ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আশ্বিনের মাঝামাঝি || অমর মিত্র

অমর মিত্র || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৮, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আশ্বিনের মাঝামাঝি || অমর মিত্র

আশ্বিনের মাঝামাঝি, উঠিল বাজনা বাজি, পুজোর সময় এল কাছে। বাজনা কোথায় সেই গ্রামে। কে-ই বা তা বাজায়? কিন্তু মনের ভিতরে তো সুর ওঠে। মাঠে প্রান্তরে জলার ধারে কাশ ফুল ফুটলে পুজো এল। মনে পড়ে যায় ‘কিশলয়’ বইয়ে রবি ঠাকুরের কবিতা:

    ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ,

    আমরা বেঁধেছি শেফালিমালা,

    নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা।

    এস গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,

    এসো নির্মল নীল পথে।’

দুলে দুলে কবিতা মুখস্ত করতে করতে দেখতে পেতাম শারদলক্ষ্মীকে। পুজো আসছে। ঢাকিরা ঢাক বাজায় খালে-বিলে। সেই বাজনা মনে বেজে উঠত। মধু বিধু দুই ভাই আনন্দে দুহাত তুলে নাচে। আকাশ নীল, শাদা মেঘের ভেলা দেখা যায়। দেবী আসছেন।  আমাদের এ-পারের গ্রাম দন্ডীরহাট, বসিরহাট শহর লাগোয়া। শহরের কোনো চিহ্নই ছিল না সেই গ্রামে। মস্ত গ্রাম। একটি পুজো। বাবুদের বাড়ি। বাবু মানে প্রাক্তন জমিদার বাড়ি। জমিদারি তখন বিলুপ্ত হয়েছে আইনত, কিন্তু বাকি সবই যেন ছিল। জমিদার বোস বাবুরা কলকাতা থাকতেন। পুজোর সময় তাঁরা আসতেন কি না জানি না কিন্তু চণ্ডী মণ্ডপে পুজো তো হতো। পুজো লাগত রথযাত্রা থেকে। ঠাকুর গড়ার কুমোররা চলে আসত। শুনেছি ওই গ্রামে দেবীর কাঠামো নির্মাণে একজন মুসলমান প্রথম হাত লাগাতো। তারপর কাঠামো নির্মাণ আরম্ভ হতো।

রথযাত্রার সময় বর্ষা। বর্ষা চলত। প্রতিমা শিল্পী কুমোররা চণ্ডী মণ্ডপে থেকে যেত। কাঠামোয় খড় লাগল, তারপর মাটি। আমাদের ইস্কুল সামনেই। ঠাকুর কতটা উঠছে, মাটি পড়ল কি না, আস্তে আস্তে অবয়ব গড়ে উঠতে লাগল, আমরা দেখতাম ইস্কুল ছুটির পর। সহপাঠী কাশীনাথের এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ, সে বলত- প্রতিমা শিল্পী হবে বড় হয়ে। কিন্তু তা হয়নি। হয়েছিল ঠিকেদার। দুর্গা পুজোর আনন্দ তো নতুন জামা-কাপড়ে। দন্ডীরহাটে আমাদের একান্নবর্তী সংসার। খুড়তুতো ভাই বোন মিলে কুড়ি। বাবারা তিন ভাই। তাঁদের তিনজনের দশ পুত্র, দশ কন্যা। এর ভিতরে আমার দাদা কলেজে পড়ান। আমরা ফাইভ-সিক্স। আমাদের জন্য একটি থান থেকে কাপড় কেটে সকলের এক জামা, এক প্যান্ট।  মিত্তিরবাড়ির ইউনিফরম। দিদি আর বোনদের ফ্রকও তাই। পুজোর সূত্রপাত তো মহালয়া থেকে। মহালয়ায় অমাবস্যা। পরের দিন দেবীপক্ষের শুরু।

আমার বাবা ভাদ্রমাসের পূর্ণিমার পর কৃষ্ণপক্ষ, পিতৃপক্ষ  শুরু হলে পিতৃতর্পণ আরম্ভ করতেন। অমাবস্যার দিনে, মহালয়ার দিনে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে সেই তর্পণ শেষ হতো। মহালয়ার সঙ্গে আমাদের পরিবারের একটি সম্পর্ক রয়েছে। দেশভাগের পর এ-পারে এসে আমাদের পরিবার যে প্রথম মৃত্যু দ্যাখে, তা এই অমাবস্যা কিংবা চতুর্দশী ও অমাবস্যার সন্ধিক্ষণে। সেই রাত্রি ফুরোলে আমরা জিইসি, রেডিওতে শুনব বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডী পাঠ এবং মহিষাসুর মর্দিনী কথিকা। দুর্গাপুজো যেন ঐদিন আরম্ভ হয়ে যেত। মাতলরে ভুবন...। সেই চতুর্দশী ও অমাবস্যার সন্ধিক্ষণে, দিবাবসানের সময়, গোধূলি বেলায় আমাদের পিতামহ অন্নদাচরণের জীবনদীপ নিবার্পিত হয়। তখন আমি খুব ছোট, দশের মতো বয়স। আমরা সকলে ঘিরে বসেছিলাম পিতামহকে। তাঁর দশটি নাতি, দশটি নাতনি। সকলে ছিল না। কনিষ্ঠ পুত্র তখনো পূর্ব পাকিস্তানে। আমি দেখেছিলাম কীভাবে প্রাণবায়ু অনন্তে মিশে যায়। শ্বাস নিতে নিতে আর পারলেন না তিনি। তাঁকে রাত্রেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ইছামতীর তীরে বসিরহাট শ্মশানে। ইছামতীর ও-পারেই, ন’দশ মাইল গেলে সাতক্ষীরা শহর লাগোয়া আমাদের গ্রাম ধূলিহর। খুব কাছেই সেই দেশ অন্যদেশ। বাবারা দাহ করে ফিরেছিলেন ভোরবেলা। তখন রেডিও থেকে বীরেন ভদ্র মশায়ের মেঘমন্দ্র কণ্ঠধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে ভোরের বাতাসে। পিতৃহারা দুই পুত্র এসে বসলেন বারান্দায়। অন্য পুত্রটি তখন অন্য দেশে, জানেও না মহাগুরু পতন হয়ে গেছে তার অজান্তে।

আজও মহালয়া এলে সেই মৃত্যুর কথা মনে পড়ে আমার। সেই ভোর। গুরুদশা, হাতে কঞ্চি ও কম্বলের আসন, দুই ভাই বসে আছে বারান্দায়। গ্রামের অনেক মানুষজন বসে আছে হেথাহোথা। মহালয়া এলে একটু মন খারাপ হয় সত্য। বাবা কাকারা কেউ নেই এখন। তাঁদের তর্পণ করা হয় এইদিন। আমি ভোরে বিছানায় শুয়ে সেই গোধূলিবেলার কথা ভাবি। বাবার সঙ্গে আমি কয়েকবার গঙ্গায় গিয়েছি।  শেষে বাবা আর গঙ্গায় যেতেন না, বাড়িতে করতেন পিতৃপুরুষ স্মরণ। নিজে চণ্ডীপাঠ করতেন। বাবার প্রয়াণ হয়েছিল ভাদ্র সংক্রান্তির দিনে। তারপর আমরা তিন ভাই একসঙ্গে তর্পণ করেছি বেশ কয়েক বছর। হ্যাঁ, বাড়িতে। গঙ্গায় সেদিন বড় কলরব, হৈ হৈ। বাড়ি অনেক শান্ত। একবার মহলয়ার আগের দিন আমি ছিলাম সিউড়িতে এক সাহিত্যের অনুষ্ঠানে। লেখক রমানাথ রায়, জয়ন্ত দে, অরিন্দম বসু ছিলেন। পরদিন ভোরে আমরা চললাম ময়ুরাক্ষী ব্যারেজে। ময়ুরাক্ষীতে পিতৃতর্পণ করব। ব্যারেজে যা হয়, একদিকে জল টলটল করছে, অন্যদিকে ধুধু বালুচর। কী অপরিসীম শূন্যতা! সেই ভোরে সেখানে মানুষজনও বিশেষ ছিল না। হয়তো নদীর অন্য কোথাও হয় তর্পণ। নিঝুম প্রকৃতিতে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছিলাম প্রিয়জন না থাকার বেদনা।

বাবার আগে তাঁর দুই ভাই চলে গিয়েছিলেন। সকলের কথা মনে পড়ছিল আমার। খা খা বালুচরে দাঁড়িয়ে তৃষ্ণার্ত পিতৃকুল, মাতৃকুল যেন জল চাইছিলেন। ধোঁয়া ধোঁয়া তাঁদের দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। আমরা সকলেই ব্যারেজের জলের কাছে গিয়ে সেই জল হাতে ছুঁয়ে স্মরণ করেছিলাম পরলোকবাসী আত্মজনদের। প্রয়াত বান্ধব, অবান্ধবদের। চেনা অচেনাদের। আমাদের শাস্ত্র বলি, দর্শন বলি, তা কবি-কল্পনায় পরিপূর্ণ। বিশ্বাস এই যে, মহালয়ার দিনে প্রয়াত সকল মানুষের জীবাত্মা মর্ত্যে আসে তৃষিত হয়ে। তাদের জলদান করতে হয়। শুধু আত্মজন নন তাঁরা, অনাত্মীয়, অচেনা, অবান্ধব, সন্তানহীন আত্মারা আসেন জল গ্রহণ করতে। ময়ুরাক্ষী ব্যারেজের যেদিকে জল, সেইদিকে গভীরতা অনেক বেশি। বিপজ্জনকও। স্নান করা হয়নি। কিন্তু জল দিয়েছিলাম তাঁদের।

তাঁরা তা নিয়েছিলেনও জানি। আমি ফিরে আসতে আসতে দেখেছিলাম ধু ধু বালুচরে দাঁড়িয়ে আছেন, পিতা, পিতৃব্য, পিতামহ, পিতামহী, মাতামহ, মাতামহী, প্রপিতামহ...।

মহালয়ার পরদিন থেকে শুক্লপক্ষের শুরু। আমাদের উৎসব শুরু হয়ে যায় মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠধ্বনিতে। বাণীকুমার প্রযোজিত আকাশবাণীর ওই অনুষ্ঠান পুজোর অঙ্গ হয়ে গেছে বুঝি এখন। ঐ কণ্ঠই যেন ঘোষণা করে শারদোৎসব সমাগত। কতকাল ধরে, সেই বাল্যকাল থেকে শুনছি, কিন্তু এখনো যেন নতুন হয়েই আসে তা বৎসরান্তে। সুপ্রীতি ঘোষের কণ্ঠে সেই গান, ‘বাজলো তোমার আলোর বেনু, মাতলোরে ভুবন’ ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। তারপর বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠে মহিষাসুর মর্দিনী। ঘুম আর তন্দ্রার ভিতরে কানে আসে সেই অমৃতবাণী। হ্যাঁ, আকাশবাণীর এখানে জিত। টেলিভিশন কিছুই করতে পারেনি মহিষাসুরমর্দিনী সাজিয়ে গুজিয়ে দেখিয়ে। এখানে যে কল্পনা আছে, টেলিভিশনে তা নেই। মুক্তা ফলের মতো নীলাভ ঊষাকালে সেই কল্পনাকে আর কিছুই ছাপিয়ে যেতে পারে না।

মহালয়ার দিন থেকে আর মন থাকে না কাজে। আর তো কয়েকটা দিন। মহালয়া আর পুজোর আর এক স্মৃতি আছে, সেবার পিতামহের অসুখের চিকিৎসার জন্য বাবার হাত একেবারে খালি। পুজোর জামা প্যান্ট হয়নি। কারোরই হয়নি। বড়দা, মেজদা, আমার বোনটিরও। নতুন জামা-কাপড়ের জন্য কাঁদছি আমি। বাবা আমার মামিমার হাতে দশটি টাকা দিয়ে বললেন, শ্যামবাজারে গিয়ে কিনে দাও যা হয়। ফুটপাতের হকারের কাছ থেকে দশ টাকায় জামা, প্যান্ট, অলিম্পিক হাওয়াই...। আহা কী আনন্দ! সেই আনন্দ টিকিয়ে রেখেছি এখনো।

পুজো মানেই মহালয়ার ভোরে সেই মেঘমন্দ্র কণ্ঠে দেবী বন্দনা আর গান। সেই দিন থেকেই আরম্ভ হয়ে যেত পুজো। ঢাকিদের ঢাকের শব্দ শোনা যেত। গ্রামের বাড়ির বারান্দায় বসে ঢাকের শব্দ অতি মধুর লাগত। এখনো যদি ঢাকের শব্দ ভেসে আসে বাতাসে মন কেমন করে ওঠে। ঢাকের বোলে মানুষ জানত দেবী আসছেন। মা আসছেন তাঁর সন্তানদের নিয়ে।

কলকাতার পুজোও ছেলেবেলায় দেখেছি। অনেক শান্ত ছিল এই শহর। লাউড স্পিকারের অত্যাচার ছিল না। নতুন জামার বোতামে গ্যাস বেলুনের সুতো এঁটে বেলুন উড়িয়ে ঠাকুর দেখতে বেরোতাম। বছর দশ তখন। মহিষের পেট থেকে মহিষাসুর বেরিয়ে আসছে খড়্গ হাতে, দেখে বিস্ময়ে অভিভূত।   আর একটু বড় হয়েছি যখন, ১৬-১৭, একবার রাত জেগে কলকাতার বিখ্যাত পুজো প্যান্ডেলে প্রতিমা দর্শন করেছিলাম। সেই প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে কলকাতার সেরা পুজো ছিল, কালীঘাটের সঙ্ঘশ্রী ক্লাবের পুজো। আলোর যাদু থাকত সেই প্রতিমায় আর প্যান্ডেলে। একবার দেখেছিলাম। সেই পুজো এখন বিস্মৃতিতে। উত্তরের সিমলা ব্যায়াম সমিতি এখনো নামী। স্বামী বিবেকানন্দর পল্লী সিমলা। তার ঐতিহ্য টিকে আছে। আছে বাগবাজার সর্বজনীন। ঢাকের সাজে সেই প্রতিমার সাজ। কলকাতার পুজো এখন আমার দেখা হয় না। কলকাতায় থাকলেও বের হই না। উল্লাস আর প্রদর্শন ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠেছে। সব কিছুরই একটি সীমা থাকা দরকার। মহালয়ার দিন থেকে উৎসব আরম্ভ হয়ে যায়, তখন তো দেবীপক্ষই শুরু হয় না। আর নানা বৈভবের উৎকট প্রদর্শন। এর ভিতরে উৎসবের স্নিগ্ধতা হারিয়ে যাচ্ছে। এ থেকে মুক্ত হওয়া দরকার। শারদলক্ষ্মী, দেবী দুর্গা আসেন শুভ্র মেঘের রথে, নির্মল নীল পথে। নির্মল হোক উৎসবের মুখ। নিরন্ন মানুষ, মায়ের সন্তানের মুখে হাসি ফুটুক।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়