ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শৈশবে মানসিক স্বাস্থ্য এবং এর অন্তরায়

মো. আমিরুল ইসলাম প্রামাণিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০০, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শৈশবে মানসিক স্বাস্থ্য এবং এর অন্তরায়

প্রতীকী ছবি

মো. আমিরুল ইসলাম প্রামাণিক : শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিকভাবে ভালো থাকার নাম স্বাস্থ্য। এই তিনের মধ্যে মনের আধিপত্যই বেশি। প্রফুল্ল মন সুস্বাস্থ্যের সবচেয়ে বড় নিদর্শন। তাই মনকে ভালো রাখার দায়িত্ব সবার। আমরা আমাদের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনা, হতাশা-ব্যর্থতা সবই মন থেকে অনুভব করে থাকি। মন ও শরীর এই দু’য়ের ব্যথা ও যন্ত্রণাবিহীন কোনো অসুস্থতা নেই।

শৈশবে আমাদের মন-মানসিকতা ও ব্যক্তিত্বের ভিত রচিত হয়। পরিবার-পরিজন, সমাজ ও শিক্ষালয় থেকে শৈশবে আমরা যে শিক্ষা পাই তার সমন্বয়ে পরবর্তী জীবনের জন্য আমাদের মন-মানসিকতা প্রস্তুত হয়। এভাবে প্রাপ্ত শিক্ষা কিছু কিছু ক্ষেত্রে নেতিবাচকও হয়। সে কারণে ছেলেমেয়েদের আচার-আচরণ ও ব্যক্তিত্ব ভিন্নভাবে রূপায়িত হয়, যা পরবর্তীতে অনেক সমস্যার সৃষ্টি করে। এসব বিষয় নিয়েই আমার এ রচনা। রচনাটি একটু লম্বা হবে, তাই দুই পর্বে পুরো বিষয়টি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।

প্রথম পর্ব
শৈশবে ছেলেমেয়েরা আপনজন অথবা পরিচর্যাকারীর কাছে লালিত-পালিত হয়। শিশুদের অবুঝ মনে নানা প্রশ্নের উদয় হয়। একটা বয়স পর্যন্ত শিশুরা ভয়-ভীতি, ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানব, বাঘ-ভাল্লুক, দুঃখ-কষ্ট এসব কিছুই চিনে না। সবই তাদের শেখানো হয়। শিশুদের লালন-পালন পদ্ধতি আছে, যা অনেকের অজানা। তাই একটু কিছু ব্যত্যয় হলেই আপনজন, পরিচর্যাকারী অথবা প্রতিবেশীরা শিশুদের মস্তিষ্কে নানা ধরনের ভয়-ভীতি, ভূত-প্রেত, দৈত্য-দানব ঢুকিয়ে দেন। ফলে ওই জাতীয় ঘটনাগুলো শিশুরা সর্বদা চোখের সামনে দেখতে থাকে, ঘুমের মধ্যে দেখে থাকে, ফলে শিশুটি কিছুতেই ঘুমাতে পারে না, সর্বদা ঘটনার কথা মনে পড়ে, যা অনভিপ্রেত।

বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী এবং হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার জনক ক্রিশ্চিয়ান ফেডরিক স্যামুয়েল হ্যানিমানের মতে, ‘জড়দেহ, জীবনীশক্তি ও বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মন- এই তিনের সমন্বয়ে প্রত্যেক মানুষের চৈতন্যময় ব্যক্তি-সত্তা গঠিত। মনুষ্যত্ব বিকাশের পথে এই ত্রয়ীর একটি অন্যটির ওপর নির্ভরশীল। জড়দেহকে আশ্রয় করে জীবনীশক্তি এবং বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মন- উভয়ের সুসামঞ্জস্ ক্রিয়াশীল মানুষ তার অভীপ্সিত উন্নততর জীবনের পথে অগ্রসর হতে পারে।’ এখানে সুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন মনের বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তাঁর এই মতবাদ সারাবিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছে।

অন্যদিকে, প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও দার্শনিক জেমস টেইলার কেন্ট তাঁর দর্শনশাস্ত্রে উল্লেখ করেছেন যে, বাহ্যিক অভিঘাতের ফলে ক্ষতাদি ঘটে, অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার ফলে প্রচন্ড ব্যাধি উৎপন্ন হয়। শরীরের প্রকৃত ব্যাধিসমূহ কেন্দ্র হতে পরিধিতে প্রবাহিত। মানবের শাসনাধিষ্ঠানে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্রম অনুসারে ত্রিকর্তৃত্ব বর্তমান আছে, যে স্থান হতে অনুশাসন প্রেরিত হয়। যথা- মহামস্তিষ্ক (Cerebrum), অনুমস্তিষ্ক (Cerebellum) এবং মেরুদন্ড (Spinal Cord); অথবা সমষ্টিভূত বা সাধারণভাবে বলতে হলে, মস্তিষ্ক, মেরুদন্ড এবং স্নায়ুসমূহ। এখানে মস্তিষ্ক বা স্নায়ুমন্ডলীর সুস্বাস্থ্যের কথায়ই বলা হয়েছে।

অপরদিকে, অস্ট্রিয়ান নিউরোলজিস্ট ও মনোবিজ্ঞানের জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েডও প্রত্যেকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে নিউরোসিস ও সাইকোসিস রোগ এবং তার চিকিৎসার প্রতি সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, শৈশবের নানা অস্বাভাবিক ঘটনা প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে, ব্যক্তিত্বকে রূপায়িত করে। যেমন- একজন ব্যক্তির অতীতের দুঃখজনক অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত উদ্বেগ চেতনায় লুকানো থাকে এবং প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর তা সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। তাঁর বিশ্বাস এবং মতবাদ আজ বিশ্বব্যাপী সুপ্রতিষ্ঠিত।

এমতাবস্থায়, মানসিক স্বাস্থ্য এবং এর অস্বাভাবিকতা বিষয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রের নানা দিক পর্যালোচনা করেছি। সেখান থেকে সংগৃহীত শৈশবের কিছু মানসিক উপসর্গ এবং এসব উপসর্গের নামকরণ নিচে তুলে ধরছি।

* অনেক শিশু রাত্রে ঘুমাবার পর হঠাৎ করে রাতের প্রথমভাগে জেগে উঠে এবং বিছানায় বসে চেঁচিয়ে উঠে, বা কেঁদে উঠে এবং শিশুকে শান্ত করার চেষ্টা হলেও সে কিছুতেই শান্ত হয় না এবং পরদিন সকালে শিশুকে রাতের ঘটনা সম্পর্ক কিছু জিজ্ঞাসা করা হলে সে কিছুই মনে করতে পারে না। সাধারণতঃ ৩-৫ বছর বয়সের শিশুদের মধ্যে এই জাতীয় লক্ষণ বেশি দেখা যায়। শিশুদের এই অবস্থাটিকে স্লিপটেরর ডিসঅর্ডার বলে।

* এদিকে একপ্রকার বিতর্কিত শৈশবকালীন মানসিক গোলযোগ এবং এ জাতীয় মানসিক অবস্থা শিশুর সাত বছর বয়সের পূর্বেই দেখা দেয়। এক্ষেত্রে শিশু খুব ছটফট হয়, কোনো প্রকার নিয়ম-কানুন মানতে চায় না, কারোর নির্দেশ সে শুনতে রাজি হয় না, খুব বেশি কথা বলে এবং নানা প্রকার অস্বাভাবিক কাজ করে থাকে। শিশুর এ অবস্থাকে অ্যাটেনশন-ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিসঅর্ডার বলে, যা অটিজম রোগের একটি ধরন।

* কোনো কোনো শিশু সবার সঙ্গে কথা বলে না বা বলতে পছন্দ করে না। নির্দিষ্ট কিছু লোকের সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করে। এটি শৈশবের এক প্রকার মানসিক রোগ। যাকে ইলেকটিভ মিউটিজম বলে।

* মানসিক বিকৃতির ফলে অনেক সময় শিশুর বাকশক্তি কমে যায়, এক্ষেত্রে শিশু একসঙ্গে একটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। শিশুর এই অবস্থাকে মনফেজিয়্যা বলে।

* অনেক শিশুর কথা বলার মধ্যে গোলযোগ দেখা দেয় বা কথা বলার সময় সঠিকভাবে শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না। এ ধরনের রোগের কারণ হল, কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের গোলযোগ। যাকে ডিসআরথ্রিয়্যা বলে।

* যেকোনো মানসিক অথবা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। এই প্রতিবন্ধকতা জন্মগত অথবা জন্মের পর হতে পারে, যা একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবনে কাজকর্মের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে থাকে। শিশুর এই অবস্থাকে হ্যান্ডিক্যাপ বলে।

* একজাতীয় জন্মগত রোগ, যাতে করে শিশু মানসিকভাবে জড়বুদ্ধি সম্পন্ন হয় এবং চোখের পাতার ও ভ্রুর চুলের অতিরিক্ত বৃদ্ধি হয়ে থাকে। এই অবস্থাকে ট্রাইকোমেগ্যালি বলে।

* শিশুর দৃঢ়বদ্ধ মানসিক ধারণা, যা কোনোভাবেই মন থেকে দূর করা সম্ভব হয় না। এই অবস্থাকে অবসেশিভ বলা হয়।

* কোনো বস্তু বা অন্য কিছুর প্রতি সাধারণ ভীতি। যেমন- কুকুর দেখলে ভয় পাওয়া, রক্তপাতে ভয় পাওয়া প্রভৃতি। শিশুদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি অধিক দেখা যায়, যাকে সিম্পল ফোবিয়া বা সাধারণ ভীতি বলে।

* শিশুদের মধ্যে এক ধরনের কার্যগত ভীতি বা আতঙ্ক লক্ষ্য করা যায়। যেমন- বহুলোকের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে ভয় পাওয়া অথবা বহু লোকের সঙ্গে খেতে অসুবিধা হওয়া ইত্যাদি। এ ধরনের আচরণকে সোশ্যাল ফোবিয়া বলে।

* শিশুর পরিচর্যায় নিযুক্ত ব্যক্তি অনেক সময় শিশুকে ইচ্ছাকৃতভাবে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন বা আঘাত করে। এতে শিশুর যে বিরূপ অবস্থা তৈরি হয় তাকে নন-অ্যাক্সিডেন্টাল ইনজুরি বলে।

(বাকি অংশ দ্বিতীয় পর্বে প্রকাশিত হবে)





রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়