ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

সম্ভাবনাময় উপকূল

লবণ চাষে লাখো পরিবারের বাঁচার স্বপ্ন

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২২, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
লবণ চাষে লাখো পরিবারের বাঁচার স্বপ্ন



কাদামাটি দিয়ে শুরু। মাটির সঙ্গে থাকত সামান্য পরিমাণ লবণের কণা। মাঠ থেকে কাদা তুলে এনে তৈরি হতো লবণ। সে অবস্থা বদলেছে। এখন মাঠেই পাওয়া যাচ্ছে সাদা চকচকে লবণ। চাষ প্রক্রিয়ায় এসেছে অনেক পরিবর্তন। বছরে বছরে বাড়ছে উৎপাদনের পরিমাণ। চেষ্টাটা চাষীদের। এখানেই প্রমাণিত লবণচাষের সম্ভাবনা ব্যাপক। কিন্তু সম্ভাবনা থাকলে কী হবে! সম্ভাবনা বিকাশের উদ্যোগ তো নেই। যুগ যুগ ধরে অবহেলায়ই থেকে যাচ্ছে লবণখাত।

কক্সবাজারের চকরিয়া এলাকার লবণ চাষীদের কথায় এমনই আক্ষেপের সুর। তারা বলছেন, চেষ্টার কমতি নেই, খাটুনির শেষ নেই। চাষীরা আরও শ্রম দিতে রাজি। কিন্তু সরকারের সুনজর সবার আগে প্রয়োজন। আইন আর নীতিমালা বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজনে নতুন নীতিমালা করতে হবে। শুধু চাষীর স্বার্থে নয়, দেশের স্বার্থেও লবণখাত বাঁচাতে হবে।

মৌসুমে কক্সবাজারের চকরিয়া, মহেশখালী আর কুতুবদিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে মাঠের পর মাঠ সাদা চকচকে লবণ চোখে পড়ে। বর্ষা শুরু হওয়ার আগে চাষীরা প্রস্তুতি নেন লবণ সংরক্ষণ করার। কেউ মাটির নিচে, আবার কেউবা মাটির উপরেই পলিথিন মুড়িয়ে লবণ সংরক্ষণ করছেন। ন্যায্য দাম না পাওয়ায় কোনো বছর লবণ বিক্রি না হয়ে মাঠেই পড়ে থাকে।

দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিশেষ করে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এলাকায় সৌর পদ্ধতিতে সুদীর্ঘ কাল ধরে লবণ উৎপাদন হয়ে আসছে। তবে পরিকল্পিতভাবে সরকারি উদ্যোগে লবণ উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৬১ সাল থেকে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত শিল্প মন্ত্রণালয়ের সার্বিক তত্বাবধানে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সরকারের একমাত্র মূখ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে লবণ উৎপাদন পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের দায়িত্ব পালন করে আসছে।

সূত্র বলছে, দেশে উৎপাদিত লবণের গুণগত মান বেড়েছে। লবণ উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এমনকি লবণ রপ্তানির মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আর এক্ষেত্রে বিসিকের বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে। কিন্তু চাষীদের ন্যায্যমূল্য না দিতে পারায় এই খাত দিন দিন মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। চাষীদের সুযোগ বৃদ্ধিসহ লবণখাতের প্রসারের লক্ষ্য সামনে রেখে লবণ নীতিমালা হয়েছে ২০১১ সালে। এই নীতিমালার অনেক ধারা লঙ্ঘন করে এক শ্রেণীর মুনাফালোভী ব্যবসায়ী এই শিল্পকে ধ্বংসের চক্রান্ত করছে বলে অভিযোগ লবণ চাষীসহ সংশ্লিষ্টদের।

বিসিকের লবণ উৎপাদন সংক্রান্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০০-২০০১ অর্থবছর থেকে এই পর্যন্ত অধিকাংশ সময়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন হয়েছে দেশে। সর্বশেষ ২০১২-২০১৩ অর্থ বছরে দেশে ১৫ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে লবণ উৎপাদন হয়েছে ১৬ লাখ ৩৩ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন। অতিরিক্ত উৎপাদন হয় এক লাখ ২৩ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন লবণ। পরের বছরগুলোতেও লবণ উৎপাদন বেড়েছে।

চাষীরা জানান, বর্তমানে পলিথিন পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন হওয়ায় কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের আরও বেশি সংখ্যক চাষী লবণ চাষ করছেন। ফলে লবণ উৎপাদনের পরিমাণও বাড়ছে। বিগত সময়ে খুব সামান্য পরিমাণ লবণ আমদানি করতে হয়েছে। দিনে দিনে সে চাহিদা একেবারেই শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। চাষীদের মাধ্যমে দেশে উৎপাদিত লবণ যথাযথভাবে বাজারজাত করে চাষীদের লাভবান করা সম্ভব বলে লবণ চাষীরা মনে করেন।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও এই লবণখাত নিয়ে সরকার কিংবা বেসরকারি পর্যায় থেকে বিশেষ কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সরকার এ শিল্পকে কৃষিপণ্য হিসেবে না দেখে শিল্পপণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে চাষীরা কৃষি পর্যায়ে দেওয়া ভর্তুকি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ১৯৯১ সালের প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিঃস্ব লবণ চাষীদের ঋণের সুদটুকুও মওকুফ হয়নি। লবণ চাষকে কৃষিপণ্য হিসেবে ঘোষণা দিয়ে চাষী হিসেবে সব ধরণের কৃষি ভর্তুকি দেওয়ার দাবি তুলেছেন লবণ চাষীরা। তারা বলেছেন, লবণ চাষীরা প্রতিবছর নানা ধরণের দুর্যোগের মুখোমুখি হন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগের মাত্রা গত কয়েক বছরে অনেক বেড়েছে।

লবণ ব্যবসায়ীরা জানান, উৎপাদিত লবণ পরিশোধন ও বাজারজাত করণের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে অন্তত ৩৬০টি লবণ মিল-কারখানা। এসব মিলের মধ্যে শুধু কক্সবাজার সদরের বিসিক শিল্প নগরী ইসলামপুরকেন্দ্রিক ৪০টি মিলসহ জেলায় ছোট বড় মিলে অন্তত ৫০টি মিল গড়ে উঠেছে। এ পেশায় সম্পৃক্ত রয়েছে অন্তত অর্ধলক্ষাধিক চাষী ও তাদের পরিবার। কিন্তু উৎপাদিত লবণ ও লবণের মিল-কারখানাগুলো দেশের ৬টি রাঘব বোয়াল মিল মালিকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না চাষীর শ্রমের। এ কারণে চাষীরা লবণ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।

বাংলাদেশ লবণ চাষী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট এইচ এম শহিদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, মেকানিক্যাল লবণ মিলের মধ্যে কয়েকটি চালু থাকলেও অন্য মিলগুলোর একেবারে অস্তিত্ব নেই। এসব মিল কাগজে-কলমে চালু দেখিয়ে বিদেশ থেকে লবণ আমদানির ডিও পাওয়ার জন্য সিন্ডিকেট করে দেশের লবণ শিল্প ধ্বংসের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।

তিনি বলেন, দেশে উৎপাদিত সাদা লবণ এসব মেকানিক্যাল মিলগুলোতে অনায়াসে ব্যবহার করা যায়। তাদের চাহিদা মতো লবণও দেশে এখন মজুদ রয়েছে। তারপরও তারা দেশের লবণ শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করে বিদেশ থেকে লবণ আমদানির চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

লবণ চাষী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাওলানা শহিদুল ইসলাম বলেন, চাষীরা আশায় বুক বেঁধেছিল উৎপাদিত লবণ বিক্রি করে খরচ জোগাবে। কিন্তু লবণ বিক্রি করতে না পেরে এখন চরম হতাশায় ভুগছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় চাষীরা লবণ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। হারিয়ে যাবে দেশীয় লবণ শিল্প।

দেশের সম্ভাবনাময় লবণখাত বাঁচাতে লবণ নীতিমালা বাস্তবায়নসহ এগারো দফা দাবি তুলেছেন লবণ চাষের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ লবণ চাষী সমিতির নেতারা বলেছেন, শুধুমাত্র সরকার অনুমোদিত লবণ নীতিমালা প্রয়োগের মধ্য দিয়েই লবণখাত বাঁচানো সম্ভব। আর লবণখাত বাঁচলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাঁচবে।

লবণ চাষী সমিতি সূত্র বলছে, দেশীয় লবণের চাষ ও বাজার সম্প্রসারণ,  লবণ চাষীদের স্বার্থ সংরক্ষণসহ লবণখাতের সম্ভাবনা বিকাশে ২০১১ সালে সরকার জাতীয় লবণ নীতিমালা অনুমোদন করলেও এর কোনো সুফল চাষিরা পাচ্ছে না। নীতিমালার ধারা লঙ্ঘন করে মুনাফালোভী মিল মালিকেরা লবণের ঘাটতি দেখিয়ে বাইরে থেকে লবণ আমদানির পায়তারায় লিপ্ত।

লবণ নীতিমালায় মাঠ পর্যায়ে চাষীদের লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও সেদিকে কারও নজর নেই। কখনো কখনো সরকার লবণের দাম বেঁধে দিলেও তার সুফল চাষীর কাছে পৌঁছায় না। নীতিমালায় লবণ চাষের সুবিধার্থে লবণ চাষীদের সহজ শর্তে ব্যাংকঋণ দেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু এই ঋণ অনেক চেষ্টায় চাষীদের ভাগ্যে না জুটলেও মিল মালিকেরা অনায়াসেই পেয়ে যান।

সরকার অনুমোদিত নীতিমালা বাস্তবায়ন ছাড়াও লবণখাত বাঁচাতে বেশকিছু দাবি তুলে ধরেছে বাংলাদেশ লবণ চাষী সমিতি। এসব দাবি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে লিখিতভাবে বহুবার জানানো হয়েছে। চাষী সমিতির নেতারা বলেছেন, যে কোনো অজুহাতে শিল্প প্রতিষ্ঠান বা যে কোনো প্রতিষ্ঠান কর্তৃক লবণ আমদানি বন্ধ ঘোষণা করতে হবে। চোরাই পথে আনা লবণ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা বলেছেন, লবণের মূল্য মাঠ পর্যায়ে নির্ধারণ করতে হবে। প্রতিবেশী দেশগুলোর মতো উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

চাষী সমিতির দাবিতে উল্লেখ করা হয়েছে, লবণ বোর্ড গঠন করতে হবে এবং লবণ বোর্ডের প্রধান কার্যালয় থাকতে হবে কক্সবাজারে। লবণ চাষকে শিল্প থেকে বাদ দিয়ে একে কৃষিতে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। দাবিতে বলা হয়, পলিথিন পদ্ধতিতে উৎপাদিত লবণের মূল্য প্রতি বস্তা (২মণ) ৪২৫ থেকে ৪৫০ টাকা, মাঠে ধৌত লবণ প্রতি বস্তা ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা এবং কালো লবণ প্রতিবস্তা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা নির্ধারণ করতে হবে। সাদা লবণ উৎপাদনে আগ্রহ বাড়াতে চাষীদের জন্য স্থানীয়ভাবে ন্যায্যমূল্যে পলিথিন সরবরাহের দাবিও রয়েছে সমিতির।

লবণ চাষী সমিতির নেতারা বলেছেন, লবণ চাষের ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের জন্য জমির প্রাপ্যতা একটি বড় সমস্যা। উচ্চমূল্যে জমি বর্গা নিয়ে তারা লবণ চাষ করেন। এজন্য প্রকৃত ভূমিহীন লবণ চাষীদের কাছে লবণের খাস জমি দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত দিতে হবে। একইসঙ্গে ভূমি বন্দোবস্ত পাওয়া ভূমিহীন চাষীদের ভূমিদস্যুদের হাত থেকে বাঁচাতে মুনসেফ নিয়োগ করতে হবে। তিনি লবণ মাঠ নিয়ে হানাহানি, খুনাখুনি, জবরদখলজনিত সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান দিবেন। লবণ চাষীদের নামে আগে গৃহীত ঋণের সুদ মওকুফের দাবি করেছে লবণ চাষী সমিতি। একইসঙ্গে স্থানীয়ভাবে লবণ জমির খাজনা কৃষিজমি সমান করার দাবি জানানো হয়। লবণ চাষীদের প্রতিবছর প্রতি একরে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের দাবি জানান তারা।

লবণ চাষী সমিতির সাবেক নেতা এফ এম নূরুল আলম বলেন, দেশীয় লবণের গুণগত মান বৃদ্ধি করে দেশ লবণ উৎপাদনে যখন স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে রপ্তানির মতো অবস্থায় পৌঁছেছে তখনই এই খাত নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এই ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে হবে, লবণ চাষীদের দাবি মেনে নিতে হবে। তাহলেই দেশীয় এই পণ্যের বিকাশ ঘটবে। বাঁচবে লাখ লাখ পরিবার।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়