ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

শিক্ষার্থীর হাতে সময়মতো বই পৌঁছাবে তো?

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১১, ৩ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিক্ষার্থীর হাতে সময়মতো বই পৌঁছাবে তো?

মাছুম বিল্লাহ : পত্রপত্রিকা ও এনসিটিবি সূত্রে জানা যায় যে, আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকের বই ছাপা হবে প্রায় এগারো কোটির মতো। বই ছাপার জন্য গত ৫মার্চ টেন্ডার আহবান করে ১২এপ্রিল দরপত্র খোলা হয়। টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি বৈঠকে টেন্ডার বা দরপত্র চূড়ান্ত করতে পারেনি কারণ টেন্ডারে কাগজের যে মূল্য ধরা হয়েছে, তাতে মাধ্যমিকের কাগজের চেয়ে বেশি দর ধরা হয়েছে। এতে বিগত বছরের চেয়ে কাগজের দাম বেশি হবে। এই একটিমাত্র কারণেই মূল্যায়ন কমিটি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। একাংশ চাইছে, পিপিআরের নীতিমালার আলোকে বিদ্যমান টেন্ডার পুনঃমূল্যায়ন করতে। আরেক অংশ চাইছে, সম্পূর্ন নতুন করে টেন্ডার আহবান করতে। এ নিয়ে আলোচনা চলছে কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি।

এনসিটিবি মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের কাগজের দাম  নির্ধারণ করেছে প্রতি মেট্রিক টন ৯৫ হাজার টাকা আর প্রাথমিকের প্রাক্কলন করেছে ৮২হাজার টাকা। তবে মুদ্রণশিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাধ্যমিকের বইয়ের কাগজের মান ও উজ্জলতা সমান হয় না। সে ক্ষেত্রে প্রাথমিকের কাগজের দাম বেশি হতে পারে। কিন্তু সেখানে প্রাক্কলন দর কমানোর পেছনে কোনো রহস্য কাজ করেছে। সে রহস্যটি হচ্ছে, টেন্ডার ফেলা ও বাছাইয়ের সময়ই বিদেশী একাধিক দরপত্র বাতিল হয়ে গেছে। এখন নতুন করে টেন্ডার হলে বিদেশী বিশেষ করে ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠান কাজ পেতে পারে। পার্শ্ববর্তী দেশের একটি প্রতিষ্ঠান ২০১৬ সালে প্রাথমিকের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর অন্তর্জাতিক টেন্ডারে অংশ নিয়ে কাজ পায়। কিন্তু তারা বই  সরবরাহ করেছিল নির্ধারিত সময়ের চারমাস পরে। ফলে এনসিটিবি প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভূক্ত করে। শোনা যাচ্ছে উক্ত প্রতিষ্ঠানটি পুনরায় কাজ পাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে এবং এনসিটিবির উচ্চ পর্যায়ের দুএকজন কর্মকর্তা তাদের কাজ পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন।

আগামী শিক্ষাবর্ষে  বইয়ের ব্যাপারে প্রতি ফর্মা ছাপানো ও আনুষঙ্গিক দরসহ প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই টাকা ২৫পয়সা। কিন্তু টেন্ডারে অংশ নেওয়া বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান দর হেঁকেছে ২টাকা ৬৩পয়সা থেকে ৯৩পয়সা পর্যন্ত। গড়ে ২টাকা ৭৫পয়সা।  এতে প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রায় ৩৫শতাংশ দাম বেড়ে গেছে। গত বছর মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাথমিকের বই প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ১৮শতাংশ কম দামে এক টাকা ৯৫ পয়সায় ছেপেছিল। প্রাথমিকে প্রতি বই গড়ে ১২দশমিক ৬৮ফর্মায় প্রতি বইয়ের দাম পড়বে ২৪টাকা ৬৪পয়সা। এবার সেই বই গড়ে ২টাকা ৭৫পয়সা দাম পড়েছে। এতে প্রতি বইয়ের দাম পড়বে ৩৪টাকা ৭৬পয়সা। অর্থাৎ প্রতি বই গত বছরের চেয়ে ১০টাকার বেশি দাম পড়ছে। এতে প্রায় ১১ কোটি বইয়ের জন্য ১১১কোটি টাকা বেশি খরচ পড়বে। এ বছরের বইয়ের জন্য প্রাক্কলিত দর ৩৫৮কোটি ৮৮লাখ টাকা ধরা হয়েছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ইস্যুতে টেন্ডার কমিটির সদস্যরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তবে, সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে তিনটি প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি হচ্ছে, পিপিপির ৯৮ধারা অনুযায়ী প্রাক্কলন করে দর বাড়ানো, পুনঃটেন্ডার আহবান করা, নতুন করে টেন্ডার আহবান করা। কয়েকজন নতুন টেন্ডারের পক্ষে মতামত দেন। দুজন তখন পাঠ্যবইয়ের কাজ সময়মতো শেষ করার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। তা হচ্ছে নতুন করে বা পুনঃটেন্ডার করলে প্রায় তিনমাস সময় লেগে যাবে। এর মধ্যে টেন্ডার আহ্বান করলে অন্তত ৪২দিনি সময় লাগবে প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। এরপর মূল্যায়নে অন্তত ২০জন লাগবে। এছাড়া দরদাতাদের কাজ দিয়ে চুক্তিবদ্ধ হতে আরো ২৮দিনের প্রক্রিয়া আছে। তাই কমিটির দুজন সদস্য পুনরায়  বাজার দর যাচাই শেষে বিদ্যমান টেন্ডারেই সমাধা করতে চান।

এনসিটিবি গত বছরের চেয়ে এবার (২০১৮) ৬০ শতাংশ বেশি দরে মাধ্যমিকের কাগজ কিনেছে। সেখানে প্রাথমিকের টেন্ডারে দড় গড় ৩৬শতাংশ বেড়েছে। চলতি বছরটি ’নির্বাচনের বছর এই অজুহাতে ছাপার কাগজের মূল্য টনপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণকারী একটি চক্র ও দেশীয় সিন্ডিকেট মিলে এ কাজটি করেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিনা মূল্যের পাঠ্যবই ছাপার সাথে যুক্ত দেশীয় মুদ্রণকারীরা। মুদ্রণশিল্প মালিক সমিতির সভাপতি বলেন, বিশ্বব্যাপী কাগজ তৈরির কাঁচামালের দাম বেড়েছে। তার প্রভাব পড়েছে কাগজের বাজারে। আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য সরকার প্রায় ৩৭ কোটি বই ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এনসিটিবি বই ছাপার জন্য যে মূল্য দিতে চায় তা নিয়ে অসন্তোষ মুদ্রণকারীদের। তারা বলছেন, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজের দাম, নিরাপত্তা পেপারের দাম, অন্যান্য মুদ্রণ উপকরণ ও শ্রমিকের মজুরি গত বছরের চেয়ে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এনসিটিবি যে দামে টেন্ডার কল করেছে, তাতে অংশ নিলে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। মুদ্রাকরের নেতারা বলছেন এনসিটিবি নিজেই গত ৪০-৫০শতাংশ বেশি দামে কাগজ কিনেছে। অথচ এনসিটিবি যখন টেন্ডার করছে তখন কম মূল্যে নির্ধারণ করছে কাগজে। এ নিয়েই জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।

একই অবস্থা তৈরি হয়েছে জুলাই মাসে শুরু হওয়া উচ্চ মাধ্যমিকের তিনটি বই নিয়ে। বাংলা, বাংলা সহজ পাঠ ও ইংরেজি। এ তিনটি বইয়ের টেন্ডারে  কোন মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়নি। ৯৩টি টেন্ডার শিডিউল বিক্রি হলেও গত ৩রা মে টেন্ডার বাক্স খোলার দিন দেখা গেল প্রায় ৩০ লাখ বই ছাপানোর জন এনসিটিবিতে কেউ টেন্ডার জমা দেয়নি। এ নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন আরেক জটিলতা। টেন্ডার প্রাক্কলনে বাংলা ও বাংলা সহজ পাঠের দাম বাড়ানো হলেও ইংরেজি বইয়ের দাম গত বছরের দামেই অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। দেশীয় মুদ্রণকারীরা এ ক্ষেত্রেও একই দাবি করে বলেছেন, কাগজসহ মুদ্রণ উপকরণের দাম বিগত বছরের চেয়ে বেড়েছে। এনসিটিবি এ বিষয়টিকে এড়িয়ে টেন্ডার ডেকেছে। তাই কেউ কেউ অংশ নেয়নি। উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো বই পৌছাঁনো যাবে কিনা তা এখন অনিশ্চিত। বাংলা বইয়ে এবার নতুন দুটি গল্প যুক্ত হবে। এ ছাড়া ওই তিনটি বইয়ের বড় কোনো পরিবর্তন নেই। ফলে এত বিপুল পরিমাণ বইয়ের বাজার চাহিদাও নেই।  বই বিক্রি না হলে ক্ষতির মুখে পড়তে হবে মুদ্রণকারীদের।  উচ্চ মাধ্যমিকের তিনটি বই বাংলা, বাংলা সহজ পাঠ ও ইংরেজি শিক্ষার্থীদের মূল্য পরিশোধে কিনতে হয়। এবার বাংলা বইয়ের দাম ধরা হয়েছে ১২১টাকা, বাংলা সহজ পাঠের দাম ধরা হয়েছে ৫৯টাকা আর ইংরেজি বইয়ের দাম ধরা হয়েছে ৮১টাকা। উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা, সহপাঠ ও ইংরেজি উচ্চ মাধ্যমিকের বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক শখার সব শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক। এ বই তিনটি বিনামূল্যে দেওয়া হলেও এনসিটিবির নির্ধারিত বই বাধ্যমতামূলক। এ তিনটি বই এনসিটিবি নিজে ছাপায় না। মুদ্রণকারীরদের কাছে স্বত্ব দিয়ে দেওয়া হয়  এবং বইয়ের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। বিনিময়ে রাজস্ব আদায় করে এনসিটিবি। বই তিনটি নিয়ে বিকল্প চিন্তা করা হচ্ছে।

বিনামূল্যে পাঠ্যবই ছাপার জন্য দেশীয় মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে কয়েক বছর থেকেই চলছে দ্বন্দ্ব। অর্ধশতাধিক ছাপা প্রতিষ্ঠানের মালিকের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক ১৬৫টি ওয়েব মেশিন । চলতি বছর ৬৬টি ওয়েব মেশিন প্রতিষ্ঠান পাঠ্যবই ছাপার টেন্ডারে  অংশ নিচ্ছে। প্রতিবছরই এ সংখ্যা বাড়ছে।  এ বছর অতিরিক্ত আরো ১৩টি ওয়েব মেশিন এতে যুক্ত হচ্ছে। এসব মেশিনে বই ছাপা-বাঁধাই ও প্যাটেকজাত হয়ে বের হয়। ফলে অল্প সময়ে অধিক বই ছাপা যায়। অপরদিকে আড়াই শতাধিক প্রতিষ্ঠানের হাতে রয়েছে এক হাজারের অধিক অফসেট প্রিন্টিং প্রেস। এদের মধ্যে পাঁচ শতাধিক প্রেস পাঠ্যবই ছাপার কাজে অংশ নেয়। এ দুগ্রুপের মধ্যে গত কয়েক বছর থেকে চলছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। অফসেট প্রিন্টিং প্রেস মালিকেরা বলছেন, ওয়েব মেশিন মালিকেরা সিন্ডিকেট গড়ে এনসিটিবির মাধ্যমে বইয়ের বড় লট তৈরি করে কাজ বাগিয়ে নিচ্ছে। তারা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে বড় লটের কাজ ভাগ-বাটোয়ার করে নেয়। এদের ছাপার মান ভালো নয়। বই সময়মতো সরবরাহ করতে পারে না । কয়েক বছর তারাই বই দিতে দেরি করছেন। অপরদিকে ওয়েব মেশিন মালিকেরা বলছেন, অফসেট মালিকদের কারণেই বই ছাপার কাজ ভারতীয় মুদ্রণকারীরা নিয়ে গেছে। তারা ওয়েব মেশিনে বই ছাপিয়ে দ্রুত ও সময়ের আগেই বই সরবরাহ করেছেন। এ ছাড়া প্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে তাল মিলিয়ে দেশীয় মুদ্রণ শিল্প এখন অনেক দূর এগিয়ে গেছে। মুদ্রণশিল্প সমিতির সভাপতি বলেন, এ বছর ৩৭ কোটি বই অফসেট প্রিন্টিং প্রেসে সারা বছর ছাপিয়েও সময়মতো সরবরাহ করা কঠিন হবে। এ কারণেই এনসিটিবি বই ছাপার কাজ বিদেশীদের হাতে তুলে দিতে চায়। দেশাত্মবোধের চেতনা থেকেই মুদ্রণশিল্প মালিকেরা অত্যাধুনিক ওয়েব মেশিন দেশে নিয়ে এসেছেন। টেন্ডারের শর্ত ও শিডিউল মতো বই সরবরাহে কোনো সমস্যা হচ্ছে না গত দুই বছর থেকে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ আর প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে মুদ্রণশিল্পকে অবশ্যই আধুনিক করতে হবে। এ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়ালে আমরা পিছিয়ে পড়ব।

২০১৯শিক্ষাবর্ষে বিনামূল্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যবই সময়মতো সরবরাহ ও শিক্ষার্থীদের প্রাপ্তি নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। নির্বাচনের বছর হওয়ায় আগামী আক্টোবরের মধ্যেই পাঠ্যবই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পান রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু উপরেল্লিখিত সমস্যাবলীর কারণে এনসিটিবি এবার সময় ক্ষেপন ও দীর্ঘসূতার মুখে পড়তে পারে। বই সরবরাহ করতে যাতে জটিলতার সৃষ্টি না হয় সেদিকে এনসিটিবিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এখানে আর একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। সেটি হচ্ছে এনসিটিবিকে প্রতিবছর বিশাল অঙ্কের বই ছেপে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়। এটি একটি দুরুহ কাজ। এই বিশাল কাজটি করার জন্য এনসিটিবির নিজেরই প্রিন্টিং ও প্যাকেজিং মেশিন থাকা উচিত। তাতে বিদেশী ও দেশী প্রিন্টিংও প্যাকেজিং প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভরশীলতা কমবে এবং সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছানো সহজ হবে। এড়ানো যাবে প্রায় প্রতিবছর সৃষ্ট এইসব জটিলতা। আর সকল বিভাগের পুস্তকের মান নিয়ন্ত্রণের জন্যও এনসিটিবির একটি বিশেষ ইউনিট থাকতে হবে। না হলে শুধু লক্ষ কোটি বই ছাপানো আর বিতরণ নিয়ে ব্যস্ত থাকলে জাতীয় এই প্রতিষ্ঠানের বিশেষত্ব কি থাকল?



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ জুলাই ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়