ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কোন পথে বাংলা সিনেমা || ছটকু আহমেদ

ছটকু আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০২, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কোন পথে বাংলা সিনেমা || ছটকু আহমেদ

আমাদের চলচ্চিত্র কী ছিলো, কোন দিকে যাচ্ছে? এর উত্তরে এক কথায় বলা যায়, আমাদের ছিলো অনেক কিছুই, এখন মহাগতিতে পতনের দিকে যাচ্ছে। তবে এই লক্ষ্মণ আমি খারাপ মনে করি না। বাঙালির চরিত্র যতটুকু বুঝেছি, দেয়ালে পিঠ না ঠেকলে বাঙালি ঘুড়ে দাঁড়ায় না। আমাদের কোনো দাবি রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ছাড়া আসেনি। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি, ৬-দফা দাবি, ১১-দফা দাবি, স্বাধিকারের দাবি- সবই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বাস্তবায়িত হয়েছে। মোদ্দা কথা কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হবে। চলচ্চিত্র এখন দিতে শুরু করেছে। চলচ্চিত্রপ্রেমী কলাকুশলী শিল্পীদের শিরায় উপশিরায় রক্তে টান না লাগলে এদের বোধোদয় হবে না। বুঝতে পারবে না, তারা কীভাবে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছে। কিছু বেনিয়া স্বার্থলোভী চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে ডোবানোর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে। কারা কী চুক্তি করছে, কেন করছে, কার স্বার্থে করছে, কেউ বুঝতে পারছে না। সব জায়গায় অদক্ষ লোকের ছড়াছড়ি। চলচ্চিত্রের এ বি সি ডি না-জেনে নীতি নির্ধারক সেজে বসে আছেন!

কলকাতার দিকে তাকান। বড় বাজেটের ছবি মুখ থুবড়ে পড়ছে। মাদ্রাজি ধুমধাড়াক্কা গল্পবিহীন ছবি রিমেক করে এখন আর দর্শক হলে টানতে পারছে না। তারা ছবির স্বত্ব টেলিভিশনে বিক্রি করে দর্শককে হলবিমুখ করছে। আমাদের দেশের কিছু টেলিভিশন চ্যানেলও একই কাজ করছে। তারা টিভি পর্দায় দর্শক ফিরিয়ে আনতে বাঘা বাঘা চলচ্চিত্র পরিচালকদের দিয়ে সিনেমা বানাতে টিভিতে নিয়ে এলো। অন্যদিকে বাঘা বাঘা নাট্যপরিচালকদের সিনেমা হলে ঢুকিয়ে দিলো। ফলে দুই জায়গাতেই ধ্বস নামল। সিনেমার দর্শক নাটক দেখতে চাইছে না, নাটকের দর্শক সিনেমা দেখতে চাইছে না। চ্যানেলগুলো জাতীয় পুরস্কার, বিদেশি পুরস্কার দিয়ে শোকেস ভরে ফেললো। অন্যদিকে চলচ্চিত্র যাকে বলা হয় বৃহৎ গণমাধ্যম, সেখান থেকে তারা দর্শকদের ঝেটিয়ে বিদায় করে দিলো।
অনেকে বলেন, এখন আগের মতো হলে দর্শক যায় না। কেন যাবে? দর্শক ঘরে বসে যখন বিনে পয়সায় রিমোট টিপে, ইচ্ছেমতো টিভির চ্যনেল ঘুড়িয়ে সহজেই বিদেশের একশ কোটি টাকার চোখ ঝলসানো ছবি, নায়ক নায়িকার যৌন রগড়, এমনকি বেডসীন পর্যন্ত দেখতে পারেন, তখন বোকার মতো টাকা খরচ করে, অসহনীয় রাস্তার জ্যাম পাড়ি দিয়ে, সিনেমা হলের দূষণীয় পরিবেশে কেন তারা যাবেন?

যদি যায়ও, গিয়ে কোটি টাকা খরচ করা বাংলাদেশের ছবি, যেখানে নায়িকার শাড়ি বাতাসে উড়লেও নাভি দেখানো যাবে না, স্কার্ট পরলেও হাঁটু বের হতে পারবে না, লো-কাট ব্লাউজ পরলেও ক্লিভেজ দেখা যাবে না, বৃষ্টিতে ভিজলেও শরীরের বাঁক স্পষ্ট হবে না, চুমু দূরস্ত সামান্য যৌন দৃশ্যও সেন্সর বোর্ডের কল্যাণে দর্শক দেখতে পারবেন না- সেখানে ডিজিটালের নামে ফিজিক্যাল চলচ্চিত্র তারা কেন দেখবেন? চলচ্চিত্র দর্শক এতো বোকা নন। তারা সিনেমা হলে চলচ্চিত্র দেখতে চান, চুইংগামের মতো টেনে বড় করা কোনো মেগা সিরিয়াল বা টেলিফিল্ম নয়। আরও একটি কারণ হচ্ছে, মাদ্রাজি গল্পের চর্বিতচর্বন ছবির প্রতি দর্শকের অনীহা। প্রতি সপ্তাহে একই গল্প একটু হেরফের করে কতদিন দেখানো যায়? প্রতিদিন পোলাও মাংস খেতে মানুষের ভালো লাগে না। সেখানে যদি দিনদিন খারাপ বাবুর্চি দিয়ে ভালো মসলা ছাড়াই রান্না হয়, তাহলে তো মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেবেই।

চলচ্চিত্রে গল্পের ভেরিয়েশান এখন দর্শক পান না। এ কারণেও দর্শক সিনেমা হলে যান না। যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ মন্ত্রীদের, টেকনোক্র্যাটদের, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যায় অত্যাচার অবলীলায় পর্দায় দেখিয়ে দর্শকের বাহবা পাচ্ছে, সেখানে আমাদের চলচ্চিত্রে এগুলো কিছুই দেখানো যায় না। পাশের দেশের বিশাল বাজেটের উত্তেজক যৌন দৃশ্য সংযোজিত ছবি, আমাদের কম বাজেটের রক্ষণশীল মার্কা সেন্সর বোর্ড থেকে পাশ করা ছবি, প্রতিযোগিতায় কখনও টিকতে পারবে না- এই সোজা কথাটা কারো মাথায় নেই। থাকবে কী করে? সেন্সর বোর্ডের দিকে তাকিয়ে দেখেন সেখানে ক’জন চলচ্চিত্র বোদ্ধা রয়েছেন। তারা কি কখনও ছবি বানিয়েছেন? সত্য প্রকাশ করতে না দিলে অসত্য প্রকাশিত হবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের চলচ্চিত্রে তাই ঘটছে। তবুও এক শ্রেণীর দর্শক সিনেমা দেখছেন। তাদের কাছে দেশ প্রিয়, দেশের শিল্পী প্রিয়, দেশের গল্প প্রিয়, দেশের মাটি ও সংস্কৃতি প্রিয়। সেসব চলচ্চিত্রে তারা নিজেদের সুখ-দুঃখ খুঁজে পান। সহজ সরল গল্পে নিজের জীবন আবিষ্কার করেন। চরিত্রের দুঃখে বুক ফেটে কান্না আসে, খুশি হলে আনন্দ পান। সেসব সিনেমা আপনাদের ভাষায় কমার্শিয়াল ফিল্ম; ভালো চলচ্চিত্র নয়। অথচ ভালো চলচ্চিত্রের সহজ সংজ্ঞা হলো, যে চলচ্চিত্র সব শ্রেণীর দর্শক গ্রহণ করবে।

নিজেদের কপালে ইন্টেলেকচুয়াল তকমা লাগানো কিছু জ্ঞানমূর্খদের একথা কেউ বোঝাতে পারবে না। ফিল্ম ক্লাবে বা সেমিনারে অথবা বড়জোড় সিনেপ্লেক্সে শতকরা দশভাগ লোককে ছবি দেখিয়ে এরা প্রমাণ করতে তৎপর হয়ে ওঠে যে, এরা ভালো ছবির নির্মাতা। আর দেশের সরকার, মিডিয়া সবাই এদের এমন করে মাথায় তুলে নাচায় যে, এরা নিজেদের অসাধারণ ভাবতে শুরু করে। আর তখনই এরা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। তাই এদের চলচ্চিত্র দর্শকপ্রিয় হয় না। নব্বই ভাগ দেশের খেটে খাওয়া জনগণ যাদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম চলচ্চিত্র তারা ভালো নির্মাতাদের খুব কম ছবিই দেখতে পেয়েছে। এদের ছবি দেখে তারা বলতে পারেনি- আহা কী দেখলাম! ইদানিং কিছু ভালো নির্মাতা নিজেদের নির্লজ্জের মতো নামী-দামি প্রমাণ করার জন্যে এই নব্বই ভাগ সাধারণ দর্শককে ঠেলে দিচ্ছে অর্ধশিক্ষিত নির্মাতাদের বানানো অশ্লীল ছবি, মারদাঙ্গা ছবির ভাড়ামো দেখতে। যারা ভালো নির্মাতা তারা নিজেদের একটা বাধাধরা গণ্ডির মধ্যে বেঁধে ফেলেছেন। তারা ভালো ফিন্যান্স পান, ভালো স্পন্সর পান। কিন্তু এই ভালোটার রেজাল্ট সাধারণ দর্শক পান না। তারা নিজেরাই ভালোটার স্বাদ আস্বাদন করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন।

আমি একটি বিষয় বুঝতে পারি না, সহজবোধ্য বিনোদন, যা প্রতিদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর দর্শককে বিনোদিত করবে, তাদের হাসাবে, কাঁদাবে, ভাবতে শেখাবে সে-রকম ছবি বানাতে দোষ কোথায়? সবাই সত্যজিৎ রায় হতে চান, কাজি জহীর হতে চান না কেউ। শুধুমাত্র আর্টফিল্ম ভালো ছবি, এ ধরনের বিনোদনের ছবিগুলো ভালো নয়- এই চালু কথাটার পরিবর্তন দরকার। পরিবর্তনটা করতে পারেন এইসব ভালো নির্মাতারা। তারা অবশ্যই ভালো নির্মাতা, চলচ্চিত্রবোদ্ধা, চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখাপড়াও অনেক বেশি, গবেষণা করেন চলচ্চিত্র নিয়ে। তারপরও ফল যদি হয় এমন, দেশের নব্বই ভাগ কৃষক-শ্রমিক-চাষী খেটে খাওয়া মানুষ তাদের ছবি দেখতে পারেন না, দেখেন দশভাগ অভিজাত শ্রেণীর দর্শক, তারপর সেই ছবির স্থান হয় আর্কাইভে তাহলে এটা তো কাম্য নয়। চলচ্চিত্র যদি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য না হয় তাহলে সেটি ‘চলচ্চিত্র’ হয় কী করে? তারা যে চলচ্চিত্র পুরস্কার গলায় ঝোলান তার দাবিদারও তারা নন। তাদের চলচ্চিত্র বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে যেতে পারেনি। বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে আনা মেটিরিয়াল তারা নষ্ট করছেন- একথা লিখলে তারা আমার ওপর মনোক্ষুণ্ন হবেন। আসলে উন্নাসিক ধরনের শিক্ষিত শ্রেণীর লোকেরাই বরাবর এ দেশের ক্ষতির কারণ হয়েছে। এরা সব সময় যেখানে জন্মেছে, যে সোঁদা মাটিতে লালিত হয়েছে, ধানের মৌ মৌ গন্ধে শ্বাস নিয়েছে সেখানকার শ্রমিক, কৃষকের মানসিক চাহিদা বা বিনোদনকে ঘৃণা করেছে। যাযাবর ‘দৃষ্টিপাত’-এ লিখেছেন, ‘যারা ভারত সরকারের পেনশন পেয়ে লন্ডনে বসবাস করছেন তারই ভারত সরকারের বদনাম করে।’ যে কৃষকের শ্রমিকের টাকায় ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার প্রফেসর হচ্ছেন সেই মানুষদের পছন্দকে এরা সব সময় অবহেলা করেছে। সাধারণ দর্শকের কাছে অবোধ্য ভাষায় এরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করে নিজেরা জাতে উঠেছে। অথচ দেশের নব্বই ভাগ মানুষকে বঞ্চিত করেছে। এরা বিদেশ থেকে পুরস্কার পাওয়ার জন্যে সংবর্ধনায় স্তুতিবাক্য শোনাচ্ছে যে নির্মাতাকে, সেই নির্মাতাই এই দেশের নব্বই ভাগ দর্শকের পছন্দকে ঠাট্টা করছে। একবার ভাবুন, অনুদান কাদের দিচ্ছেন? যাদের ছবি গুলশান বনানীর গুটিকয়েক দর্শক আহামরি মনে করছেন। তারা সিনেমা হলে গিয়ে টিকিট কেটে কোনো দিন ছবি দেখেন না। এক টাকাও এমিউজমেন্ট ট্যাক্স দেন না। অথচ তাদের ছবি বানাতে যারা ট্যাক্স দিয়ে প্রতিনিয়ত ছবি দেখছেন তাদের টাকা খরচ করে যাচ্ছেন অবলীলাক্রমে। এদেশের চলচ্চিত্রকে যত না অর্ধশিক্ষিত নির্মাতা ডুবিয়েছে তার চেয়ে বেশি ডুবিয়েছে চলচ্চিত্রের শিক্ষিত লোকেরা।

‘বেদের মেয়ে জোসনা’ বা ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ যে ব্যবসা করেছে, একটা সরকারি অনুদানের ছবি আপনি খুঁজেও দেখাতে পারবেন না তেমন ব্যবসা সফল হয়েছে। তাতে অবশ্য এদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কারণ এরা যে টাকা অনুদান দেয় তা পকেট থেকে দেয়া টাকা না। নব্বই ভাগ দর্শকের কমার্শিয়াল ছবি দেখার ট্যাক্স থেকে দেয়া টাকা। আর এসব ফ্লপ ছবির পরিচালকরা আভিজাত্যের সুগন্ধী মেখে লবিং করে বিদেশি পুরস্কারের সার্টিফিকেট এনে নিরন্তর নিজের দেহের মাটির সোঁদা গন্ধ ঢেকে দেয়ার। আমি এ ধরনের নির্মাতাদের খারাপ বলছি না। বা তাদের নির্মিত ভালো ছবিকেও খারাপ বলছি না। আমি বলছি ভালো ছবি বানাবার ক্ষমতাকে তারা দেশের নব্বই ভাগ দর্শকের জন্য কাজে লাগালে দোষ কী ছিলো? সহজ সরল ভাষায় দর্শকদের বুঝিয়ে ধীরে ধীরে তাদের মনস্তত্ব তৈরি করে তারপর আর্টফিল্মের দিকে নিয়ে গেলে খুব কি ক্ষতি হতো? যদি নিজের দেশের নব্বই ভাগ দর্শক আপনার ছবি না দেখে তাহলে বিদেশ থেকে বড় বড় পুরস্কার এনে লাভ কী?  এখন সবাই চলচ্চিত্রবোদ্ধা। সবাই চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণে স্ব স্ব প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন। সবার আলোচনা শুনে অবাক হয়ে যাবেন যে, এত বোদ্ধা থাকতে এদেশের চলচ্চিত্রের হাল হকিকত এমন কেন! জানি অনেকে মনোক্ষুণ্ন হবেন- তবু এটা সত্যি। অন্যের পেছনের ময়লা সাফ না করে নিজের ময়লা যদি নিজে সাফ করতাম তাহলে চলচ্চিত্র অনেক আগেই দুর্গন্ধ মুক্ত হতো।

এবার পরিচালকদের কথা বলি, তাদের মতে এখন আগের মতো ভালো প্রডিউসার নেই। প্রডিউসারদের মতে আগের মতো টাকা বিনিয়োগ করবো, টাকা ব্যাক হবে কীভাবে? হল নামক গোডাউন মালিকদের যেখানে সিনেমা চালাবার মেশিনও আমাদের সাপ্লাই দিতে হয় তারা সব লভ্যাংশ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় খেয়ে ফেলছে। হল মলিকরা বলছেন, এদেশে ভালো নির্মাতা-শিল্পী নেই। বিদেশে আছে। বিদেশের ছবি এনে না চালালে হল শেষ হয়ে যাবে। ভালো শিল্পী নেই তো শাকিব খান কোন দেশের শিল্পী? ভালো কলাকুশলী নেই তো এই দেশের ছবির যখন রমরমা ব্যবসা ছিলো তখন কোন বিদেশী কলাকুশলী এসে ছবি নির্মাণ করেছেন? সত্যি বলতে, মধুমিতা হলের মালিক মরহুম সিরাজ ভাইদের মতো মানসিকতাসম্পন্ন হল মালিক দু’চারজন বাদে এখন আর নেই। সব নিজের স্বার্থ দেখে, দেশের স্বার্থ দেখে না। সবাই মুখে দেশপ্রেমী, বুকে টাকাপ্রেমী। সদ্য এনালগ থেকে ডিজিটালে উত্তরণে চলচ্চিত্রে অবশ্যই কিছু সমস্যা আছে। আর সব সমস্যা সিনেমা হল ঘিড়ে। হলের পরিবেশ ভালো না। হলের সিটের অবস্থা ভালো না। মহিলা দর্শকের জন্যে নিরাপত্তা নেই। টয়লেট দুর্গন্ধময়। ফ্যানগুলো ঠিকমত চলে না। ছবি শুরুর আগে টিভির মতো বিরক্তিকর বিজ্ঞাপন। শো টাইম পর্যন্ত ঠিক থাকে না। ফোরকে, টুকে রেজ্যুলেশনের ক্যামেরায় ধারণকৃত ছবি কয়েকটি সিনেমা হল বাদে কোনো হলেই পাওয়া যায় না। আধুনিক সাউন্ড সিস্টেমও নেই। হল থেকে ছবির ভিডিও পাইরেসী হয়। হল থেকে ঠিকমত ছবির টিকিট বিক্রির টাকা পাওয়া যায় না। হলে ছবি চালাতে থার্ড পার্টিকে টাকা দিতে হয়; হল সাজাবার টাকা দিতে হয়, এমনকি হলের ট্যাক্সের টাকাও দিতে হয়। তারপরও টিকিট বিক্রির পঞ্চাশ-ষাট ভাগ টাকা হল মালিক পান- এই চক্র ভাঙবে কে? এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যেখানে ভারতে সিনেমা হলে একশ টাকা টিকিট বিক্রি হলে প্রডিউসার পঞ্চাশ টাকা পান। সেখানে আমাদের সিনেমা হল থেকে একশ টাকার টিকিট বিক্রি হলে প্রডিউসার পান প্রকারভেদে সতেরো-আঠারো টাকা।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে, সব সমস্যা হলকেন্দ্রিক। সমস্যাগুলো হল মালিকেরা অতি সহজেই দূর করতে পারেন অথচ করেন না। সরকার লাইসেন্স ক্যানসেলের ধমক দিয়ে বা অনুদান দিয়ে এগুলো ঠিক করতে পারেন অথচ করেন না। এফডিসিতে সেন্ট্রাল সার্ভেয়ারের মাধ্যমে ছবি চালালে এসব সমস্যা খুব সহজেই দূর করা যায় অথচ হচ্ছে না। ই-টিকেটিং ব্যবস্থা করে প্রযোজকের ন্যায্য পাওনা মেটানো যায় অথচ পদক্ষেপ নেয়া হয় না। যৌথ প্রযোজনার নামে যৌথ প্রতারণা খুব সহজেই বন্ধ করা যায় অথচ উদ্যোগ নেই। দেশীয় চলচ্চিত্রের স্বার্থ দেখে সাফটা চুক্তির মাধ্যমে বিদেশী ছবি আমদানীর ক্ষতিকর দিকগুলো রোধ করা যায় অথচ কেউ ভাবছেন বলে মনে হয় না। প্রত্যেক মিটিং শুধু আশ্বাস দিয়েই যায়, অথচ আশ্বাস কার্যকরী হয় না। যদি সদিচ্ছা থাকে তবে এসব সমস্যা মিটিয়ে ফেলা কোনো ব্যাপার নয়। প্রশাসন যদি সত্যি চায় তবে দেশের স্বার্থে সরকার পারে না এমন কোনো কাজ আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।

পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন, নিজের রাজ্যের স্বার্থ দেখে তিস্তার পানি আমাদের দেয়া যাবে কি না বিবেচনা করবেন। আর আমাদের দেশের অবিবেচকরা নিজের দেশের চলচ্চিত্রের স্বার্থ না দেখেই কলকাতার ছবি আনার জন্যে অস্থির হয়ে গেছেন। মমতার দেশপ্রেম আছে আর আমাদের আছে স্বার্থপ্রেম, পকেটপ্রেম। পকেটপ্রেমীদের দৌরাত্ম্য এখন সব জায়গায়।
কলকাতার চলচ্চিত্র নির্মাতারা পনের-কুড়ি লাখ টাকায় বাংলা ছবি নির্মাণ করে। তারা পনের কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত মুম্বাইয়ের ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে না পেরে ধ্বংস হয়ে যেতে বসেছিলো। তারা আমার কাছে যখন শুনতো আমাদের দেশে কোটি টাকায় বাংলা ছবি নির্মিত হয় তখন বিস্মিত হতো। আমাদের সাথে যৌথ প্রযোজনার ছবি করতে চাইতো এক কোটি টাকার ছবিতে পনের-কুড়ি লাখ টাকা দিয়ে।  আজ সেখানে কোটি কোটি টাকার বাংলা ছবি নির্মিত হচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের বাজেট এসে দাঁড়িয়েছে পনের-কুড়ি লাখ টাকায়। ওরা আমাদের দেখে উপড়ে উঠতে থাকলো। আর আমরা নামতে শুরু করলাম। সেদিন এক বিখ্যাত প্রযোজক আমার অফিসে বসে সদর্পে বললো, এইবার আমি বিশ লাখ টাকায় ছবি বানাইয়া দেখাইয়া দিমু। ডাইরেক্টাররে কইছি এক টাকাও দিমু না, কাহিনি ও স্ক্রিপ্টে এক টাকাও লাগামু না, মাদ্রাজি একটা ছবি মাইরা দিমু। মিউজিক ডিরেক্টার লাগবো না। গান বাজারে চলতি ক্যাসেটের থেইকা লাগামু আর আর্টিস্ট দশ হাজারের উপড়ে একটাও নিমু না। তার সাথে চামচা জাতীয় কিছু লোক সায় দিয়ে বললো, এফডিসির সেটে ঢুকবেন না, বাইরে গাছপালার মধ্যে শুটিং সাইরা ফেলবেন। এই হলো এখন আমাদের চলচ্চিত্রের চালচিত্র। কম টাকায় ছবি করতে হলে সবই কম কম করতে হবে। শিল্পী থেকে কলাকুশলী সবাইকে কম দিতে হবে। এই ভাবনা থেকেই শুরু হলো কম টাকায় কাজ করা অদক্ষ শিল্পী ও কলাকুশলীর উপড় নির্ভরশীলতা। ফলে যা হবার তাই হলো- ছবির মান কমতে থাকলো। সিনেমা হল মালিকেরাও কম টাকায় ছবি নিয়ে বেশি লাভবান হতে এগিয়ে এলেন। আর এসব করতে গিয়ে আমরা দর্শক হারিয়ে ফেললাম। সবই ওই কমের খেসারত। যেখানে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সর্বজন প্রশংসিত হচ্ছে, সেখানে আমাদের চলচ্চিত্র হতাশায় নিমজ্জিত থাকবে- এটা ঠিক নয়। একটা দেশের পরিচয় শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতিতে। সেই সংস্কৃতি হতাশাগ্রস্ত হলে কোনো উন্নয়নই সঠিক বা টেকসই হবে না।

 

 

লেখক: চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক





রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়