ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অস্তিত্ব সংকটে সুন্দরবনের হরিণ

খায়রুল বাশার আশিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০৪, ৮ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অস্তিত্ব সংকটে সুন্দরবনের হরিণ

খায়রুল বাশার আশিক : ২০১৭ সালের ৯ এপ্রিল, দিনটি ছিলো রবিবার। বরগুনা জেলার পাথরঘাটা সাগরের মোহনায় রুহিতা চরে খুব সকালে একটি গুলিবিদ্ধ হরিণের মৃতদেহ খুঁজে পান স্থানীয় মানুষ। তারা দেখেন, শরীরের পেছন দিকে বন্দুকের গুলি লাগা অবস্থায় চিত্রা হরিণটির মৃতদেহ  বালুচরে আটকে আছে। স্থানীয় জনগণ এবং বন বিভাগের কর্মকর্তারা ধারণা করেছিলেন, বলেশ্বর নদীর অপর তীরে সুন্দরবনে হরিণটি কোনো শিকারি দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়ে নদীতে পড়লে ভাসতে ভাসতে রুহিতার চরে এসে আটকে গেছে। এমন দৃশ্য চরবাসীর জন্য নতুন নয়। এভাবেই প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছে সুন্দরবনের হরিণ।

কথায় আছে ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’ অর্থাৎ হরিণের নিজের শরীরের মাংসই যেন তার নিজের শত্রু। প্রাচীন এই কবি-কথা প্রবাদে পরিণত হলেও তা আজ বাস্তব সত্য। হরিণের মাংসের প্রতি মুখিয়ে থাকেন  ভোজন রসিকের দল। ভোজন রসিকদের চাহিদা মেটাতে সৃষ্টি হয়েছে অর্থলোভী হরিণ পাচারকারী চক্র।  পাচারকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আর্থিক ফায়দা নিচ্ছেন কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা। আর এভাবেই ঝুকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম প্রাণী ‘হরিণ’। বাংলাদেশের সবুজ মানচিত্রে সুন্দরবনেই হরিণের সবচেয়ে বড় উন্মুক্ত বসতি। সুন্দরবন ছাড়াও ভোলার মনপুরা ও নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপ, বরগুনার টেংরাগিরি ও হরিণঘাটা, গাজীপুর, সিলেটের গভীর বনাঞ্চল, চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের পাহাড়ি অঞ্চলসহ কিছু কিছু বনাঞ্চলে উন্মুক্ত হরিণ এখনও মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে। তবে হরিণ শিকারীর চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা আর কত দিন বেঁচে থাকতে পারবে এই সন্দেহ থেকেই যায়। ছোট হরিণগুলোও রেহাই পাচ্ছে না শিকারীদের লোভের ফাঁদ থেকে। এর মধ্যে অবাধ হরিণ শিকারের সুবিধায় রয়েছে সুন্দরবন।

বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, শরণখোলা, মোড়লগঞ্জ, মংলা, বাগেরহাট, খুলনা, রামপাল, পাইকগাছা, কয়রা, দাকোপা, বটিয়াঘাটা, ডুমুরিয়া, শ্যামনগর ও সাউদখালী অঞ্চলে বছরজুড়ে চলে হরিণ শিকারের মহা-উৎসব। এর মধ্যে সুন্দরবনসংলগ্ন মোড়লগঞ্জ ও শরণখোলাতে সবচেয়ে বেশি হরিণ শিকার করা হয়। এরপরের অবস্থানেই রয়েছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ, ভেটখালী, কৈখালী, যতিন্দ্রনগর, মরাগাং এলাকা। এসব এলাকায় বন্য হরিণগুলো বাঘের থাবা থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারলেও শিকারীদের ফাঁদ থেকে রেহাই পায় না। হরিণ শিকার সুন্দরবন অঞ্চলে একটি আর্থিক লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। কারণ, খুব সহজেই হরিণের মাংসের গ্রাহক পাওয়া যায়। হরিণের চামড়া উচ্চ মূল্যে বিক্রি হয়। এর মাথা ও শিং ঘরের দেয়ালে শোভা পায় কারুপণ্য হিসেবে। ফলে মাথা ও শিং উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে। এর মাংস ছয়শ টাকা কেজি দরেও কিনতে দ্বিধাবোধ করেন না ভোজন বিলাসীরা।



হরিণ শিকারীদের রয়েছে একটি চক্র। চক্রে আছেন এলাকার প্রভাবশালীরা। হরিণ শিকারী আটক হলে তাদের মুক্ত করে আনার সব দায়িত্ব নেন তারা। এছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা ও কথিত জনপ্রতিনিধিরাও রয়েছেন চক্রের কেন্দ্রে। শরণখোলা রেঞ্জের একাধিক গ্রামবাসীর সাথে কথা বলে দেখা যায়, এসব বিষয়ে সুন্দরবনসংলগ্ন গ্রামবাসীরা যেন মুখ খুলতেই রাজি নয়। আর যারা একটু-আধটু মুখ খুলছে তারাও নাম প্রকাশে রাজি হয় না। ফলে সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে সংবাদ মাধ্যমগুলোও নাম প্রকাশ করতে পারছে না পেছনের গড ফাদারদের। প্রতিবছর রাশ পূর্ণিমার সময় সুন্দরবন ঘিরে চলে হরিণ নিধনের উৎসব। রাশ পূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত মেলাকে কেদ্র করে হরিণ শিকারীরা প্রস্তুতি নেয়। রাশ মেলা শুরু হওয়ার ৮-১০ দিন আগেই বন রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে হরিণ শিকারীরা প্রবেশ করে বনের অভ্যন্তরে। এ সময় তারা মাছ ও কাকড়া ধরার অনুমতি নিয়ে বনের মধ্যে প্রবেশ করে ফাঁদ পেতে আসে। রাশ মেলা শুরু হলে তীর্থ যাত্রীদের সঙ্গে এসব শিকারীরাও মিশে যায়। তারা রাশ মেলার আনন্দে মেতে থাকা দর্শনার্থী ও নিরাপত্তাকর্মীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আগেই রেখে আসা সেসব ফাঁদ দিয়ে শুরু করে হরিণ নিধন। জানা যায়, সাধারণত হরিণ ধরতে প্রায় দেড় থেকে দুইশ হাত দড়ি বা কাচির ফাঁদ পাতা হয় বনে। হরিণ শিকারে ব্যবহৃত হয় বিশেষ নৌকা। নৌকাগুলোতে মাটির মাইটের তলায় আল্টা বানিয়ে বা খাবার পানির ড্রাম নৌকার নিচে বেঁধে এসব ফাঁদে ব্যবহৃত উপকরণগুলো পরিবহন করা হয়। বনের কাঙ্ক্ষিত স্থানে প্রবেশ করেই তৎক্ষণিক এগুলোকে প্লাস্টিকের বস্তায় ঢুকিয়ে গভীর জঙ্গলে মাটির মধ্যে পুতে রাখা হয়।

সাধারণ গ্রামবাসী মনে করেন, হরিণের চোরা কারবারি ও মাংস ব্যবসায়ীদের নামের তালিকা পুলিশ বা প্রশাসনের নিকট থাকলেও সেসব শিকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না প্রশাসন। এসব শিকারী ও মাংস ব্যবসায়ীগণ বনবিভাগ ও থানা প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে প্রশাসন দেখেও যেন না দেখার ভাণ করে যাচ্ছে। আর সচেতন মহলের দাবি, বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে সুন্দরবনের অভয়ারণ্যে চোরা শিকারী ও জেলে বাওয়ালিদের যাওয়ার সুযোগ করে দেয়ায় ফলে সুন্দরবনের হরিণ আজ হুমকির মুখে। তবে বনবিভাগের দাবি, শিকারীদের বিরুদ্ধে তাদের অভিযান সর্বদা চলমান থাকে। আর উৎকোচ গ্রহণের বিষয়টি একেবারে মিথ্যা।

শুধুই কি শিকার? শিকারীদের কালো থাবা ছাড়াও নানা কারণে হুমকির মুখে রয়েছে সুন্দরবনের হরিণ। আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট খাদ্য ঘাটতি, বনাঞ্চলের আয়তন কমে যাওয়া এবং চিত্রা হরিণের প্রধান খাদ্য কেওড়া পাতা লবণাক্ততার কারণে দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাবার ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে হরিণের বংশ বিস্তার। ইতিমধ্যেই কুমির ও বাঘের আক্রমণ, ঝড় জলোচ্ছ্বাস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বনভূমি উজারসহ অনেক কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে পৃথিবী থেকে বিলুপ্তপ্রায় মায়াবি চিত্রল হরিণ।

বাংলাদেশের স্বার্থে সুন্দরবন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় এখনি উদ্যোগী না হলে আগামীর সুন্দরবন থেকে বাঘের মতই বিলুপ্তির পথে যেতে পারে হরিণ নামক প্রাণীটিও। এ বিষয়ে সরকারের কঠোর অবস্থানের পাশাপাশি জনমহলে সচেতনতা সৃষ্টি জরুরি বলে মনে করি।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়