ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

সুন্দরবনের গাছপালা : প্রকৃতির এক অনন্য বিস্ময়

অহ নওরোজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৪০, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সুন্দরবনের গাছপালা : প্রকৃতির এক অনন্য বিস্ময়

অহ নওরোজ : মাত্র দশ লাখ বছর আগে মানুষের উদ্ভব ঘটেছে বলে জানা যায়। কিন্তু তার আগে পৃথিবীতে ছিল প্রচুর পরিমানে বৃক্ষ। এদের জন্ম মানুষের জন্মের অনেক আগে।

 

এক সময় আদি মানুষ গভীর বনে, গাছের ছায়ায় বা কোটরে বাস করতো। তাদের জীবন সম্পূর্ণভাবে গাছের ওপরে নির্ভরশীল ছিল। যুগে যুগে মানুষ তার বেড়ে ওঠার গতিপথের পরিবর্তন ঘটিয়েছে কিন্তু গাছের ওপরে নির্ভরশীলতা একেবারেই মুছে ফেলতে পারেনি। সম্ভবত সেটা কখনোই সম্ভব না। আমরা কোনো না কোনোভাবে গাছের ওপর নির্ভরশীল।

 

পৃথিবীর অনন্যা ভূখণ্ডের মতো আদিকাল থেকেই এই ভূখণ্ডের মানুষও গাছের ওপর নির্ভরশীল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই অঞ্চলের মানুষও এককালে প্রচুর পরিমানে গাছের পূজা করতো। বিশেষ করে বট, পিপুল নিম সহ বিভিন্ন গাছের পূজা করার রীতি চালু ছিল বহু আগে থেকেই। এখনো পর্যন্ত অনেক গাছের তলায় পূজার থান দেখা যায়।

 

এই অঞ্চলের বৃক্ষবিস্ময় বলা হয় সুন্দরবনকে। কারণ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। আয়তনের দিক থেকে শুধু নয়, বনজ সম্পদের পরিমান এবং এই সম্পদ আহরণের দিক থেকেও সুন্দরবন অনন্য হিসেবে বিবেচিত।

 

সুন্দরবন নামের ব্যাখ্যা নিয়ে নানা মত রয়েছে। একটি মত হল, বনটি দেখতে সুন্দর তাই সুন্দরবন। আবার অনেকের মতে নামটি সমুদ্রবনের অপভ্রংশও হতে পারে। সমুদ্র তীরের বন থেকে সমুদ্রবন, সেখান থেকে সুন্দরবন। আবার আরেকটি মত হল নামটি এসেছে চন্দ্রদ্বীপ বন থেকে। খুলনার বাকেরগঞ্জের উত্তরাঞ্চলে আদিলপুরে প্রাপ্ত তাম্রলপিতে এই নাম পাওয়া গিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে- সুন্দরবন চন্দ্রদ্বীপের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত। এটি চাঁদের সন্তান ও জোয়ারের জলে সিক্ত। এর নাম চন্দ্রদ্বীপ বন। যা হোক- বর্তমানে মনে করা হয় নামটি এসেছে সুন্দরী গাছ থেকে। পূর্বে সুন্দরী গাছই এই বনে সবচেয়ে সংখ্যায় বেশি ছিল।

 

তবে শুধু সুন্দরবনের সুন্দরী গাছই নয়, রয়েছে শত শত প্রজাতির হাজার রকমের গাছ। গঙ্গা নদীর অববাহিকায় প্রায় দশ লাখ হেক্টর এলাকা জুড়ে পুরো সুন্দরবন এলাকা অবস্থিত। বাংলাদেশের দক্ষিণে-পশ্চিমে ও ভারতের অঙ্গরাজ্য বেঙ্গলের দক্ষিণ পূর্বে এর অবস্থান। বাংলাদেশের অংশে পড়েছে পুরো বনের বাষট্টি শতাংশ। বাংলাদেশের এই অংশের গাছপালা এই দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রাখায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯০৩ সালে প্রকাশিত প্রেইন এর হিসেব মতে সর্বমোট ২৪৫টি শ্রেণী এবং ৩৩৪টি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে এখানে। সুন্দরবনের বাতাস, জল ও মাটি সবই লবণাক্ত। যে কারণে এখানকার গাছপালাও বিচিত্র।

 

পৃথিবীর অন্য অঞ্চলের গাছপালা থেকে এই অঞ্চলের গাছপালার বিশেষত্ব হল, এখানকার প্রায় সব গাছই লবণ সহ্য করতে পারে। দ্বিতীয় বিশেষত্ব হল, এই গাছগুলো নরম কাদার ওপর জন্মায়। তৃতীয়ত, এই সকল গাছ প্রবল হাওয়া এবং প্রচণ্ড স্রোতে অসংখ্য শিকড়ের সাহায্যে এই নরম মাটির ওপর সহজেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। জোয়ারের পানিতে গাছের গোঁড়া সবসময় ধুয়ে গেলেও গাছের কোনো ক্ষতি হয়না। বাতাস থেকে অক্সিজেন ও জলীয় বাষ্প নেওয়ার জন্য এই গাছেদের শূলের মতো সূচালো শ্বাসমূল থাকে। এদের মধ্যে বাইন, কেউড়া, সুন্দরী ও পশুর গাছের শ্বাসমূল স্পষ্ট চোখে পড়ে। খলসী, তোরা, ফলো বাইন গাছে লবণ ত্যাগ করার বিশেষ গ্রন্থি থাকে। গর্জন, গেওয়া ও গরান গাছে রণপার মতো অসংখ্য ঠেসমূল দেখা যায়। এসব গাছের শিকড়গুলো জলের ধাক্কা সামলাতে ও শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে গাছকে সাহায্য করে।

 

যেখানে জল ও মাটি কম লবণাক্ত সেখানে সুন্দরী, গর্জন ও কাঁকড়া গাছ ভালো জন্মায়। বিশেষ করে যেখানে নদীর জল মিষ্টি পানি নিয়ে আসে ও বেশি পলি জন্মায় সেখানে সুন্দরী গাছ খুব বেশি সংখ্যায় জন্মায়। গেওয়া ও গরান জন্মায় বেশি লবণাক্ত জমিতে। হেঁতাল জন্মায় অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের গাছপালা থেকে সুন্দরবনের গাছপালার এমন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য থাকার কারণে এই বনকে এ অঞ্চলের বিস্ময় বলা হয়ে থাকে।

 

তবে টিকে থাকার দিক থেকে গাছগুলো অন্য অঞ্চলের গাছ থেকে শুধু যে পৃথক তা নয়। ফল পাতার দিক থেকেও এর ভিন্নতা আর বাহারি ঢং মনে রাখার মতো। সুন্দরবনের প্রায়ই সবখানে গর্জন গাছের দেখা পাওয়া যায়। এই গাছের পাতা রবার গাছের পাতার মতো পুরু। ফুল ছোট, আর ফল হয় বকফুল কিংবা সজনের ফলের মতো লম্বাটে। কাঠ লালচে ধূসর বর্ণের। কাঠ খুব টেকসই নয়। কাঁকড়া গাছের পাতাও কিছুটা গর্জন গাছের পাতার মতো দেখতে হয়। তবে এ গাছের ফুলের বৃন্ত লাল কাঁকড়ার পায়ের মতো দেখায় বলে একে কাঁকড়া গাছ বলা হয়ে থাকে। এর কাঠ মজবুত এবং শক্তিশালী হওয়ার কারণে ঘরের ছাদের বীম হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

 

সুন্দরবনের গাছগুলোর মধ্যে সবথেকে আকর্ষণীয় হল সুন্দরী গাছ। সুন্দরীর পাতা ছোট, লবঙ্গের পাতার অনুরূপ আকারবিশিষ্ট। পাতার পৃষ্ঠভাগ মসৃণ। এর অঙ্কদেশ বা নিচের অংশ ধূসর। ঝিরঝির মলয় হিল্লোলের এর আন্দোলিত পাতা দেখতে দৃষ্টি সুখকর। সুন্দরীর ফুলও আকারে ছোট। বর্ণ হলুদ। সুন্দরী গাছ লম্বায় ১০-২৫ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। সম্পূর্ণ বড় হয়ে গেলে কিছুটা বড়সড় জাম গাছের মতো দেখায়। সুন্দরীর গুড়ির বেড় ২০-২৫ সেন্টিমিটারের মতো হয়ে থাকে। কাঠ গাঢ় লাল এবং শক্ত। এর কাঠ খুবই মূল্যবান। তবে পূর্বের তুলনায় সুন্দরবনে এই গাছ প্রায় ৪৫ শতাংশ কমে গেছে। ‘আগা মরা’ রোগের কারণে এই গাছ কমে যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এই রোগ ক্রমে বেড়েই চলছে, অথচ সেটা নিয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো মাথাব্যথা নেই। যদি এই রোগে একদিন সব গাছ মরে যায় তাহলে সুন্দরী গাছহীন সুন্দরবন কি আমরা কখনোই মেনে নিতে পারবো!

 

গেওয়া ও গরান গাছ জন্মায় সবথেকে লবণাক্ত জমিতে। গেওয়া খাড়া হয়ে উঠে যায়। এর গাছ থেকে সাদা কষ বের হয়। এই কষ খুবই বিষাক্ত এবং আঠালো। এই গাছের কাঠ হালকা। এই গাছের বড় বড় গুড়ি দিয়ে তৈরি হয় ঢোল এবং তবলা। গরান গাছ প্রায় ৩-৪ মিটার উঁচু হয়। এই গাছগুলো ঝাড়বিশিষ্ট। এক ঝাড়ে অনেক কয়টি গাছ থাকে। কাঠ অতি শক্ত, গাছের ভেতরের রঙ লাল।

 

তবে হেঁতাল গাছ লবণাক্ত জমিতে কম জন্মায়। এই গাছ জন্মায় উঁচু জমিতে, দেখতে অনেকটা খেজুর গাছের মতো। এক জায়গায় অনেক হেঁতাল ঝাড় দেখা যায়। হেঁতাল দৈর্ঘ্যে ৫-৬ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। হেঁতালের গাছের আশে পাশে বাইন গাছও দেখা যায়। তবে নতুন পলি জমে যে ভূখণ্ড জেগে ওঠে তাতে বাইনের বন বেশি গড়ে উঠতে দেখা যায়। বাইন বেশ বড় গাছ, এর আয়ুও বেশ দীর্ঘ। এই গাছে ভালো তক্তা হয়। বাইনের মতো পশুর গাছও বড় গাছ। পশুরের পাতা অনেকটা কাঁঠালের পাতার মতো। আবার ধুতুল গাছও অনেকটা পশুর গাছের মতো দেখতে। তবে পশুর থেকে এর ফলের আঁকার বেশ বড় হয়। সুন্দরী কাঠের পরে পশুর এবং ধুতুল গাছের চাহিদা রয়েছে।

 

সুন্দরবনের অন্যসব গাছের মতো কেওড়া গাছ মানুষের কাজে খুব একটা না লাগলেও সুন্দরবনের বানর এবং হরিণ অনেকাংশে এই গাছের ওপর নির্ভরশীল। নদী ও খালের ধারে এই গাছ জন্মায়। এর ফলের স্বাদ টক। কেওড়া ফলের চাটনি মুখরোচক।

 

কেওড়ার মতো নদীর ধারে পরশ গাছও জন্মায়। নদীর ধারে পরশ গাছের ঝাড় দেখা যায়। সুন্দরবনে হেঁতাল ঝাড় ছাড়াও পরশ, হেদো এবং গোলপাতা ঝাড় এই বনের একটি বিস্ময় বলা যায়। সুন্দরবনের অন্যতম প্রধান প্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আস্তানা এই গাছসমূহের ঝাড়গুলো। পরশ গাছের পাতা গোল। ফুল হলুদ রঙের। এছাড়া নদীর ধারে জন্মায় হরগোজা নামের একপ্রকারের গাছ। এই গাছে কাঁটা ভর্তি থাকে। চর এলাকার নদীর ধারে ওরাধান, ঝাও বনলেবুর দেখা পাওয়া যায়।

 

সুন্দরবনের অন্যতম খ্যাতিমান গাছ হল গোলপাতা। নারকেলজাতীয় এই গাছটি মাটির ওপরে মুলাকৃতির কাণ্ড থেকে নারিকেল বা তাল পাতার মতো সরাসরি বেরিয়ে আসে। শাখাহীন এই গাছের ফল আকারে প্রায় ফুটবলের মতো বড়। এর ফল খেতে বেশ সুস্বাদু, কিছুটা তালের শ্বাসের মতো। এই গাছের পাতা দিয়ে ঘর ছাওয়া যায়। সুন্দরবন থেকে প্রতিদিনই প্রচুর পরিমানে এই গাছ নিধন করা হয় যে কারণে এই গাছ হুমকির মুখে রয়েছে।

 

শুধু তাই নয় সুন্দরবনের গোলপাতা ছাড়াও অন্য শত শত রকমের গাছ রয়েছে যেগুলোর প্রত্যেকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মনুষ্যসৃষ্টি বিভিন্ন সমস্যার কারণে হুমকির মুখে রয়েছে।

 

সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ না করে যদি এই অবস্থা চলতে থাকে তাহলে একদিন বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি হারাবে সুন্দরবন। বিপর্যস্ত হবে এ অঞ্চলের প্রকৃতি। আমরা হারাব অনন্য আশ্চর্যের এই বৃক্ষলীলা। যে কারণে সুন্দরবনের প্রত্যেকটি গাছের রক্ষণাবেক্ষণ খুবই জরুরি।

 

তথ্যসূত্র:

* বাংলাদেশ এগ্রো ফরেস্ট্রি প্লান (১৯৯০-১৯৯৫) ব্রাক ১৯৯১

* ফরেস্ট অ্যান্ড ফরেস্ট্রি : সারগেই কেপি, ন্যাশনাল বুক ট্রাষ্ট, ইন্ডিয়া, পঞ্চম সংস্করণ ১৯৯৪

* সুন্দরবন : রবীন্দ্রনাথ দে, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ

* বাংলাদেশের বন ও বনাঞ্চল : তপন চক্রবর্তী

* বাংলার বৃক্ষ : দ্বিজেন শর্মা

* শ্যামলী নিসর্গ : দ্বিজেন শর্মা

* অন্যান্য

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ ডিসেম্বর ২০১৬/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়