ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘পয়লা বৈশাখ উদযাপনে আন্তরিকতার পরিসর কমছে’

আরিফ সাওন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২০, ১৪ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘পয়লা বৈশাখ উদযাপনে আন্তরিকতার পরিসর কমছে’

সেলিম খান, রাজীব খান, বদিউজ্জামান সোহাগ

আরিফ সাওন : পয়লা বৈশাখ বাঙালির সার্বজনীন উৎসব। আশি-নব্বই দশক থেকে বর্তমানে নববর্ষ উদযাপনের পরিসর অনেক বেড়েছে। কিন্তু বিভিন্ন প্রাসঙ্গিকতায় বৈশাখ উদযাপনে আন্তরিকতার পরিসর ছোট হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্টজনেরা।

বিশিষ্ট সাংবাদিক সেলিম খান। বাড়ি সিরাজগঞ্জে। তিনি দেশের বিভিন্ন নামীদামী সংবাদ মাধ্যমে মুখ্য দায়িত্ব পালন করেছেন। বৈশাখের স্মৃতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগে বৈশাখ হতো সর্বজনীনভাবে। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করতাম। কিন্তু সেই জায়গা থেকে স্বাধীনতার পর কেন জানি ধীরে ধীরে একটা বাজে অবস্থায় চলে গেল। এটাকে একটা সাম্প্রদায়িক ব্যাপারে পরিনত করা হচ্ছে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো এটাকে সাম্প্রদায়িক বিষয়ে পরিনত করছেন যে, এটা হিন্দুয়ানী বিষয়। কিন্তু আসলে তো এটা হিন্দুয়ানি বিষয় না। এটা হচ্ছে সম্রাট আকবর তার খাজনা আদায়ের জন্য বৈশাখের প্রচলন করেছিলেন। সেই দৃষ্টিতে যদি ধরতে যাই তাহলে এটা একান্ত মুসলমানদের বিষয়। কারণ, সম্রাট আকবর মুসলমান ছিলেন।

একটা সময়ে বৈশাখ হয়ে যায় আমাদের এই বঙ্গের বাঙালির কালচার। বাঙালির কালচার বলতে বাঙালি মুসলমান আছে, হিন্দু আছে, বৌদ্ধ আছে- সবারই কালচার এটা। আগে দেখেছি এখানে সবাই আমরা পার্টিসিপেট করতাম। সিরাজগঞ্জ আমাদের তো হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। স্বাভাবিক ভাবে হিন্দুরা ঢাক, ঢোল, চরকপুজা, চৈত্রসংক্রান্তি ও বৈশাখের সাথে জড়িয়ে যায়। আর আমাদের ছিলো হালখাতা। হালখাতা হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে হতো। তখন কিন্তু এটাকে এতোটা ধর্মীয় বিষয় মনে করা হতো না।

আমি কালকে এক সেলসম্যানকে জিজ্ঞাসা করেছি যে, পয়লা বৈশাখে কী করবেন? তিনি বলেছেন, আমি তো ওই দিন বের হবো না। কেন বের হবেন না জানতে চাইলে তিনি বলেন- এটা তো আমাদের বিষয় না। তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো?

কষ্ট লাগে এ কারণে যে, আমরা এ উৎসবকে সার্বজনীন জায়গা থেকে সাম্প্রদায়িক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি। এ জায়গা থেকে উত্তোরনের জন্য মানুষকে সচেতন হবে যে, এটা আমার উৎসব, আমাদের উৎসব। এটা উৎসব। এটার সাথে ধর্ম, রাষ্ট্র– এগুলোকে জড়ানোর কোন মানে হয় না। আরেকটা জিনিস যেটা জড়িয়ে গেছে, তা হল কর্পোরেট। এটা বাণিজ্য বিষয়ে পরিনত হয়ে গেছে। এর মধ্য দিয়ে সবার পার্টিসিপেট কমে যাচেছ। সম আনন্দের জায়গা কমে যাচ্ছে, সবার আনন্দের জায়গা কমে যাচ্ছে।’

রাজীব খান। বাড়ি ফরিদপুরে। বর্তমানের তিনি আরটিভির ডেপুটি সিএনই পদে দায়িত্বে রয়েছে। বৈশাখের স্মৃতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় অনেক বড় পরিসরে বৈশাখ উদযাপন হয়। কিন্তু গ্রামগঞ্জে আগে যে আন্তরিকতা দেখেছি ঢাকায় তেমন নেই। এখানে বৈশাখ উৎযাপনের পরিসর যত বড় আন্তরিকতার পরিসর ততো ছোট। এখন যা হয়, তা হলো লোক দেখানো। কে কতোটা সাজতে পারে। ছোটবেলায় গ্রামে বৈশাখ উদযাপনে আমরা কিন্তু সাজসজ্জার দিকে গুরুত্ব দিতাম না। আমরা পাড়ায় পাড়ায় বৈশাখী মেলা করতাম। দুই দিনের, তিনদিনের, পাঁচদিনের, সাতদিনের মেলা হতো। ওই মেলাই ছিলো আমাদের আনন্দের কেন্দ্র বিন্দু, আমাদের উৎসব। মেলায় আমরাই বিভিন্ন ধরনের দোকান দিতাম।

এই মেলাগুলোয় সকলের সাথে দেখা হতো। বন্ধু, বান্ধব বা আত্মীয় যারা সারা বছর দূরে থাকতেন বৈশাখী মেলার জন্য তারাও চলে আসতেন। বৈশাখের মেলা মিলনমেলায় পরিনত হতো। এখন যেমন গরমের দিনে মেলা হচ্ছে। তখন কিন্তু এতো গরম ছিলো না। এখন গরমের মাত্রা বেড়েছে। পাশাপাশির মানুষের মনের গরমের মাত্রাও বেড়েছে। এখন একটা ভয় কাজ করে। আমরা গ্রামে যখন উৎসব উৎযাপন করেছি তখন কিন্তু কোন ভয় ছিলো না। এখন প্রদর্শনের ব্যাপরটা বেশি। এখন যেমন ইলিশের একটা প্রচলন দেখছি। তখন এমন প্রচলন ছিলো না। তখন ইলিশ পর্যাপ্ত ছিলো। আমাদের খাবাবের তালিকায় প্রতিদিন ইলিশ থাকতো। এখন যেমন রকমারি, সরষে ইলিশ, ভাজা ইলিশ- এটা ছিলো না।

আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে, সন্ধ্যায় ফেরার পথে বাজার করে নিয়ে আসতেন। বাজার মানে আমরা যেহেতু পদ্মা পাড়ের মানুষ, ইলিশ থাকতোই। রাতে মা কেটে কুটে জাল দিয়ে রাখতেন। সকালে আমরা সেই ইলিশ পান্তা ভাতে খেতাম। বলতে গেলে এমন প্রায়দিনই হোতো। বৈশাখ উপলক্ষে কিন্তু না বা লোক দেখানো ইলিশ খাওয়া না। এখনকার পয়লা বৈশাখে এই দেখানো ইলিশ খাওয়ায় সেই জাল দেওয়া ইলিশের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় না।

ছাত্রলীগের প্রাক্তন সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ। বাড়ি বাগেরহাটে। শৈশব কেটেছে সেখানে। পয়লা বৈশাখী স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এলাকায় বৈশাখী মেলা হতো। বিভিন্ন কালচারাল প্রোগাম হতো। ছোটবেলায় এ ধরনের অনেক অনুষ্ঠানে আমি উপস্থাপনার সুযোগ পেয়েছি। আমার জীবনের এই স্মৃতিগুলো বারবার ফিরে আসে। বাংলাদেশে আসলে দিনটি চৌদ্দশ বঙ্গাব্দের পরে ব্যাপক ভাবে উদযাপিত হচ্ছে। তার আগে কিন্ত পয়লা বৈশাখ উদযাপন বলতে গেলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ছিলো। বর্তমানে সরকারও এই অনুষ্ঠান উদযাপনের ব্যাপারে খুবই আন্তরিক। উৎসাহ দিচ্ছে, উৎসব ভাতা দিচ্ছে।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ এপ্রিল ২০১৭/সাওন/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়