ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মসলিনের সোনালী ঐতিহ্য ফেরাতে গবেষণা

তানজিমুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:১০, ৮ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মসলিনের সোনালী ঐতিহ্য ফেরাতে গবেষণা

তানজিমুল হক, রাজশাহী : কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী মসলিন ফিরিয়ে আনতে গবেষণা শুরু হয়েছে। বিষয়টি বাস্তবে রূপ দিতে কাজ শুরু করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) তিন শিক্ষকসহ সাত সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল।

ইতোমধ্যে বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যরা মসলিনের প্রধান উৎস ফুটি কার্পাস তুলার সন্ধানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শন করে বেশকিছু নমুনা সংগ্রহ করেছেন। এগুলোর বৈশিষ্ট্য ফুটি কার্পাস তুলার কাছাকাছি বলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

ঐতিহ্যবাহী মসলিন কাপড় এতোই সূক্ষ্ম ছিল- একটি শাড়ি একটি দিয়াশলাই বাক্সে রাখা যেত। মসলিন শাড়ি সম্পর্কে এই কিংবদন্তি বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে বহুল প্রচলিত। যদিও এর স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ মেলে না। দিয়াশলাইয়ের বাক্সে রাখা সম্ভব কী না বিতর্ক থাকলেও মসলিনের কাপড়ের সুতা, হালকা ও আরামদায়ক ভাব নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।

এই মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার প্রকল্পের আওতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যলয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের পরিচালক ও বায়োটেকনোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মনজুর হোসেনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করা হয়েছে। দলের অন্য সদস্যরা হলেন- রাবির অ্যাগ্রোনমি অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এম ফিরোজ আলম, টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের বুটেক্সের ডিন আলীমুজ্জামান, তুলা উন্নয়ন বোর্ডের একজন ও তাঁত বোর্ডের দুইজন কর্মকর্তা। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনে আরো দুই-তিনজন সদস্য এ বিশেষজ্ঞ দলে কাজ করছেন।

বিশেষজ্ঞ দল সূত্রে জানা গেছে, মসলিন বিলুপ্ত হয়ছে অন্তত তিনশ বছর আগে। বিলুপ্ত সোনালী ঐতিহ্যের সেই মসলিন আবার ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনকালে সোনালী ঐতিহ্যের মসলিন তৈরির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

এরপর সরকার থেকে ৩৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই টাকা দিয়েই মূলত গবেষণা কর্মটি শুরু হয়। পরবর্তীতে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয় ‘বাংলাদেশের সোনালী ঐতিহ্য মসলিনের সূতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার (প্রথম পর্যায়)’।

প্রস্তাবিত প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ১৩ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মেয়াদকালে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পটি ইতোমধ্যেই পাশ হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ প্রকল্পটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রথম পর্যায়ে ২০১৭ থেকে আগামী ২০১৯ এই তিন বছরের ধরে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এখানে সাফল্য পাওয়া গেলে দ্বিতীয় পর্যায়ে আবারো তিন বছরের প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু হবে।

তাঁত বোর্ড সূত্র জানায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত টিম বাংলাদেশের যেসব এলাকায় মসলিনের সুতা তৈরির উপযোগী ফুটি কার্পাস তুলা উৎপাদন হয় তা খুঁজে বের করবে। আর বাংলাদেশে এ ধরনের তুলা এখন না পাওয়া গেলে বিদেশ থেকে সমজাতীয় তুলা এনে মসলিন সুতা তৈরির ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করা হবে। দেশে আবারো হারানো মসলিন ফিরিয়ে আনার এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলেও সূত্রটি জানায়।

বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ও রাবির অ্যাগ্রোনমি অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সোনালী ঐতিহ্যের সেই মসলিন কাপড় ফিরিয়ে আনতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে আমরা বিভিন্ন জাতের তুলার নমুনা সংগ্রহ করে ফুটি কার্পাস তুলার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছি। কোন কিছুই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়ার নয়, আমরা আশাবাদী কোথাও না কোথাও এ ফুটি কার্পাস তুলার সন্ধান পাওয়া যাবে। যা দিয়ে আমরা মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার করতে পারবো।’

তিনি আরো বলেন, ‘কার্পাস তুলার অনেক জাত রয়েছে। এর মধ্যে বিশেষ জাত ফুটি কার্পাস তুলা দিয়েই মূলত ঐতিহ্যবাহী মসলিন কাপড় প্রস্তুত হতো। ফুটফুটে (সুন্দর) শিশু থেকেই এ তুলার নামকরণ ফুটি কার্পাস।’

গবেষণা কাজে নেতৃত্ব দেওয়া রাবির ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সের পরিচালক ও বায়োটেকনোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. মনজুর হোসেন বলেন, ‘আমাদের এ গবেষণার সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিন আহমেদ গবেষণাটি দেখভাল করছেন। আশাব্যঞ্জক সাফল্য নিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। ২০১৯ সালের মধ্যে মসলিন কাপড়ের একটি রুমাল হলেও বানিয়ে দেখাবো।’

মসলিন হলো তুলার আঁশ থেকে প্রস্তুত করা এক ধরনের অতি সূক্ষ্ম কাপড়। এটি তৈরি হতো ‘ফুটি কার্পাস’ নামের এক ধরনের সূক্ষ্ম তুলা থেকে। মসলিনের ইতিহাস নিয়ে অনেক গল্পগাথা প্রচলিত রয়েছে। মসলিন কাপড় এতো মিহি ছিল যে ৪০ হাত লম্বা ও দুই হাত চওড়া এমন একটি কাপড় একটা ছোট আংটির মধ্যে দিয়ে অনায়াসে চালাচালি করা যেত বলে কিংবদন্তি রয়েছে।

মোঘল আমলে সতেরো শতকে মসলিন শিল্প বিকাশ লাভ করেছিল ঢাকার সোনারগাঁও এবং এর আশপাশের অঞ্চলে। এ কারণে এটি ঢাকাই মসলিন বলে পরিচিত ছিল। এই মসলিন রপ্তানি হতো ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। তবে সস্তা কাপড়ের ভিড়ে আঠারো শতক থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে জগদ্বিখ্যাত পোশাক ঢাকায় মসলিন।




রাইজিংবিডি/রাজশাহী/৮ জুন ২০১৭/ তানজিমুল হক/উজ্জল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়