ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

পরিস্থিতির চাহিদায় কৌশল পাল্টাবে বিএনপি

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৮, ১৪ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পরিস্থিতির চাহিদায় কৌশল পাল্টাবে বিএনপি

এস কে রেজা পারভেজ : প্রায় দুই বছর রাজপথের আন্দোলন কর্মসূচি থেকে অনেকটা গুটিয়ে নেওয়া বিএনপি আগামী একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছে।

নির্বাচন কমিশন গঠন ও নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়, সেদিকেই তীক্ষ্ম  পর্যবেক্ষণ দলটির। বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতামতের বাইরে এসে ‘বিতর্কিত’ নির্বাচন কমিশন গঠন হলে সেক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন থেকে সরে এসে ফের রাজপথেও দেখা মিলতে পারে দলটির। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতির চাহিদা বিবেচনায় রাজনীতিতে কৌশল পাল্টানোর কথাও বলছেন বিএনপি নেতারা।

বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারনী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য স্বাধীন ইসির বিকল্প নেই। সেটি না হলে হারানো গণতন্ত্র ফিরবে না। গণতন্ত্রের জন্য বিএনপি সংগ্রাম করছে, ভব্যিষ্যতেও রাজপথের সংগ্রাম চলতেই থাকবে।’

এদিকে সময়মতো রাজপথে নামার ইঙ্গিত দিয়ে জনগণকে আস্থা না হারানোর আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘রাজনীতিতে উত্থান-পতন থাকাটা কৌশল। বিএনপি রাজপথে নাই- এ কথা সত্য নয়। আমরা রাজপথে আছি। সময় ও সুযোগমত আবারও আসবো। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া প্রতি আস্থা রাখুন। তার নেতৃত্বই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করে যাব।’

স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠনের সঙ্গে নির্বাচনকালীন একটি ‘সহায়ক সরকার’  চাইছে বিএনপি। এই সরকারকে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ‘ক্লোন’ বলছে অনেকে। তবে আলোচনার মাধ্যমে এর কাঠামো নির্মাণ হলে তা তত্ত্বাবধায়কের মতো হবে না বলে মনে করছে বিএনপি নেতারা। যদিও এখন পর্যন্ত সেই সরকারের রূপরেখা দেয়নি। তবে দলটির নেতারা বলছেন, খুব শিগগিরই এই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনার জন্য ‘সহায়ক সরকার’ এর রূপরেখা দেওয়া হবে।

কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে। নতুন যে কমিশন দায়িত্ব নেবে তাদের অধীনেই হবে আগামী জাতীয় নির্বাচন। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য গত ১৮ ডিসেম্বর বিএনপির সঙ্গে আলোচনা শুরু করে এ পর্যন্ত ২৩টি দলের সঙ্গে সংলাপ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। গত ১১ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলোচনা করে প্রথম পর্বের সংলাপ শেষ করেন তিনি। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য মতামত নিতে দ্বিতীয় দফায় আরো ৮টি দলকে বঙ্গভবনে ডেকেছেন রাষ্ট্রপতি।

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনায় ইসি গঠনে বিএনপি বেশকিছু প্রস্তাব দিয়েছে। মূলত গত বছরের ১৮ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে খালেদা জিয়া যেসব প্রস্তাব তুলে ধরেছেন সেগুলো বিএনপির মতামত বলে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকে তুলে ধরেন দলটির নেতারা। এর মধ্যে ‘সব দলের’ মতৈক্যের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, এই কমিশন হতে হবে ‘সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল, অথবা স্বাধীনতার পর প্রথম জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে এমন সব রাজনৈতিক দলের’ মতৈক্যের ভিত্তিতে। ইসি নিয়োগ প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি ঠিক করতে রাষ্ট্রপতি ‘প্রধান দুই রাজনৈতিক জোট’ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রতিনিধিসহ সব দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে মতামত তুলে ধরা হয়েছে। এ আলোচনায় নাগরিক সমাজের মধ্য থেকে সৎ, যোগ্য ও দল নিরপেক্ষ প্রতিনিধিদেরও যুক্ত করা যেতে পারে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকে সব দল পাঁচ সদস্যের বাছাই কমিটি গঠনের জন্য প্রতি পদের বিপরীতে দুই জনের নাম প্রস্তাব করবে। সেখান থেকে সব দলের মতৈক্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি পাঁচ সদস্যের বাছাই কমিটি গঠন করবেন। তারাই প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের খুঁজে বের করবেন।

কারা নির্বাচন কমিশনে আসতে পারবেন আর পারবেন না, সে বিষয়েও প্রস্তাব রাখা হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দায়িত্ব পালনকারী কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে আপত্তি জানানো হয়েছে। এ ছাড়া কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ বা প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগের চাকরি থেকে অবসর, পদত্যাগ বা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ বা চুক্তি বাতিলের পর তিন বছর না পেরোলে তিনি নির্বাচন কমিশনের কোনো দায়িত্বে আসতে পারবেন না বলে শর্ত রয়েছে।

বিএনপি নেতারা বলছেন, এই প্রস্তাবের আলোকে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে তা নয়। এই প্রস্তাবকে ভিত্তি ধরে অন্য রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে যোগ-বিয়োগ করে একটি সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব। তবে নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপির প্রস্তাবকে অন্তসারশূন্য বলে আওয়ামী লীগ নেতারা উড়িয়ে দেওয়ার পরও আশা হারাচ্ছে না দলটির নেতারা। পর্যবেক্ষণ করছেন শেষ পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। তবে শেষ পর্যন্ত বিতর্কিত নির্বাচন কমিশন গঠন হলে পরিস্থিতি অনুযায়ী রাজনীতিতে কৌশল পাল্টাবে বিএনপি। সেক্ষেত্রে ফের রাজপথের আন্দোলনের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া ছাড়া কোনো পথ থাকবে না বলেও মন্তব্য করেন তারা।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সরকার যদি সবার মতামতের বাইরে গিয়ে ‘নিজেদের পছন্দসই লোকদের’ ইসিতে বসাতে চায় অথবা আইন প্রণয়ন করে, তা জাতি কোনোদিন মেনে নেবে না।

তিনি বলেন, ‘নতুন নির্বাচন কমিশনের যারা অধিকর্তা হবেন, তাদের প্রতি যেমন আওয়ামী লীগের আস্থা থাকতে হবে, তেমনি বিএনপিরও আস্থা থাকতে হবে, ২০ দলীয় জোটেরও আস্থা থাকতে হবে, অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও আস্থা থাকতে হবে। সেই আস্থা না থাকলে একতরফা নির্বাচন কমিশন গঠন হলে এটি কেউ মেনে নেবে না।’

স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘অতীতে দেশের মানুষের নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। সেজন্য হারানো গণতন্ত্র ফেরাতে নিরপেক্ষ ইসি গঠন করতে হবে। রাষ্ট্রপতির কাছে সেই ভরসা বিএনপির রয়েছে। স্বচ্ছ ও স্বাধীন ইসি না হওয়া পর্যন্ত বিএনপির সংগ্রাম চলবে।’

বিএনপি সূত্র বলছে, নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার- এই দুটি বিষয়ের ওপরই দলটির ফোকাস। কারণ একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অবশ্যই অংশ নিতে হবে। তা না হলে নিবন্ধন বাতিলের হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে নির্বাচন কমিশন। তবে বিএনপি চাচ্ছে যতটা সম্ভব নিরপেক্ষ লোক ইসিতে আসুক। এজন্য আপাতত সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের রাজনীতিতে আছে দলটি।

এদিকে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে নির্বাচন কমিশন নিয়ে আলোচনায় আওয়ামী লীগের ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন-ইভিএমের প্রস্তাবকে সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপি। একই সঙ্গে অন্যসব দল এই সরকারের সময়েই ইসি নিয়ে স্থায়ী আইন চাইলেও এর বিরোধিতা করেছে বিএনপি। বর্তমান সরকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না, দাবি করে দলটি একটি ‘গণতান্ত্রিক সরকারের’ সময়ে ইসি নিয়ে আইন প্রণয়নের কথা বলছে। ইভিএম নিয়ে খুব বেশি মাথা না ঘামালেও বিএনপি চাচ্ছে না এখনই এই পদ্ধতি অনুসরণ হোক। অন্তত জাতীয় নির্বাচনের পরিবর্তে আগে স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পক্ষে বিএনপি। দলটির নেতাদের সন্দেহ কারচুপি করতেই সরকার ইভিএম পদ্ধতি প্রয়োগের কথা বলছেন।

রুহুল কবির রিজভী বলেন, বর্তমান ‘একতরফা পার্লামেন্টে’ আইন হলে তা সবার গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। আর ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ফেরালে তাতে নির্বাচনে ‘ডিজিটাল কারচুপি’ হবে।

‘ভোট ডাকাতি, ব্যালট বাক্স ছিনতাই, রাত ৩টা সময় ব্যালট বাক্স উধাও, ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের যাওয়ার পরিবর্তে সেখানে অন্য প্রাণীদের যাতায়াত, ইত্যাদি সবকিছুতে আওয়ামী লীগ সরকার বিশেষ স্টাইল দিয়েছে। ইভিএম চালু করলে আরেকটি দুর্নীতি হবে’, বলেন বিএনপির এই নেতা।

এই সরকারের সময়ে ইসি গঠনের আইন প্রণয়নের বিরোধিতা করে তিনি বলেন, ‘নিজের মতো করে যদি আইন করেন তাহলে তো সব দলের সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন কমিশন গঠন হবে না। মানুষের মনে বিরাট সন্দেহ আছে। এই সরকারের প্রত্যেকটি আইন হচ্ছে গণবিরোধী, লুটপাটের পক্ষে, প্রত্যেকটি আইন হচ্ছে দুর্নীতির পক্ষে।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ জানুয়ারি ২০১৭/রেজা/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়