ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ ১৯ মার্চ

আ.ক.ম মোজাম্মেল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৮, ১৯ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ ১৯ মার্চ

আজ ঐতিহাসিক ১৯ মার্চ। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গাজীপুরের (সেই সময়ের জয়দেবপুর) বীর জনতা গর্জে উঠেছিল এবং সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল । মনে পড়ে মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলিতে বাঙালি জাতির এক অবিস্মরণীয় গণ-অভ্যুত্থানের কথা। ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ দুপুরে হঠাৎ এক বেতার ভাষণে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেন। একথা শোনামাত্র সারা দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদ মুখর হয়ে এ ঘোষণার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে। দেশের সর্বত্রই স্লোগান ওঠে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা,বাংলা-বাংলা’, ‘তোমার আমার ঠিকানা ,পদ্মা- মেঘনা- যমুনা’, ‘তুমি কে? আমি কে? বাঙালি বাঙালি’।

বঙ্গবন্ধু ঢাকায় পূর্বানী হোটেলে এক সভায় ইয়াহিয়ার ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং ঢাকায় ২ মার্চ এবং সারা বাংলাদেশে (তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান) ৩ মার্চ হরতাল আহবান করেন এবং ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা আহবান করেন।

জয়দেবপুরে (আজকের গাজীপুর) আমার পরামর্শে ২ মার্চ রাতে তৎকালীন থানা পশুপালন কর্মকর্তা আহম্মেদ ফজলুর রহমানের সরকারি বাসায় তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব মো. হাবিব উল্ল্যাহ এক সর্বদলীয় সভা আহবান করেন। সভায় আমাকে (আ.ক.ম মোজাম্মেল হক) আহবায়ক করে এবং মেশিন টুলস্ ফ্যাক্টরির শ্রমিক নেতা জনাব নজরুল ইসলাম খানকে কোষাধ্যক্ষ করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট এক সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সদস্য হন সর্ব জনাব আয়েশ উদ্দিন, মো. নুরুল ইসলাম (ভাওয়াল রত্ন), মো. আ. ছাত্তার মিয়া (চৌরাস্তা) থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম হজরত আলী মাস্টার (চৌরাস্তা), মো. শহীদ উল্ল্যাহ বাচ্চু (মরহুম), হারুন-অর-রশিদ ভূঁইয়া (মরহুম), শহিদুল ইসলাম পাঠান জিন্নাহ (মরহুম), শেখ আবুল হোসেন (শ্রমিক লীগ), থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. সাঈদ বকস্ ভূঁইয়া (মরহুম)। কমিটির হাই কমান্ড (উপদেষ্টা) হন জনাব মো. হাবিব উল্ল্যাহ (মরহুম), শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা এম এ মুত্তালিব এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নেতা বাবু মনিন্দ্রনাথ গোস্বামী (মরহুম)।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার পূর্বেই আমরা এ কমিটি গঠন করেছিলাম। পেছনের ইতিহাস এই যে, আমি ১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’-এর সাথে সম্পৃক্ত হই। নিউক্লিয়াসের উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা। যা মূলত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৬২ সালেই ছাত্রলীগের মধ্যে গঠিত হয়েল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যেই সশস্ত্র যুদ্ধ করে পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য বঙ্গবন্ধুর পরামর্শে বাঙালি সৈন্যদের মধ্যেও নিউক্লিয়াস গঠিত হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। যার বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যাবে পাকিস্তানিদের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট স্ব-ঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের দায়ের করা ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান’ মামলায় যা বিখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত। স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের সাথে জড়িত থাকার কারণেই বুঝতে পেরেছিলাম যে, সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবার এটাই মাহেন্দ্রক্ষণ।

জয়দেবপুরে (গাজীপুর) সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ৩ মার্চ, ১৯৭১-এ  গাজীপুর স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশের বটতলায় এক সমাবেশ করে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দেয়া হয়। স্লোগান ওঠে ‘ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মার বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। পতাকা ধরেছিলেন হারুন ভূঁইয়া এবং অগ্নিসংযোগ করেছিলেন শহীদউল্যাহ বাচ্চু আর স্লোগান মাস্টার আ. ছাত্তার মিয়া পায়ের আঙুলের উপর ভর দিয়ে স্লোগান দিত।

আমরা ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী (তৎকালীন রেসকোর্স) উদ্যানে সে সময় জয়দেবপুর থেকে হাজার হাজার বীর জনতা ট্রেনে করে এবং শতাধিক ট্রাক ও বাসে মাথায় লাল ফিতা বেধে জনসভায় যোগ দিলাম। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। আজকে ভাবতেও অবাক লাগে কীভাবে এ জনস্রোত এসে মিশে গিয়েছিল ৭ মার্চের মহাসমুদ্রে। ৭ মার্চে উজ্জীবিত হয়ে আমরা সম্ভবত ১১ মার্চ গাজীপুর সমরাস্ত্র কারখানা (অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি) আক্রমণ করি। গেটে বাধা দিলে আমি হাজার হাজার মানুষের সামনে টেবিলে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেছি মাইকে। পাকিস্তানিদের বুঝতে পারার জন্য ইংরেজিতে বলি: I do hereby dismiss Brigadier Karimullah from the directorship of  Pakistan Ordnance Factory and do hereby appoint Administrative officer Mr Abudul Qader (বাঙালি) as the director of the ordnance Factory’.

এই গর্জনে সত্যি কাজ হয়েছিল। পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার বক্তৃতা চলাকালীনই পেছনের গেইট দিয়ে সালনা হয়ে পালিয়ে ঢাকা চলে আসেন। পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার ১৫ এপ্রিলের পূর্বে গাজীপুরে যাননি। পাকিস্তান সমরাস্ত্র কারখানা  ২৭ মার্চ পর্যন্ত আমাদের দখলেই ছিল। সম্ভবত ১৩ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাহেবজাদা ইয়াকুব আলী জয়দেবপুর রাজবাড়ী মাঠে হেলিকপ্টারে অবতরণ করার চেষ্টা করলে শত শত বীর জনতা হেলিকপ্টারের প্রতি ইট পাটকেল ও জুতা ছুড়তে শুরু করে। ফলে হেলিকপ্টার নামতে না পেরে ফিরে যায়।

সেদিন ১৭ মার্চ বুধবার, মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিনে লক্ষ লক্ষ জনতার ঢল নেমেছিল ৩২ নম্বরে, বঙ্গবন্ধুকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে। তৎকালীন আমাদের নির্বাচনী এলাকার এম এন এ জনাব সামসুল হক (পরবর্তী কালে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী সভার সদস্য), জনাব হাবিব উল্ল্যাহসহ আমি গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুকে জয়দেবপুরে ২য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার সংবাদ দিতে। সন্ধ্যায় আমরা পেছনে দাঁড়িয়ে আছি দেখতে পেয়ে কিছু বলতে চাই কিনা বঙ্গবন্ধু জানতে চান। কুর্মিটোলা (ঢাকা) ক্যান্টনমেন্টে অস্ত্রের মজুদ কমে গেছে অজুহাতে ২য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে রক্ষিত অস্ত্র আনার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্ত নেবার সংবাদ জানাই। সামসুল হক সাহেবের ইশারায় আমি তরুণ হিসেবে এ অবস্থায় আমাদের কি করণীয় জানতে চাইলে, বঙ্গবন্ধু বাঘের ন্যায় গর্জে উঠে বললেন, ‘তুই একটা আহাম্মক, কি শিখেছিস যে আমাকে বলে দিতে হবে’। একটু পায়চারী কের পুনরায় বললেন, ‘বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করতে দেয়া যাবে না। Resist at the cost of anything.’

নেতার হুকুম পেয়ে গেলাম। ১৯ মার্চ শুক্রবার আকস্মিকভাবে পাকিস্তানি বিগ্রেডিয়ার জাহান জেবের নেতৃত্বে পাকিস্তানি রেজিমেন্ট জয়দেবপুরস্থ ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার জন্য পৌঁছে যায়। একজন নায়েব সুবেদার জয়দেবপুর হাইস্কুলের মুসলিম হোস্টেলের পুকুরে (জকি স্মৃতির প্রাইমারী স্কুলের সামনে) গোসল করার সময় জানান যে, ঢাকা থেকে বিগ্রেডিয়ার জাহান জেব চলে এসেছে। খবর পেয়ে দ্রুত আমাদের তখনকার আবাসস্থান মুসলিম হোস্টেলে ফিরে গিয়ে উপস্থিত জনাব হাবিবউল্ল্যাহ ও শহীদুল্ল্যাহ বাচ্চুকে এ সংবাদ জানাই। শহীদুল্ল্যাহ বাচ্চু তখনই রিকশায় চড়ে শিমুলতলীতে, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, ডিজেল প্লান্ট  ও সমরাস্ত্র কারখানায় শ্রমিকদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে জয়দেবপুর চলে আসার খবর দেয়। ১ ঘণ্টার মধ্যে মাঠে হাজার শ্রমিক জনতা চারিদিক থেকে লাঠি, দা, কাতরা, ছেন, দোনালা বন্দুকসহ জয়দেবপুর উপস্থিত হয়। সেদিন জয়দেবপুর হাটের দিন ছিল। জয়দেবপুর রেল গেইটে মালগাড়ির বগি, রেলের অকেজো রেল লাইন, স্লিপারসহ বড় বড় গাছের গুড়ি, কাঠ, বাঁশ, ইট ইত্যাদি যে যেভাবে পেরেছে তা দিয়ে এক বিশাল ব্যারিকেড দেয়া হয়। জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত আরো ৫টি ব্যারিকেড দেয়া হয় যাতে পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্র নিয়ে ফেরৎ যেতে না পারে। ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন মেজর কে এম শফিউল্লাহ (পরবর্তী কালে প্রধান সেনাপতি)। আমরা যখন ব্যারিকেড দিচ্ছিলাম তখন টাঙ্গাইল থেকে রেশন নিয়ে একটি কনভয় জয়দেবপুর আসছিল। সেই রেশনের গাড়ি জনতা আটকে দেয়। সে কনভয়ে থাকা ৫ জন সৈন্যর চাইনিজ রাইফেল তাদের নিকট থেকে কেড়ে নেয়া হয়।

এ দিকে রেল গেইটের ব্যারিকেড সরানোর জন্য ২য় ইস্ট বেঙ্গলের রেজিমেন্টকে জাহান জেব আদেশ দেয়। কৌশল হিসেবে বাঙালি সৈন্যদের সামনে দিয়ে পেছনে পাঞ্জাবি সৈন্যদের অবস্থান নিয়ে মেজর শফিউল্লাহকে জনতার উপর গুলি বর্ষণের আদেশ দেয়। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা আমাদের উপর গুলি না করে আকাশের দিকে গুলি ছুড়ে সামনে আসতে থাকলে আমরা বর্তমান গাজীপুর কেন্দ্রিয় জামে মসজিদের উপর অবস্থান নিয়ে বন্দুক ও চাইনিজ রাইফেল দিয়ে সেনাবাহিনীর উপর গুলি বর্ষণ শুরু করি।

পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে জয়দেবপুরে শহীদ হন নেয়ামত ও মনু খলিফা। আহত হন চতরের সন্তোষ, ডা. ইউসুফসহ শত শত বীর জনতা। পাক বাহিনী কার্ফু জারি করে এলোপাথারি গুলিবর্ষণ শুরু করলে আমাদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। আমরা পিছু হটলে দীর্ঘ সময় চেষ্টা করে ব্যারিকেড পরিস্কার করে ব্রিগেডিয়ার জাহান জেব চান্দনা চৌরাস্তায় এসে আবার প্রবল বাঁধার সম্মুখীন হন।  নামকরা ফুটবল খেলোয়াড় হুরমত এক পাঞ্জাবী সৈন্যকে পেছন দিয়ে আক্রমণ করে। আমরা সৈন্যের রাইফেল কেড়ে নেই। কিন্ত পেছনে আরেক পাঞ্জাবী সৈন্য হুরমতের মাথায় গুলি করলে সে সেখানেই শাহাদাত বরণ করে।  বর্তমানে সেই স্থানে চৌরাস্তার মোড়ে ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ নামে ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছে।

পরদিন বঙ্গবন্ধু আলোচনা চলাকালে পাক বাহিনীর আক্রমণে ১৯ মার্চের নিহতের কথা উল্লেখ করলে জেনারেল ইয়াহিয়া খান উল্লেখ করে যে, জয়দেবপুরে জনতা পাক বাহিনীর উপর আধুনিক অস্ত্র ও চাইনিজ রাইফেল নিয়ে আক্রমণ করেছে এবং এতে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক সৈন্য আহত হয়েছে।

১৯ মার্চের পর সারা বাংলাদেশে স্লোগান ওঠে, ‘জয়দেবপুরের পথ ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘জয়দেবপুরের পথ ধর-সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু কর’। ১৯ মার্চের সশস্ত্র যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক মাইল ফলক। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৯ মার্চ জাতীয় জীবনে এক স্মরণীয় দিন। তাই জাতীয়ভাবে এই দিবস পালিত হলে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যায়ন যথার্থভাবে হবে বলে আমি মনে করি।

লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ মার্চ ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়