ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নারীরাও পারে, দেখিয়ে দিলেন নুরুন্নাহার

শাহীন রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৫ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নারীরাও পারে, দেখিয়ে দিলেন নুরুন্নাহার

পাবনা সংবাদদাতা : নারীরাও যে পারে, জাতীয় কৃষি স্বর্ণপদক জিতে তা দেখিয়ে দিলেন ঈশ্বরদীর কৃষাণী নুরুন্নাহার বেগম।

পরিশ্রম আর মেধাকে কাজে লাগিয়ে তিনি অভিভূত হওয়ার মতই সাফল্য পেয়েছেন। যা তাকে অন্য দশজন নারীর থেকেও ভিন্ন পরিচিতি এনে দিয়েছে।

নুরুন্নাহারের পদক তালিকাও চমকে দেওয়ার মতো। ২০১১ সালে দেশের সেরা নারী কৃষক হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি ব্রোঞ্জ পদক, ২০১৬ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি স্বর্ণ পদক, ২০১৭ সালে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নগদ এক লাখ টাকাসহ রাঁধুনী কীর্তিমতী অ্যাওয়ার্ড, ২০১৭ সালে জাতীয় সবজি পদক, ২০১৮ সালে কেআইবি পদক পেয়ে তিনি দেশের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।

নিবিড় সবজি, ফলমূল, পোল্ট্রি ও গাভির খামার করে এলাকার নারীদের কৃষিকাজে উদ্বুদ্ধ করে  ২০১০ সালে সিটি গ্রুপ জাতীয় পুরস্কার হিসেবে নগদ সাড়ে তিন লাখ টাকা, একটি সার্টিফিকেট এবং একটি ২৪ ইঞ্চি রঙ্গিন টেলিভিশন পুরস্কার লাভ করেন।

নুরুন্নাহার বেগম ঈশ্বরদীর প্রত্যন্ত অঞ্চল ছলিমপুর ইউনিয়নের বক্তারপুর গ্রামের রবিউল ইসলাম বিশ্বাসের স্ত্রী।চার দেয়ালের গন্ডির মাঝে যার নিরিবিলি জীবন-যাপন করার কথা, তিনি এখন রীতিমত একজন সমাজ উন্নয়নকর্মী ও নারী উদ্যোক্তা।

জয়বাংলা নারী উন্নয়ন মহিলা সমবায় সমিতি ও এনসিডিপি গ্রাম উন্নয়ন কমিটির সভানেত্রী নারী উদ্যোক্তা নুরুন্নাহার এক হাজারের বেশি নারীদের সংগঠিত করে তাদের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। যার সাফল্যের গল্পে এখন উজ্জীবিত হচ্ছেন অনেকেই।

২০০৫ সালে টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠান দেখে নুরুন্নাহার উদ্বুদ্ব হয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘স্বামী কাজে বেরিয়ে গেলে একদম অলস বসে থাকতে ভালো লাগতোনা।টেলিভিশনে শাইখ সিরাজের কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান দেখে ইচ্ছে জাগে, বসতবাড়ির আশপাশে শাক-সবজি ও ফলমূলের বাগান গড়ে তোলার।’

প্রথমে লালশাক, পুঁইশাক, বেগুন, গোল আলু, পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচামরিচ বাড়ির আঙ্গিনায় চাষ করে সাফল্য পান। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। সবজি চাষ করে একদিকে সংসারের সারা বছরের চাহিদা মিটে অপরদিকে বাড়তি কিছু আয়ও হয়। পরিশ্রম, অধ্যাবসায়, ধৈর্য্য আর মেধাকে কাজে লাগিয়ে সংগ্রামী নারী কৃষক হিসেবে ইতিমধ্যে তিনি সারাদেশে পরিচিত। পেয়েছেন জাতীয় কৃষি স্বর্ণপদকসহ নানা পুরস্কার। তার দেখানো পথে আজ সফল দেশের আরও অনেক নারী।

নুরুন্নাহার বেগম বলেন, ‘প্রথমদিকে আমার স্বামী বিরক্ত হতেন। ২০০৫ সালে ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান, জাকির হোসেন ও আব্দুর রশিদ নুরুন্নাহারের এলাকায় ব্র্যাক এনসিডিপি’র মহিলা গ্রাম কমিটি গঠনের পর আমাকে দায়িত্ব দিয়ে যান। এতে করে আমার স্বামীর আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে আমি ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে বসতবাড়ির আঙ্গিনায় এবং বাড়ি সংলগ্ন ৫ বিঘা জমিতে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, গাজর, ইত্যাদি ফসলের আবাদ করে আশাতীত ফলন ও লাভবান হই।’

তিনি বলেন, ‘পরের বছর ৩১ আগস্ট ঋণ পরিশোধ করে দ্বিতীয়বারের মত ২০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করি। এ অবস্থায় জানতে পারি বড়ইচারা দক্ষিণপাড়ায় ছিদ্দিকুর রহমান ময়েজের কূল চাষ প্রকল্পের কথা। ময়েজের কাছ থেকে চারা কিনে এনে ১৭৫টি গাছের একটি কূল বাগান গড়ে তুলি। প্রথম বছর কূল বিক্রি করে ২৫ হাজার টাকা লাভ হয়। এছাড়া ৪০টি উন্নত জাতের পেয়ারার গাছও লাগাই আঙ্গিনায়। এভাবেই একের পর এক বাড়তে থাকে আমার কৃষি খামার।’



বর্তমানে নুরুন্নাহারের খামারে ১০০টি গরু,  ৪ হাজার সোনালী মুরগী, ২ বিঘা জমিতে ড্রাগন, ৭ বিঘা জমিতে পেয়ারা, ৬ বিঘায় লিচু, ৫ বিঘায় পেঁপে, ২ বিঘায় কলা, ৪ বিঘায় লাউ, ৪ বিঘায় ফুল কপি, ৪ বিঘায় পেঁয়াজ, ৩ বিঘায় রসুন, ১ বিঘায় টমেটো, ৩ বিঘায় বেগুন, ৩ বিঘায় মটর, ২ বিঘায় গম, ৪ বিঘায় আলু, ২০ বিঘায় মশুর চাষ করছেন।

নুরুন্নাহারের স্বামী রবিউল ইসলাম বিশ্বাস একজন ব্যবসায়ী। জয়নগরের চাউল কল মোকামের একটি মিলে ধান চাউলের ব্যবসা করেন।

কৃষিতে সাফল্য পাওয়ায় নুরুন্নাহারের নাম ছড়িয়ে পড়ে পাবনা জেলা ও জেলার বাইরে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নুরুন্নাহারের কাছে কৃষি কাজের পরামর্শ নিতে ছুটে আসেন অনেকে। নুরুন্নাহারও তাদের মাঝে ছড়িয়ে দেন তার সাফল্যর দিকগুলো। নুরুন্নাহার তার গ্রামের ২০০ নারীকে হাতে কলমে কৃষি কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ কৃষক হিসেবে গড়ে তোলেন।

২০১১ ও ২০১৬ সালে দেশের সেরা নারী কৃষক হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পেয়ে তিনি দেশের মানুষকে তাক লাগিয়ে দেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফল নারী উদ্যোক্তা ও নারী কৃষক নুরুন্নাহারের হাতে তুলে দেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি স্বর্ণ পদক।

ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল লতিফ বলেন, ‘নুরুন্নাহার বেগম পরিশ্রম, ধৈর্য্য, অধ্যাবসায়, সাহস ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে সংগ্রাম করে সাহসীকতার মধ্য দিয়ে কৃষি খামার করে তিনি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা ও খামারী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। পরিশ্রম মানুষকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যায় তার জীবন্ত উদাহরণ নুরুন্নাহার কৃষি খামারের স্বত্তাধিকারী কৃষাণী নুরুন্নাহার বেগম। তার সাফল্য দেখে এখানকার নারীরাও রীতিমতো প্রতিযোগিতামূলক কৃষি কাজে এগিয়ে এসেছেন।’



রাইজিংবিডি/পাবনা/২৫ মার্চ ২০১৮/শাহীন রহমান/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়