ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

গূঢ়ার্থে দেবী মাহাত্ম্য || রুমা মোদক

রুমা মোদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৬, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গূঢ়ার্থে দেবী মাহাত্ম্য || রুমা মোদক

যাগ-যজ্ঞময় বৈদিক যুগের পর পৌরাণিক যুগে এই সিন্ধুনদ তীরবর্তী ভূ-খণ্ডে পৌরাণিক দেব-দেবীর আবির্ভাব। সিন্ধু তীরবর্তী এই জনগণ যারা ‘হিন্দু’ নামে সুপরিচিত তাদের পৌরাণিক গাথার সাথে মিথস্ক্রিয়া ঘটে বহিরাগত আর্য সংস্কৃতির। দুয়ের সংমিশ্রণে এই এলাকার জনগোষ্ঠী উপমহাদেশের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে নানা দেব-দেবীর উপাসক হয়ে। সময়ের বিবর্তনে, সভ্যতার পথ পরিক্রমায় পৌরাণিক দেব-দেবীর উৎপত্তিকালীণ গাথা অতিক্রম করে প্রতি মুহূর্তে আরো নানা গাথায় গ্রন্থিত হয়েছেন, এবং প্রতিটি গাথাই মূলত তার কাহিনি ও আঙ্গিকে সময় ও স্বকালকে প্রতিনিধিত্ব করেছে। এই সসয় ও কাল আজ উত্তরকালে আমাদের বিস্মিত করে বহুরৈখিক বিশ্লেষণে। বিশেষত যখন জ্ঞানচক্ষু উন্মিলীত করে মানুষ আবিষ্কার করার চেষ্টা করে আচরণের কিংবা অলৌকিক বিশ্বাসের অন্তরালের নিগূঢ় কোনো সত্য।

পুরাণে শ্রী শ্রী দুর্গার আবির্ভাব মূলত অসুর বিনাশে দেবতাদের সম্মিলিত শক্তির প্রতীকে। নানা পুরাণে দেবী দুর্গা পুনঃপুনঃ আবির্ভূতা হয়েছেন, মধু-কেটভ, শুম্ভ-নিশুম্ভ, মহিষাসুর বধে। কৃত্তিবাসী রামায়ণে দেবী পূজিতা হয়েছেন রাবণ বধের সংকল্পে অকাল বোধনে। সব পুরাণেই লক্ষ্যনীয় দেবী দুর্গার আবির্ভাব শুভের বন্দনায়, অশুভ নাশে। পৌরাণিক গাথার ঊর্ধ্বে দেবীর এই প্রতীকী রূপ নবতর ব্যাখ্যায় আমাদের চমকিত করে। উত্তরকালে আমরা আবিষ্কার করি এই দেবী দুর্গতিনাশিনী দুর্গা পৌরাণিক গাথায় কী আশ্চর্যজনকভাবে নারীশক্তি রূপে অজেয় হয়ে উঠেছেন সম্মিলিত শক্তির তেজপুঞ্জে। এতো পক্ষান্তরে জনতার ঐক্য শক্তির বিজয় ঘোষণা। এতো সেই পুরাণ কাল থেকেই সকল সৃষ্টির আধার নারীকে আবাহনের নামান্তর। এবং নারীর মাধ্যমেই সকল অশুভ-অকল্যাণ ধ্বংসের ইঙ্গিতবাহী। মানুষের অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি যুগে যুগেই এক সত্যকে চূর্ণ করে অন্য সত্যকে খুঁজে ফিরেছে বিজ্ঞান ও যুক্তির পথ ধরে। এবং নিয়ত নতুন সত্যকে ঘোষণা করেছে হেমলক বিষ ধারণ করে। কিন্তু এই যে মানুষের নিয়ত সত্যানুসন্ধান তার ভিত্তি প্রোথিত তার অতীতে, যেমন বৃক্ষ প্রোথিত থাকে মাটিতে তার শিকড়ে। আজ যে অকাল বোধনে দেবী দুর্গার আবাহন, এই উপমহাদেশেই তার আবির্ভাব ও বিস্মৃতি, পুরাণ কথায় গ্রন্থনা মূলত এই উপ-মহাদেশের হিন্দুজাতি-গোষ্ঠীর অতীত ঐতিহ্য কিংবা সংস্কৃতির উত্তরাধিকারের স্মারক। এবং বলাবাহুল্য ডাইনে বাঁয়ে লক্ষ্মী-কার্তিক-গণেশ, মাথার ওপরে শিব আর পদতলে পদানত অসুর আর সিংহসমেত দেবী দুর্গার যে কাঠামো মূলত এক সমৃদ্ধ প্রতীকী স্বাক্ষর। এবং পৌরাণিক যুগের প্রাথমিক লগ্ন থেকে নানা বিবর্তনের মাধ্যমেই আজ এই কাঠামোতেই স্থিত হয়েছেন অকাল বোধনের দেবী দুর্গা।

দেবী দুর্গার, দুর্গা নামটিও পরবর্তীকালে দুর্গতিনাশিনীর পৌরাণিক ব্যাখ্যা অতিক্রম করে ভিন্নতর ও বহুমাত্রিক মাত্রা লাভ করেছে। যেমন দ-তে দৈত্যনাশক, উ-তে বিঘ্ননাশক, রেফ-রোগনাশক, গ-পাপনাশক আর আ-কার ভয় ও শত্রুনাশক। অর্থাৎ দৈত্যরূপে অশুভ শক্তি, সকল বিঘ্ন-রোগ-পাপ-ভয় ও শত্রুনাশ করেন বলেই তিনি দেবী দুর্গা। দেবী দুর্গার এই যে অক্ষরমাত্রিক ব্যাখ্যা তা মানুষের শুভসন্ধান প্রত্যাশী মস্তিষ্কের বিশ্লেষণ সঞ্জাত, যে বিশ্লেষণে এই কাঠামোবদ্ধ দেবী দুর্গা সামষ্টিকভাবে নানা বাখ্যায় ব্যাখ্যাত হয়ে আধুনিক কালে আমাদের অলৌকিক বিশ্বাসকে কালোপযোগী জ্ঞান তৃষ্ণায় ধাবিত করে। এবং নিজের সমৃদ্ধ অতীত ভাবনার অভিনবত্বে চমকিত করে আমাদের আধুনিক মনন।

দেবী পুরাণ অনুসারে দেবী দুর্গার বাহন সিংহ। এই সিংহ হিংস্র প্রবল পরাক্রমশালী পশুকুল শ্রেষ্ঠ। এই সিংহকে পদানত করেন দেবী দুর্গা। প্রবল প্রতাপশালী পশুত্ব পদানত করার এক রূপকায়িত প্রকাশ এই পদানত সিংহ। পশুত্ব বোধের বিপরীতে ঘোষিত মনুষ্যত্ব বোধের জয়। সাধনা, জ্ঞান ও বীর্যে মানুষ যখন পশুত্ব ভাব দমন করতে সক্ষম হয় তখনই মানবতার জয় হয়, বোধন ঘটে সুর আর শুভবোধের। দেবীর পদতলে রক্তাক্ত পর্যদুস্ত অসুর মূলত চিরকালীন সু ও কু-এর মধ্যকার দ্বন্দ্বে শুভ শক্তির বিজয়ধ্বজা।

দেবীর ডান পাশে সিদ্ধিদাতা গণেশ। গণেশ গণশক্তির প্রতীক। গণমানুষের একতাবদ্ধ শক্তির প্রকাশ। মূলত গণশক্তি যখন একীভূত হয় তখন যাবতীয় বাধা দূরীভূত হতে বাধ্য। পুরাণ কথায়ও পরিলক্ষিত হয়, প্রতিধ্বনিত হয় সেই একতার সুর। যখনই দেবকুল ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তখনই পরাভূত হয়েছে অসুরকুল। গণেশের বাহন ইঁদুর। ছেদন করা বৈশিষ্ট্য যার। গণেশের বাহন এই মুষিক ও ইঁদুর ধারণ করে মানুষের মায়া ও মোহ ছেদনের প্রতীকী ব্যঞ্জনা। মায়া ও মোহের ব্যঞ্জনা ছেদনপূর্বকই মাত্র সমগ্র মানবজাতির সামগ্রিক মানবজাতির কল্যাণ সম্ভব। নচেৎ ব্যক্তিলোভ কিংবা মোহে পরাভূত হতে পারে কল্যাণমুখী অভিযাত্রা। ছোট্ট দেহী মুষিক আধুনিক কালের মানুষের কাছে রেখে যায় সেই বার্তা।

ডান পাশে অধিষ্ঠিতা দেবী লক্ষ্মী ধনপ্রাপ্তি, শ্রী-সমৃদ্ধি ও অভ্যূদয়ের প্রতীক। যারা ভূমিকর্ষণ করে আহরণ করে মানুষের খাদ্য, খনি আহরণ করে প্রাকৃতিক সম্পদ, বনে-জঙ্গলে খুঁজে বেড়ায় গুপ্ত সম্পদ তাদের আশ্রয় করে থাকেন লক্ষ্মীদেবী; বিত্ত আর বৈভবের ধারক তিনি। জগতের সম্পদের আধার তিনি, তার আশীষ প্রার্থনা করে ধন সংগ্রহে ইচ্ছুক প্রাণ। তাঁর বাহক পেচক বা পেঁচা। পেঁচা মূলত দিব্যান্ধ। দিনে দেখতে পায় না। এই দিব্যান্ধ পেঁচা জ্ঞানহীনতার প্রতীক। ধন সংগ্রহে মত্ত ব্যক্তি জ্ঞানের সন্ধান পায় না। ফলে তার জ্ঞানচক্ষু উন্মিলীত হয় না। ধন আহরণে ব্যক্তি সর্বদা দিব্যান্ধ পেঁচার মত জ্ঞানের আলো বঞ্চিত থেকে যায়।

জ্ঞানের প্রতীক সরস্বতী। তার এক হাতে জ্ঞানের আধার পুস্তক, অন্য হাতে সুরের আধার বীণা। সকল রকম সুকুমার বৃত্তির সংযোজনে শুভ্র বসনা দেবী সরস্বতী জ্ঞান ও আলোর মূর্তপ্রতীক। জ্ঞানের আলোয় আলোকিত বলেই তার বসন শুভ্র, বাহুল্যহীন। কোনো কালো-মন্দ-অন্ধকারের প্রতিচ্ছায়া নেই তাঁর সর্বাঙ্গে। তাঁর প্রতীক হাঁস। শুভ্র রাজহাঁস পানিতে বসবাসকারী প্রাণী, সারাদিন জলে সাঁতরে যে ডাঙায় উঠে নিমিষে ঝেড়ে ফেলে দেয় পালকের গায়ে লেগে থাকা জল। জলের পঙ্কিল ছেঁকে সে তুলে দেয় খাবার তার। জ্ঞানী ব্যক্তি ও সংসারে বসবাসকারী সেই রাজহাঁস। আমাদের এই হিংসা দ্বেষময় সংসারে দিনমান ব্যয় করে যে দিন শেষে নিজের হৃদয় থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারে এই পার্থিব কাম-ক্রোধ-মোহের জলকণা।

শৌর্যবীর্য প্রদর্শন ও সৌন্দর্যের প্রতীক। বীরযোদ্ধা কার্তিক যতখানি সুদর্শন, ততখানি সুদর্শন তার বাহন ময়ূর। দেশজয়ী বিজয়ী যোদ্ধার আকৃতি যদি সুদর্শন না হয় তবে  গরিষ্ঠ আমজনতার কাছে অগ্রহণযোগ্য হবার আশঙ্কা থেকে যায় বলেই বোধহয় সুদর্শন কার্তিকের তীর ধনুকসমেত সুদর্শন অবয়ব।

স্বয়ং দেবী দুর্গার মৃন্ময়ী রূপেরও রয়েছে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা। দশভূজা দেবী দশ হাতে রক্ষা করেন ধরণীর দশদিক। ত্রিনয়নী দেবীর ত্রিনয়ন নিয়ন্ত্রণ করে ত্রিকাল। দেবীর ত্রিডঙ্গা অবস্থান ত্রিজ্ঞানত্মিকা অর্থাৎ সত্ত্ব-রজ-তম গুণের প্রতীক। কঠোর যুদ্ধে তিনি পদানত করেছেন মহিষাসুরকে। মহিষাসুর কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদমাৎসর্য্য’র ঘনীভূত শক্তি। দেবী এক মহিষাসুরের রূপে পরাজিত করেন সকল অকল্যাণকর শক্তিকে।

মহাশক্তি দুর্গার আবির্ভাবের গূঢ়ার্থ সাধকের সাধনার শক্তিতে আবির্ভাব। সাধক যখন সাধনার তরে নিজেকে প্রস্তুত করে তখন তার অন্তরস্থিত রিপুসমূহ তাতে বাধার সৃষ্টি করে। সাধনার শুভ ইচ্ছাকে পরাভূত করে সাধককে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে চায়। সাধনমুখী মানব সত্তার দেবীরূপে শক্তির সাথে তখন ষড়রিপুরুপী অসুর শক্তির বাঁধে লড়াই। আর দেবী দুর্গার বিজয়ের মাধ্যমে ঘোষিত হয় রিপুর পরাজয়।

অকাল বোধনে দেবী দুর্গার কাঠামোর পাশে পূজিতা হন নবপত্রিকা। উর্বরাভূমির নয় রকম শস্যের সমাহার। কলা, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, বিল্ব, ফাড়িম, মান ও ধান। পূজা মণ্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা। এই নবপত্রিকা কী করে দুর্গাপূজার অংশ হয়ে ওঠে তার সুনির্দিষ্ট কারণ জানা না গেলেও উল্লেখ পাওয়া যায় কৃত্তিবাসী রামায়ণে- ‘বাঁধিলা পতি কানব বৃক্ষের বিলাস’। সম্ভবত শষ্যসম্ভবা ধরণী সৃষ্টি সম্ভবা নারী সত্তার সাথে একাত্ম করার প্রতীকী আয়োজন এই নবপত্রিকা।

দুর্গাপূজার আবশ্যিক আরেকটি অংশ কুমারী পূজা। পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার কয়েকটি পূজামণ্ডপে অষ্টমী তিথিতে কুমারী পূজার আয়োজন করা হয়ে থাকে। উইকিপিডিয়ার  মতে এই কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হলো নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। বিশ্ব প্রকৃতিতে যে তিন শক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি স্থিতি ও লয় ক্রিয়াসাধিত হচ্ছে সব সম্ভাবনারূপে কুমারী রূপী নারীর মাঝে লুক্কায়িত থাকে, কুমারী নারী অপার সম্ভবনার উৎস। সৃষ্টির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে কুমারীকে পূজা করে পূজিত করার এই আয়োজন।

নারীকে পূজা করার এই রীতি, কেবল নারীকে ভোগ্য ভাবার সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি দেয়ার চর্চার প্রারম্ভিক প্রতীক। দেবী জ্ঞানে যে কোনো কুমারী পূজনীয়, এমনকি বেশ্যাকুলজাত কুমারীও।

দেবী দুর্গার মাধ্যমে নারী শক্তির যে বোধন, পুরাণ কাল থেকে অদ্যাবধি তার প্রয়োজন অনস্বীকার্য। নারী নিগ্রহের এই গ্রহণকালে সর্বশক্তির আধার নারীর এই আবাহন কেবল সীমাবদ্ধ না থাকুক শাস্ত্রীয় আচরণে। ব্যবহারিক জীবনে প্রতিফলিত হোক সম্মিলিত শক্তি আর ঐক্যের প্রতীক দুর্গতিনাশিনীরূপী শক্তির প্রতি শ্রদ্ধায়-ভরসায়-ধারণে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়