ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সমুদ্র সম্পদ নির্ভর ‘ব্লু-ইকোনমি’ সুদিন ফেরাবে

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫১, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সমুদ্র সম্পদ নির্ভর ‘ব্লু-ইকোনমি’ সুদিন ফেরাবে



সমুদ্র সম্পদ নির্ভর নীল অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে উপকূল জুড়ে। যথাযথ উদ্যোগ আর ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্যদিয়ে গোটা বাংলাদেশের অর্থনীতিকেই সমৃদ্ধ করতে পারে সমুদ্র সম্পদ। ২০১৩ সালে মিয়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় পর এই সম্ভাবনা আরও প্রসারিত হয়েছে। ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সামুদ্রিক এলাকায় সম্পদ আহরণের কার্যক্রম চালাতে পারে বাংলাদেশ। সমুদ্রের অতলে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলতে প্রয়োজন ব্যাপক গবেষণার।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সমুদ্র সম্পদ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখবে। সমুদ্র সম্পদের যথাযথ ব্যবহারে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুই ডিজিটে উন্নীত করা সম্ভব। কিন্তু এজন্য সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়নের মধ্যদিয়ে সামনে অগ্রসর হতে হবে। সমুদ্র জয়ের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের সমুদ্র সম্পদের যে সম্ভাবনার দ্বার উম্মোচিত হয়েছে, তার সঠিক ও যথাযথ ব্যবহারটাই এখন সবচেয়ে জরুরি বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

জানা যায়, ১৯৯৪ সালে অধ্যাপক গুন্টার পাউলি ভবিষ্যতের অর্থনীতির রূপরেখা প্রণয়নের জন্য টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব মডেল হিসেবে ব্লু-ইকোনমি বা নীল অর্থনীতির ধারণা দেন। পৃথিবীর দেশগুলো তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত চাহিদা মেটাতে তাকিয়ে আছে সমুদ্রবক্ষে সঞ্চিত সম্পদের দিকে।

গবেষণা সূত্রগুলো বলছে, ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে প্রায় ৯০০ কোটি। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাবার যোগান দিতে তখন সমুদ্রের মুখাপেক্ষী হতে হবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে সমুদ্র অর্থনীতি বহুবিধভাবে অবদান রেখে চলেছে। বছরব্যপী ৩ থেকে ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকান্ড সংঘটিত হচ্ছে সমুদ্রকে কেন্দ্র করে। বিশ্বের ৪ শ ৩০ কোটি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের যোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রতলের বিভিন্ন গ্যাস ও তেলক্ষেত্র থেকে। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের জ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যমে সমুদ্র নির্ভর ঔষধশিল্পও গড়ে তোলা সম্ভব।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বজুড়ে ব্লু-ইকোনোমি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিগত বছরগুলোতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে এ বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। এরমধ্যে ২০১২-এ রিও+২০, সমুদ্র বিষয়ক এশীয় সম্মেলন, ২০১৩ সালে বালিতে অনুষ্ঠিত খাদ্য নিরাপত্তা এবং ব্লু-গ্রোথ ইত্যাদি সম্মেলনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অর্থনৈতিক সহায়তা এবং উন্নয়ন সংস্থা, জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি, বিশ্বব্যাংক, এফএও, ইউরোপীয়ান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার উন্নয়ন কৌশলের মূলেও থাকছে ব্লু-ইকোনোমি।

সংবাদ মাধ্যমের সূত্র বলছে, আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন ছোট বড় দেশ ব্লু-ইকোনোমি নির্ভর উন্নয়ন কৌশল প্রণয়ন করছে। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় অর্থনীতির সিংহভাগ সমুদ্র নির্ভর। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটি এমনকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা গেলে সমুদ্র থেকে আহরিত সম্পদের মূল্যমান জাতীয় বাজেটের দশগুণ হবে। অস্ট্রেলিয়া সমুদ্রসম্পদ থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে। আর ২০২৫ সাল নাগাদ এই আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে সমুদ্র নির্ভর ব্লু-ইকোনোমির মাধ্যমে। সমুদ্র বিজয় সে সম্ভাবনাকে আরও প্রসারিত করেছে।

ব্লু-ইকোনোমি বিষয়ে রিয়ার এডমিরাল এম. খুরশিদ আলম লিখিত ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, ২০১৩-১৪ সালে প্রায় ২৫০০টি বিদেশি জাহাজ বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরে এসেছে এবং ৬৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি রপ্তানি হয়েছে। তবে এসব পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশি মালিকানাধীন মাত্র ৭৪টি (২০১৪) নিবন্ধিত বাণিজ্য জাহাজ রয়েছে, যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। ফলে সামুদ্রিক জাহাজে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থায় বাংলাদেশের আরো অংশগ্রহণ করার ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।

এম. খুরশিদ আলমের নিবন্ধে বাংলাদেশে ব্লু-ইকোনোমি সম্পর্কিত বিভিন্ন শিল্প এবং অবকাঠামো যেমন: জাহাজ নির্মাণ শিল্প, কোস্টাল শিপিং, পরিবেশবান্ধব জাহাজভাঙ্গা শিল্প, সমুদ্রবন্দর, মৎস সম্পদ, সামুদ্রিক জলজ প্রাণির চাষাবাদ, সামুদ্রিক জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার, সামুদ্রিক লবণ উৎপাদন, সামুদ্রিক নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, তেল, গ্যাস ও  অন্যান্য সামুদ্রিক খনিজ সম্পদের অনুসন্ধান, সামুদ্রিক পর্যটনের বিভিন্ন খাত, সমুদ্র অর্থনীতিকেন্দ্রিক মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং পরিকল্পনা প্রণয়নসহ বিপুল সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

চলতি বছরের গোড়ায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক (প্রশাসন) ও গবেষক কবির বিন আনোয়ারের নেতৃত্বে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে পরিচালিত গবেষকদের ২৪ ঘণ্টার সফরে সম্ভাবনার নতুন ক্ষেত্রের সন্ধান পেয়েছেন বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে। গবেষকদের মতে, সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড এলাকা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আশীর্বাদ। খুলে দিতে পারে সমুদ্র গবেষণার নতুন দুয়ার। ডলফিন, তিমি, হাঙর, সামুদ্রিক কচ্ছপসহ আরও বিচিত্র জলজ প্রাণী রক্ষায় ২০১৪ সালের ২৭ অক্টোবর সরকার সোয়াচকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করেছে। ইসাবেলার গবেষকদের দাবি, দেশের সমুদ্র সম্পদ কাজে লাগাতে হলে সমুদ্র গবেষণায় গতি বাড়াতে হবে। কারণ গভীর সমুদ্রে অর্থাৎ সোয়াচের জলের পরতে পরতে অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনা এখনও আমাদের অজানাই রয়ে গেছে।

দেশের বিরাট সমুদ্রসীমায় লিভিং সোর্সের মধ্যে মৎস্য সম্পদের বিশাল সম্ভার রয়েছে বলে দাবি করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সাইন্সেস অ্যান্ড ফিসারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. জামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘সমুদ্রে টুনা জাতীয় মাছ এখনো আমরা আহরণ করতে সক্ষম হইনি। আর নন লিভিং সোর্সের মধ্যে তেল, গ্যাস এবং অন্যান্য খনিজ সম্পদের বিশাল সম্ভার রয়েছে।’ এ ছাড়াও রয়েছে পর্যটন এবং সামুদ্রিক বাণিজ্য বৃদ্ধির বিরাট সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়নের দাবি তাঁর।

সূত্র বলছে, ব্লু-ইকোনোমি কেন্দ্রিক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে প্রায় ২৫টি মন্ত্রণালয় এবং সংস্থার সমন্বয়ে এবছরের ৫ জানুয়ারি জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘ব্লু-ইকোনোমি সেল’ নামে একটি স্বতন্ত্র সংস্থা গঠন করেছে। এই সেলে ২৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই সেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এডিবি, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সমন্বিত কাজ চলছে। এ বিষয়ে তাদের পরামর্শগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। সমুদ্র সম্পদ আহরণে গবেষণার ওপর জোর দিচ্ছে ব্লু-ইকোনোমি সেল। এজন্য জাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এরফলে সমুদ্রসীমায় সিসমিক সার্ভেসহ বিভিন্ন ধরণের গবেষণা পরিচালনা সহজ হবে।

সমুদ্র সম্পদ নির্ভর নীল অর্থনীতি উপকূলসহ সমগ্র বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনবে। সৃষ্টি হবে বৃহৎ কর্মসংস্থানের। গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্প কারখানা। বদলে যাবে বাংলাদেশের চেহারা।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭/রফিকুল ইসলাম মন্টু/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়