ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আদিবাসী লোক কাহিনি ‘দুর্গা’ || অমর মুদি

অমর মুদি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৩, ১৪ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আদিবাসী লোক কাহিনি ‘দুর্গা’ || অমর মুদি

অনেক দূর দেশ থেকে ঘোড়ায় চড়ে ‘দিকু’রা এ দেশে এসেছিল। নদীর মিষ্টি জল, ঊর্বর ক্ষেত, দিগন্ত ছোঁয়া হলুদ, সবুজ ফসলে ভরা মাঠ দেখলেই ওরা আদি বাসিন্দাদের আক্রমণ করে তাড়িয়ে দিয়ে সব দখল করে নিত। আদি বাসিন্দা বা আদিবাসীরা পালিয়ে যেত আরো গভীর জঙ্গলে।তারপর আবার সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

এভাবে অনেক অনেক দিন কেটে যাওয়ার পর আদিবাসীরা তাদের রাজার আসনে বসাল মস্ত বড় এক বীর; নাম উদুরদুর্গ। সে রাজা হওয়ার পরই পাহাড়ের মাথায় বানাল এক মস্ত বড় প্রাসাদ। চারদিকে পাথরের দুর্ভেদ্য প্রাচীর। পাহাড় ঘিরে মস্ত বড় পরিখা, তাতে কিলবিল করছে সাপ। নানা অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত এক সেনাবাহিনীও তৈরি করল উদুরদুর্গ। সে নিজেও মস্ত বীর! এত বড় একটা ধনুক আর বড় বড় তীর নিয়ে যখন সে যুদ্ধে নামত, তখন তার সামনে কেউ দাঁড়াতে পারত না।
বহিরাগত ‘দিকু’রা তাদের রাজা ইন্দ্রের নেতৃত্বে অনেকবার চেষ্টা করেছে আদিবাসী অনার্যদের এই রাজ্য দখল করতে। কিন্তু সেই দুর্ভেদ্য পরীখা আর প্রাচীর ভেদ করে তাদের সৈন্যরা এক পাও এগোতে পারেনি। উদুরদুর্গের রাজত্বে প্রজারা খুব সুখে শান্তিতে ছিল। পশুপাখি নিশ্চিন্তে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত, বিশেষ বিশেষ পর্ব ছাড়া রাজা শিকার করতেন না। একবার শরত কালে ‘করম’ পূজার সময়, আর একবার ‘সাহ্‌রাই’র সময়ে আর ‘ডিসুম্‌ সেন্দ্রার’ দিনগুলোতে। রাজা ভালোবাসতেন নাচগান। টিরিওতে সুর তুলতেন, বাজাতেন তুমদাক্, তামাক্, পূর্ণিমার রাতে সারারাত চলত নাচগান। শুধু একটাই দুঃখ সবার মনে, রাজার বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে অনেকদিন। কিন্তু কাউকেই ওঁর মনে ধরেনি।

এই রাজ্যের সুখশান্তি, ঐশ্বর্য দেখে আশপাশের রাজা, সোনাপতিরা ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে মরত। কিন্তু উদুরদুর্গের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার বেধড়ক মার খেয়েছে ওরা। রাজা নিজে যেমন বীর, তেমনি তাঁর সৈন্য, সেনাপতিরা, রাজার জন্য প্রাণ দিতে পারে ওরা হাসিমুখে; বিশেষ করে ওর দুই সেনাপতি হংস আর মন্ত। কিন্তু একজন রাজা হাল ছাড়েনি। ছলে বলে কৌশলে যেভাবেই হোক সে উদুরদুর্গকে হারিয়ে রাজ্য দখল করবেই। কিন্তু কীভাবে? সামনাসামনি যুদ্ধ করে ওকে হারানো যখন অসম্ভব তখন প্রতিবেশী রাজা ইন্দ্র ছলের আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। মন্ত্রী, সেনাপতিদের সঙ্গে দীর্ঘ সলাপরামর্শ চলল। অবশেষে ঠিক হলো, সেনাপতি পর্বতের অপূর্ব সুন্দরী কন্যা দুর্গা ছদ্মবেশে যাবে উদুরদুর্গের রাজ্যে। নাচে, গানে রাজার মন জয় করে নেবে সে। তারপর, রাজার বিশ্বাস অর্জন করে প্রাসাদে ঢোকার গুপ্তপথ খুঁজে বার করতে হবে তাকে। ইতিমধ্যে ইন্দ্রের সৈন্যবাহিনী পাহাড়ের নিচে জঙ্গলে ডেরা বাঁধবে। দুর্গার সঙ্কেত পেলেই তারা গোপন রাস্তা দিয়ে ঢুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে উদুরদুর্গের সৈন্যদের ওপর।

পরিকল্পনা মতো দুর্গা উদুরদুর্গের প্রাসাদের নিচে জঙ্গলে যোগীনির বেশে ঘুরে বেড়াতে লাগল। প্রহরীরা তাকে দেখতে পেয়ে রাজাকে খবর দিল যে- অতীব সুন্দরী এক কন্যা একা একা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কৌতূহলী রাজা নিজেই প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন সেই সুন্দরী নারীর সঙ্গে কথা বলতে।
‘ওগো মেয়ে তুমি এই জঙ্গলে একা একা ঘুরছ কেন?’
‘দূর গাঁয়ে ঘর আমার নিজের বলতে কেউ নেই। খারাপ লোকেরা আমার ক্ষতি করতে চাইছিল। তাই পালিয়ে এসেছি আমি। শুনেছি এ রাজ্যের রাজা খুব দয়ালু, ভেবেছি তাঁর কাছে আশ্রয় চাইব।’
উদুরদুর্গ বুঝতে পারলেন যে, মেয়েটি তাঁকে চিনতে পারেনি। তাই আর একটু বাজিয়ে দেখার জন্য বললেন, ‘ওগো সুন্দরী, রাজারা কখনোই ভালো লোক হয় না। একবার যদি ওর খপ্পরে পড় ও তোমাকে তার প্রাসাদে বন্দি করে রাখবে। কোনদিন ছাড়বে না।’
‘আমি তো শুনেছি তিনি খুব ন্যায়পরায়ণ, বীর এবং উদার, আমি তাঁর কাছেই আশ্রয় চাইব। একমাত্র তিনিই পারেন দুষ্টু লোকগুলোর হাত থেকে আমাকে বাঁচাতে। ওরা রাজা ইন্দ্রের লোক। তাই ওদের অনেক ক্ষমতা। রাজা উদুরদুর্গ যদি আমাকে রক্ষা না করেন, তাহলে মরা ছাড়া আমার আর কোনো পথ নেই।’
উদুরদুর্গের মনে হলো, এমন সুন্দরী নারী অথচ কত অসহায়। যে কোনো মূল্যে একে ইন্দ্রের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। এইসব ভেবে তিনি নিজের আসল পরিচয় প্রকাশ করলেন।
‘আমিই রাজা উদুরদুর্গ। তুমি আমার প্রাসাদে নিরাপদে থাকবে, কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। আমাদের রাজ্যে নারী জাতির সম্মান সবার উপরে। তুমি নিশ্চিন্তে আমাদের সঙ্গে আসতে পারো।’

দুর্গা প্রাসাদের একটা ঘরে থাকতে লাগল। সময় সুযোগ মতো খুঁজতে লাগল গোপন সুড়ঙ্গ, যার ভেতর দিয়ে প্রাসাদ থেকে সোজা বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা আছে পাহাড়ের নিচে জঙ্গল পর্যন্ত। দুর্গার গতিবিধি প্রহরীদের নজর এড়াল না। রাজার কাছেও খবর পৌঁছল। কিন্তু উদুরদুর্গ তত দিনে দুর্গাকে ভালোবেসে ফেলেছেন। বিয়ের প্রস্তাবও রেখেছেন তার কাছে। মন্ত্রী, সেনাপতিদের পরামর্শ উপেক্ষা করে উদুরদুর্গ এবং দুর্গার বিবাহ মহা ধুমধামের সঙ্গে সম্পন্ন হয়ে গেল।
এই খবর যখন ইন্দ্ররাজার কাছে পৌঁছাল সে তো খেপে আগুন! তার থেকেও বেশী রাগ দুর্গার বাবা পর্বতের। সে ইন্দ্রকেই দায়ী করল তার মেয়ের সঙ্গে অনার্য রাজার বিয়ের জন্য। সবাই বসে সিদ্ধান্ত নিল এর প্রতিশোধ নিতেই হবে অনার্যদের রাজ্য ধ্বংস করে। প্রতিবেশী রাজাদের সঙ্গে চুক্তি করে যৌথ সেনাবাহিনী ঘেরাও করল উদুরদুর্গের রাজ্য। পাহাড়টাকে চারদিক থেকে ঘিরে প্রাসাদের মধ্যেই আটকে রাখল উদুরদুর্গ এবং তার সৈন্যবাহিনীকে। লুটপাট চলতে থাকল জঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনার্যদের গ্রামগুলিতে। ওদের কান্নার আওয়াজ হাওয়ায় ভেসে ভেসে পৌঁছল প্রাসাদে। রাজা অস্থির হয়ে উঠলেন। সেনাপতিকে আদেশ দিলেন সৈন্যদল নিয়ে রাতের অন্ধকারে জঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শত্রু সৈন্যদের ঝটিকা আক্রমণ করতে। নিজেই নেতৃত্ব দেবেন।

মন্ত্রী, সেনাপতিরা রে রে করে উঠল। কিন্তু কে কার কথা শোনে। অবশেষে মাঠে নামল দুর্গা। উদুরদুর্গকে তীর-ধনুক, ঢাল, তলোয়ার দিয়ে নিজেও সাজল যোদ্ধার বেশে। সবাই অবাক! দুর্গা বলল, ‘নারীরা অবলা নয়। অস্ত্র ধরলে ওরা পুরুষদের নাকানি চোবানি খাইয়ে দিতে পারে। অনেক রকম অস্ত্র আছে ওদের। পুরুষদের অত অস্ত্র নেই। আমি যাব রাজার সাথে। ওনার দেহরক্ষী হয়ে।’
উদুরদুর্গ তো মহাখুশী! রাতের অন্ধকারে চুপি চুপি পাহাড় থেকে নেমে আক্রমণ করল ইন্দ্রের বাহিনীকে। ছত্রভঙ্গ করে দিল ওদের। কিন্তু তার মাঝখানে সুযোগ বুঝে দুর্গা গোপন রাস্তাটা দেখিয়ে দিল ইন্দ্রকে। সেদিনের যুদ্ধ জয় করে উদুরদুর্গ প্রাসাদে ফিরে গিয়ে বিজয় উৎসব শুরু করল। রাত নামতেই ইন্দ্র তার সোনাবাহিনীকে গোপন পথে প্রাসাদের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। উৎসবে মাতোয়ারা অনার্য রাজার সৈন্যরা প্রতিরোধ করার সুযোগই পেল না। ওদের কচু কাটা করল ইন্দ্র। দুর্গা এতদিনে বুঝতে পারল ইন্দ্রের আসল উদ্দেশ্য হলো এই রাজ্য অধিকার করা নয়, অনার্যদের ধ্বংস করা।

সে এবার উদুরদুর্গের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত, একদল বিশ্বস্ত সৈন্য নিয়ে ব্যূহ ভেদ করে উদুরদুর্গকে নিয়ে প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে গেল গভীর জঙ্গলে।
ইন্দ্রের কঠোর শাসন এবং শোষণের বিরুদ্ধে প্রজাদের ক্ষোভ বাড়তে লাগল। ওরা উদুরদুর্গ এবং দুর্গার ভালোবাসা এবং স্নেহের কথা ভুলতে পারল না। ওই দুজন হয়ে উঠল তাদের দেবতা বীর এবং দেবী বড়াম।

[উদুরদুর্গ এবং দুর্গার এই উপাখ্যানটি দক্ষিণ বঙ্গের মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া অঞ্চলে প্রচলিত। যদিও বিভিন্ন অঞ্চলে এর কাঠামো আলাদা। তবে মূল কাহিনির মধ্যে কৈলাস পর্বতবাসী শিব এবং রাজার মেয়ে দুর্গার পরিণয়ের একটা ছায়া অত্যন্ত স্পষ্ট।]



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়