় তাদের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে নিয়েছেন। তার অর্থ এই নয় যে, আমি বলতে চাইছি, আমাদের দেশেও সড়ক দুর্ঘটনার দায় নিয়ে পদত্যাগ করতে হবে। পদত্যাগে সমাধান হবে বলে আমি মনে করি না। উন্নত দেশগুলোর আইন এবং তার প্রয়োগ, সেইসঙ্গে জনসচেতনতা একরকম, আমাদের দেশের আইন এবং তার প্রয়োগ, জনসচেতনতা আলাদা। চাইলেই আমরা সব বদলে ফেলতে পারি না। তবে চাইলেই মানসিকতা বদলাতে পারি। যেমন নিজের ভুল স্বীকার করার অভ্যাস।সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো কি অসম্ভব একটি কাজ? মোটেই তা নয়। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা একটি গাণিতিক হিসাব মাত্র। অনুভূতিগুলো আজ মৃত। নিরাপদ সড়ক চাই এর এক তথ্য মতে- গত বছর সারা দেশের সড়ক দুর্ঘটনায় সাড়ে সাত হাজার মানুষ নিহত হয়েছে এবং প্রায় ১৬ হাজার মানুষ আহত হয়েছে। দুর্ঘটনার ধরনই বলে দেয় এজন্য দায়ী কারা। দুই বাসের প্রতিযোগিতায় কারো প্রাণ যাচ্ছে, কারো পা যাচ্ছে, কারো-বা হাত। সত্যি বাসগুলোর বড় তাড়া! আগে গেলে যাত্রী বেশি। আর বেশি যাত্রী মানে লাভ বেশি। সব কিছুতেই হিসাব। কেবল মানুষের হাত, পা বা জীবনের কোনো হিসাব থাকে না।

কোথাও আবার বাসের ধাক্কায় আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসার ব্যবস্থা না করেই ছুড়ে ফেলে দেয়া হচ্ছে পুল থেকে। যাতে সে সুস্থ হয়ে বেঁচে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপে না যায়। দিনের পর দিন এসব মেনে নেয়া যায় না। আমাদের দেশে যারা মহাসড়কে বা অন্যান্য সড়কে যানবাহন চালান তাদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা কম। গাড়ি চালানোর সঠিক সাইড, গতি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি বিষয়গুলো তারা জানেন না বললেই চলে। আবার জানলেও আইনের ফাঁক খুঁজে তার ঠিক নিজেকে বের করে নেন। ফলে এত এত দুর্ঘটনা ঘটলেও শাস্তির খবর খুব বেশি পাওয়া যায় না। অথচ চালকের ভুলেই কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটার হার বেশি। কিন্তু শাস্তির ক্ষেত্রে তা লঘু অপরাধে পরিণত হয়।

সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো কিন্তু আমরা প্রায় সবাই জানি। সড়ক মহাসড়কে ক্রটি ও বিপজ্জনক মোড়গুলো কমিয়ে আনা, লাইসেন্সবিহীন সহকারীদের হাতে স্টিয়ারিং তুলে দেয়া থেকে বিরত থাকা, চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, সচেতনামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা, আইনের আধুনিকায়ন করা ইত্যাদি অনেক কার্যক্রম হাতে নেয়া যেতে পারে। তবে সব কথার বড় কথা নিজেকে তৈরি করা। যাত্রী হিসেবে আমি যেমন রাস্তায় চলাচলের আইন মানতে বাধ্য, ঠিক তেমনি একজন চালক হিসেবেও যেন কেউ আইন সঠিকভাবে মেনে চলে। উন্নত বিশ্ব যদি সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে পারে, তাহলে আমরা পারবো না কেন? দুর্ঘটনা ঘটার পর কার দোষ ছিল, কার ছিল না এসব না ভেবে দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সেটা চিন্তা করাই ভালো। কারণ দুর্ঘটনা ঘটার পর সেই দায় আর কেউ নিতে চায় না। চালকদের প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। সবচেয়ে বড় কথা হলো আইনের পাশাপাশি নিজেদের আইন মেনে চলার অভ্যাসটাও করতে হবে। আমাদের দেশটা বুলগেরিয়া নয়। এদেশে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। সহসাই এই হার কমবে বলে মনে হয় না। আমরা কারো পদত্যাগ বা বরখাস্ত চাই না। চাই সমাধান। আবরার আহমেদের মতো কারও প্রাণ যেন অকালে আর ঝরে না যায়।  

লেখক: সাংবাদিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ মার্চ ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়