ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

রক্তঝরা ৩ মার্চ স্মৃতিতে অম্লান

নজরুল মৃধা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১২, ৩ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রক্তঝরা ৩ মার্চ স্মৃতিতে অম্লান

শঙ্কু সমজদার

নজরুল মৃধা : ১৯৭১ সাল, উত্তাল ৩ মার্চ। চারিদিকে স্বাধীনতার গান। এদিন ছিল রংপুরের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। স্বাধীনতা সংগ্রামে রংপুরে প্রথম প্রাণ দেয় ১১ বছরের বালক শঙ্কু সমজদার। সেদিন মিছিলে যে ২০-২৫ জন শিশু কিশোর ছিল তার মধ্যে আমিও একজন। সাইনবোর্ড ভাঙার কাজে ছোটদের দুটি দল ছিল। একটি মিছিলের পেছনে আরেকটি মিছিলের সামনে। উর্দু ও ইংরেজি লেখা সাইন বোর্ড ভাঙার কাজ ছিল আমাদের। সব সময় মিছিলের আগে অথবা পেছনে থাকত এই ছোটদের দল।

উর্দু ভাষার সাইন বোর্ড ভাঙতে গিয়ে অবাঙালির গুলিতে প্রাণ প্রদীপ নিভে যায় শঙ্কুর। নিজের চোখের সামনে দেখেছি শঙ্কুর মাথা ভেদ করে যায় শরফরাজ নামের ওই অবাঙালির বন্দুকের গুলি। একাত্তরের কথা স্মরণ করলে প্রথমেই আসে শঙ্কুর মায়ের দুঃখের কথা। চোখের পানি আর মনের আশা নিয়ে এখনও বেঁচে আছেন তিনি।

স্বাধীনতার জন্য রংপুরে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের মৃত্যুবার্ষিকী পালনের সময় স্থানীয় প্রশাসন ও সুধী মহলের সাধুবাদ আর কিছু প্রাইজবন্ড তার সঙ্গী হয়। তার নাম দিপালী সমজদার। দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রথম প্রাণত্যাগকারী বালক শঙ্কু সমজদারের গর্বিত মা তিনি। শঙ্কু সমজদারের বাবা স্বর্গীয় সন্তোষ কুমার সমজদার।

শঙ্কুর বাল্যকাল কেটেছে রংপুর নগরীর গুপ্তপাড়া এলাকায়। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ রংপুরের এই মা তার ছেলে শঙ্কুকে ঘরে ধরে রাখতে পারেননি। দেশ মাতৃকার টানে সেদিন রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে শঙ্কু। এরপর আর ঘরে ফেরেনি। শঙ্কু প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শেষ করে রংপুরের সেনপাড়া বিদ্যালয়ে। এরপর ভর্তি হয় শহরের কৈলাশরঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ে। তার বয়স তখন ১১। ক্লাস সেভেনে পড়ে। আমিও রংপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সেভেনের ছাত্র। একাত্তরের ৩ মার্চ সকালে পড়তে বসেছিলো শঙ্কু। সকাল সাড়ে ৯টায় মিছিলে অংশ নেয়ার কথা বলে বেরিয়ে যায়। অংশ নেয় মিছিলে। শঙ্কুর গুলি লাগার খবর আসে সকাল ১১টা ৩০ মিনিটে।

শঙ্কুকে হারানোর মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন দেশ ও লাল সবুজের পতাকা পেয়ে সব দুঃখ তিনি ভুলে থাকার চেষ্টা করেছেন। এ পতাকার মাঝেই তিনি এখন তার শঙ্কুকে খুঁজে পান। আজ দেশের অনেক শঙ্কুই তাকে মা বলে ডাকে। শঙ্কুর স্মরণে আজও রংপুর বা দেশের কোথাও গড়ে ওঠেনি একটি স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা ভাস্কর্য।

কেমন আছেন এই মা? আজকের রংপুর নগরীর কামাল কাছনা প্রাক্তন পেট্রোল পাম্পের গলিতে ‘শঙ্কু ভিলা’ নামের একটি বাসায় থাকেন তিনি। তার বয়স ৯৪ বছর। তার সাথে থাকেন  বড় ছেলে কুমারেশ সমজদার, পুত্রবধূ আর নাতী-নাতনী। নূন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের পরিবারে। কুমারেশ সমজদার রংপুর প্রেসক্লাবের সামনে একটি পানের দোকান করেন।

কি ঘটেছিল সেদিন -
সকাল থেকে রংপুর সদর এলাকা ছিলো উত্তাল। সকাল বেলা বাসা থেকে পৃথকভাবে বেরিয়ে পড়ে দুই ভাই কুমারেশ সমজদার ও শঙ্কু সমজদার। শহরের প্রধান সড়কে আসতেই তারা দেখে উত্তাল মিছিল। তারা যোগ দেয় মিছিলে। রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির মাঠ থেকে শুরু হওয়া মিছিলটি সকাল সাড়ে ৯টায় রেলস্টেশন হয়ে আবার শহরের দিকে এগুতে থাকে। ঘোড়াপীর মাজারের কাছে শঙ্কুর চোখে পড়ে উর্দুতে লেখা একটি সাইন বোর্ড। শঙ্কু এগিয়ে যায় ঐ সাইন বোর্ডটি নামাতে। আমরা বেশ কজন সে সময় শঙ্কুর পাশেই ছিলাম। সাইনবোর্ডে কেউ কেউ ঢিল ছুড়ছিল। ঠিক তখনি পাশের বাড়ির অবাঙালী সরফরাজ খাঁন গুলি চালায়। একজন পাশ থেকে বলে উঠলো গুলি করছে, মাথা নিচু কর। আমরা মাথা নিচু করে কিছুটা সরে আসি। কিন্তু গুলি শঙ্কুর মাথা ভেদ করে বেরিয়ে যায়। তার দেহ লুটিয়ে পড়ে। স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার ২২ দিন আগে আন্দোলনমুখর বাংলায় সর্বপ্রথম রংপুরে প্রাণ দেয় বালক শঙ্কু।

পরিবারের সদস্যদের সাথে শঙ্কু সমজদার (মাঝে)


তার সেই আত্মত্যাগের স্মৃতি আজো অমলিন। আমাদের পাড়ার ৮/১০ জন শিশু-কিশোর মিছিলে কখনো সামনে আবার কখনো পিছনে থেকে উর্দু অথবা ইংরেজি লেখা সাইন বোর্ড নামিয়ে ভেঙে ফেলতাম। শঙ্কুও সেদিন সাইন বোর্ড ভাঙতে চেয়েছিল। সে সময় সাহসী ভূমিকা রেখেছেন মুসলিম উদ্দিন। তিনি লাঠি হাতে বেরিয়ে আসেন এবং হাঁক ছেড়ে মিছিলের পলায়নপর কিছু মানুষকে একত্রিত করে শঙ্কুকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। তিনিই কোলে করে নিয়ে আসেন শঙ্কুর নিথর দেহ। হাসপাতালে নেয়া হলে শঙ্কুকে মৃত ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে মুসলিম উদ্দিন পৌর কমিশনার নির্বাচিত হন। তিনি এখন বেঁচে নেই।

স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম শহীদ হিসেবে ২০১২ সালে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছে রংপুরের শঙ্কু সমজদার। বর্তমান সরকার শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় শঙ্কু সমজদারের নাম অন্তর্ভূক্ত করেছে। ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের এক অনুষ্ঠানে সরকারি নির্দেশে ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় রংপুর জেলা প্রশাসন শঙ্কুর স্মৃতি রক্ষায় নগরীর কামাল কাছনা এলাকায় তার পৈত্রিক ভিটা সংলগ্ন বেদখল হয়ে যাওয়া ১০ শতক জমি উদ্ধার করে জমির দলিলপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে শঙ্কুর মায়ের কাছে হন্তান্তর করেছে।

দেশের স্বাধীনতার জন্য রংপুরবাসীর আন্দোলন-সংগ্রাম অতীতের কোন সরকারের দৃষ্টি আর্কষণ করতে পারেনি। ফলে অতীতের কোন সরকার শঙ্কুর আত্মত্যাগকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর স্মৃতি রক্ষায় কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। কিন্তু রংপুরের সাধারণ মানুষ কখনোই হাল ছেড়ে দেয়নি। তারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে শঙ্কুকে শহীদের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে নানাভাবে চেষ্টা ও সহযোগিতা করেছে।

৩ মার্চ রংপুরবাসীর কাছে ‘শঙ্কু দিবস’ হিসেবে চির স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। দিবসটি পালনে প্রতি বছরের মতো এবারও রংপুরের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও নবগঠিত শঙ্কু স্মৃতি সংসদ আলোচনা সভা ও বিস্তারিত কর্মসুচির আয়োজন করেছে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ মার্চ ২০১৭/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়