ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ফিরে আসছে নীল চাষ

মো. আমিরুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৪, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফিরে আসছে নীল চাষ

মো. আমিরুল ইসলাম : ১৯৮৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জয়পুরহাট জেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। জেলার বয়স ৩৪ বছর। জেলার বয়স কম হলে কী হবে ঐতিহ্যের দিক থেকে এই এলাকা অনেক সমৃদ্ধ। সরকারি তথ্য অনুযায়ী এ জেলায় ৪-৫টি শতবর্ষী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। খঞ্জনপুরেই তার দুটি। একটি খঞ্জনপুর মিশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (১৯১১ সালে প্রতিষ্ঠিত) এবং অপরটি খঞ্জনপুর উচ্চ বিদ্যালয় (১৯১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত)। সম্ভবত এই দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করেই এলাকাটি বর্তমানে একটি শিক্ষা জোনে পরিণত হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী এ দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার আগে এলাকাটি বেশ জাঁকজমক ছিল। ১৮০০ শতকের শেষ ভাগে এখানে একটি নীল কুঠি (যেটি এলাকাবাসীর কাছে কাচারি ঘর নামে পরিচিত) নির্মাণ করা হয়। উদ্দেশ্য নীল চাষ এবং এ নিয়ে বাণিজ্য। উত্তরবঙ্গে Robert Watson and Company নামে একটি কোম্পানি এ নিয়ে কাজ করতো। মি. পিটার নামের একজন ব্রিটিশ নাগরিক খঞ্জনপুর নীল কুঠির দায়িত্বে ছিলেন। এই জয়পুরহাটে তার অধীনে আরও কয়েকটি নীল কুঠি স্থাপন  করা হয়েছিল বলে জানা যায়। প্রায় সোয়া শ’ বছর ধরে এদেশে নীল চাষ হয়েছে। এসব কাহিনি এখন অনেকেরই অজানা।

নীল সবার কাছে একটি পরিচিত রং। কম-বেশি সবাই এই রং পছন্দও করি। কৃত্রিম নীল রং থাকলেও আমি যে নীল রংয়ের কথা বলছি তা প্রকৃতি থেকে সংগৃহীত হয়। নীল হচ্ছে শীম পরিবারভুক্ত গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। স্থানীয়ভাবে নিলিনী, রঞ্জনী, কালোকেশী, নীলপুষ্প ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। ইংরেজিতে নীলকে Indigo এবং রোমান ভাষায় Indicum বলা হয়। বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে, Indigofera Tinctoria. বাংলার ভূখণ্ডে ইন্ডিগোফেরার ১৫ প্রজাতির গাছ জন্মাতো।

নীল গাছ দেখতে অনেকটা ঝোঁপ গাছের মত। ১ থেকে ২ মিটার লম্বা হয়। জীবনকাল ৬ মাস। ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে বীজ বপন করলে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে গাছ মারা যায়। গাছের পাতা সবুজ কিন্তু যে ফুল হয় তা প্রথমে গোলাপী ও পরে বেগুনি রংয়ের হয়। তবে কিছু কিছু জাতের ফুল সাদা ও হলুদ রংয়েরও হয়। ফল ও বীজ সরিষার মতো। মাষ কলাইয়ের মত এক চাষ দিয়েই বীজ বপন করা যায়। বীজ বপনের তিন মাস পর গাছের পাতা কাটা যায়। ছয় মাসের মধ্যে ৪-৫ বার পাতা কাটা যায়। পাট গাছের মত নীল গাছকেও পানিতে জাগ দিয়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় নীল রং তৈরি করা হয়।

নীল কিন্তু শুধু রং হিসেবেই নয়, নানাক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। সুতি বা উলেন সিল্ক কাপড়ের রং উজ্জ্বল করার ক্ষেত্রে এর জুড়ি নাই। পাট গাছের মত নীল গাছ উৎকৃষ্ট জ্বালানি ও জৈবসার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নীল থেকে তেলও হয়। জামা-কাপড় ব্যাকটেরিয়ামুক্ত রাখা এবং শরীর এলার্জিমুক্ত রাখার ক্ষেত্রেও নীলের ভূমিকা আছে। নীল ব্যবহারে গায়ের চামড়াও ভাল থাকে। কলপ, নীলের খৈল থেকে লোসন, সেভিং ফোম ইত্যাদিও তৈরি হয়। ভেষজ গুণ থাকায় চিকিৎসা ক্ষেত্রেও নানা অসুখে নীল গাছ ব্যবহার হয়।



এবার নীল চাষের ইতিহাসের দিকে যাই। সবাই জানি , ১৭৫৭ সালে এই উপমহাদেশ ব্রিটিশরা তাদের কব্জায় নেয়। এর আগে ও পরে ইউরোপের অনেক দেশ থেকে বণিকরা এসে এদেশে ব্যবসা করতো। তাদের মধ্যে ফরাসি বণিকরাও ছিলেন। ১৭৭৭ সালে মঁসিয়ে লুই বোনার্ড নামের ফরাসি বণিক আমেরিকা থেকে প্রথম নীলবীজ এনে এ অঞ্চলে নীল চাষ শুরু করেন। তিনি হুগলি নদীর তীরবর্তী গোন্দালপাড়া ও তালডাঙ্গায় সর্বপ্রথম নীলকুঠি স্থাপন করেন। তাকে অনুসরণ করে ১৭৭৮ সালে ক্যারল ব্লুম নামের এক ইংরেজ কুষ্টিয়ায় নীলকুঠি স্থাপন করেন। এর পর ১৭৭৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সবাইকে নীল চাষ করার আদেশ জারি করে। এভাবেই এ অঞ্চলে নীল চাষের সূচনা হয়।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে বস্ত্রশিল্পের উন্নতি সাধিত হয় এবং কাপড়ে রঙের ব্যবহার বেড়ে যায়। তাতে নীলের চাহিদাও বহুগুণ বেড়ে যায়। সে সময় নীল চাষ এতই লাভজনক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, অনেক সরকারি আমলা-কর্মচারী এমনকি রাজনীতিক নিজ কাজ ভুলে নীলচাষের কারবারে আত্মনিয়োগ করেন। দেশীয় বহু জমিদার এবং মহাজনরাও ব্যক্তিগতভাবে বা যৌথভাবে কারবার গড়ে তোলেন। এটা ছিল অনেকটা রাতারাতি ধনী হওয়ার মত কাহিনি। কিন্তু বিধি বাম! উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে নানা কারণে সারা দুনিয়ার দৃশ্যপট বদলে যায়। সেসব কারণে নীল চাষের চেয়ে অন্যান্য খাদ্যশস্য, তেলবীজ ও পাট উৎপাদন বেশি লাভজনক হয়ে উঠে। কৃষকরা তখন নীলচাষের পরিবর্তে ধান ও পাট চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এখানে বলে রাখা ভাল যে, তৎকালে এ অঞ্চলে প্রতিমণ নীল ৩০ টাকা দরে বিক্রি হতো। লন্ডনের বাজারে তা ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি দামে রপ্তানি হতো। অথচ কৃষকদের দেয়া হতো মাত্র ৪ টাকা।

নীল ব্যবসায় নীলকরদের অনেক লাভ হতো সে কারণে নীলকর এবং তাদের দোসররা মিলে নানা অত্যাচার চালিয়ে নিরীহ কৃষকদের দিয়ে নীল চাষে বাধ্য করা হতো। এভাবে নীল চাষের সঙ্গে প্রায় ১ কোটি ১২ লাখ ৩৬ হাজার কৃষককে জড়ানো  হয়।  ১৮৫৯ সালে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে নীলচাষীরা সংঘবদ্ধভাবে নীলচাষ করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং নীল চাষ আইন বাতিল ও নীলকরদের নির্মম নিপীড়নের প্রতিবাদে যশোর অঞ্চলের কৃষকরা বিদ্রোহ শুরু করে। বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম যশোর জেলার চৌগাছায় (পূর্বতন নদীয়া) এ বিদ্রোহ দেখা দেয়। তা ক্রমশ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় নীল চাষের বিরুদ্ধে প্রায় ৬০ লাখ কৃষক প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন। তাদের বিদ্রোহে বাংলার প্রধান ধর্মীয় নেতাও সমর্থন দেন। যাদের মধ্যে চাঁদপুরের ধর্মীয় নেতা হাজি মোল্লা ছিলেন অন্যতম। সে সময় হাজি মোল্লা বলেছিলেন যে, “নীল চাষের চেয়ে ভিক্ষা উত্তম।”

নীল বিদ্রোহ দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮৬০ সালে নীল কমিশন গঠন করে। এই কমিশন তদন্ত করে চাষীদের অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পায়। নীলচাষীদের উপর নীলকরদের অত্যাচার সম্পর্কে কমিশনের কাছে সে সময় ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট ‘ডেলাতুর’ বলেছিলেন যে, “এমন একটা নীলের বাক্স ইংল্যান্ডে পৌঁছায় না যেটা মানুষের রক্তে রঞ্জিত নয়।” ১৮৬২ সালে নীল বিদ্রোহের অবসান হয়। পরে ক্রমে ক্রমে নীলের উৎপাদন কমে যায়। অতঃপর নীলকররা নীল চাষে সুবিধা করতে না পেরে ১৮৯৫ সালের দিকে তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দেয়। ১৯০০ সালের মধ্যে নিশ্চিন্তপুরের নীলকুঠি উঠে যাওয়ার মাধ্যমে বাংলায় সম্পূর্ণরূপে নীলচাষের অবসান হয়। দীনবন্ধু মিত্র ১৮৬০ সালে নীল বিদ্রোহ নিয়ে ‘নীল দর্পণ’ নাটক রচনা ও প্রকাশের মধ্য দিয়ে ইতিহাসে ঠাঁই করে নেন।



অন্যান্য পণ্যের মত নীলচাষও এদেশে জনপ্রিয় হতে পারতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য নীলকর এবং তাদের দোসরদের পাকিস্তানি হানাদারদের মত আচরণের কারণে নীল চাষ তখন এ অঞ্চল থেকে বিদায় নেয়। আসলে নীলচাষ তখন অলাভজনক ছিল না। প্রকৃতপক্ষে নীলচাষীরা তখন নীলচাষের বিনিময়ে উপযুক্ত দাম পেতেন না। আবার এনিয়ে নীলকরদের নানা অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে তাদের। সব দিক বিবেচনা করে বলা যায়, যে দেশের মানুষ এখনও তামাক চাষ ছাড়তে পারেন নি সে দেশে নীল চাষ বিতাড়িত হওয়ার কথা ছিল না। তাই তো আবারো নীল চাষের দিকে ঝুঁকছে এদেশের মানুষ। ইতোমধ্যে দিনাজপুরে এবং রংপুরের দুই তিনটি উপজেলার প্রায় ১০টি ইউনিয়নে সীমিত পরিসরে নীলের চাষ শুরু হয়েছে। গড়ে উঠেছে ছোট-খাটো কারখানাও। সেই নীল দিয়ে রাঙিয়ে ব্যাগ, ফতুয়া, চাদর, নকশীকাঁথা ও বাহারি পণ্য তৈরি হচ্ছে। দেশ-বিদেশে এসব পণ্যের প্রচুর চাহিদাও রয়েছে। দিনাজপুর এবং রংপুরের নীলচাষীদের আগ্রহ দেখে মনে হচ্ছে যে, এখন যেহেতু ব্রিটিশ নীলকরদের উৎপাত নেই সেহেতু নীলচাষ আবারও এদেশে ফিরে আসুক তা তারা চান।

লেখক: জয়পুরহাট অধিবাসী এবং চাকরিজীবী



রাইজিংবিডি/ঢাকা/ ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/হাসনাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়