ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস

এখন প্রয়োজন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

আবু বকর ইয়ামিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০১, ১২ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এখন প্রয়োজন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

আবু বকর ইয়ামিন : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞে নিহতদের স্মরণে দিবসটিকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় জাতীয় সংসদের প্রতি স্বাগত জানিয়েছেন বিশিষ্টজনরা।

তারা বলছেন, জাতীয় সংসদের এমন উদ্যোগকে স্বাগত। এ ধরনের গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই আছে। সে কারণে ২৫ মার্চের গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও প্রয়োজন রয়েছে। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে দিবসটি স্মরণ করা জরুরি। পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধ, গণহত্যাগুলো প্রতিরোধের জন্য ২৫ মার্চ দিবসটিকে নির্বাচিত করে সারা বিশ্বে দিবসটিকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করা যেতে পারে।

এ বিষয়ে জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল রাইজিংবিডি ডটকমকে  রোববার মতামত জানিয়েছেন বিভিন্ন শিক্ষাবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক রাইজিংবিডিকে বলেন, ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ যে গণহত্যা শুরু হয়েছে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত সে গণহত্যা নানাভাবে অব্যাহত ছিল। এ ধরনের উচ্চমাত্রার গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও নেই। সে কারণে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ, গণহত্যাগুলো বন্ধ করতে হবে। সে গণহত্যা প্রতিরোধের জন্য ২৫ মার্চ দিবসটিকে নির্বাচিত করে সারা বিশ্বে দিবসটিকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করা যেতে পারে। গণহত্যা রোধে এ দিবসটিকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। এ ধরনের গণহত্যা যেন আর কোথাও পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য আজকে এটি অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে যে প্রস্তাব গৃহিত হয়েছে আমরা আশা করি সরকার জাতিসংঘে এমন একটি প্রস্তাব দিবে এবং খুব শিগগির জাতিসংঘ এ প্রস্তাব গ্রহণ করবে।

পাকিস্তানসহ যেসব দেশ আজ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে সেসব বন্ধে অবশ্যই একটি দিনকে গণহত্যা দিবস হিসেবে চিহ্নিত করা দরকার। সারা বিশ্বের মানুষের সচেতনতার জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দিবসটিকে গুরুত্ব দিয়ে পালন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

তিনি আরো ‍বলেন, জাতীয়ভাবে স্বীকৃতির আগেও আমরা সবসময় ২৫ মার্চের কালরাত্রির ঘটনাকে প্রতি বছরই স্বরণ করি এবং ভবিষ্যতে যাতে এ জাতীয় ঘটনা না ঘটে সেজন্য সবরকম দায়িত্ব পালন করে চলেছি। এর সাথে আন্তঃরাষ্ট্রীয় কার্যক্রম যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। তাই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে দিবসটি পালন করা জরুরি। এক্ষেত্রে দিবসটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাস্তবায়নে আমাদের কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা দরকার আছে। জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের কাছে আমাদের প্রত্যাশা গুরুত্বসহকারে তুলে ধরতে হবে। জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে বিষয়টি উপস্থাপন করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, এমন একটি মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড অবশ্যই স্মরণ রাখা দরকার। সে রাত্রিতে যে ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সেটি অবর্ণনীয়। এতদিন পর জাতীয় সংসদের শুভবুদ্ধি হয়েছে যে তারা দিবসটিকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বীকৃতিতো বহু আগে থেকেই বিভিন্নভাবে জানিয়ে আসছে। অনেক দেরিতে স্বীকৃতি জানানোর পরও আমি তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের ইতিহাস হলো বঞ্চিত হওয়ার, শোষিত হওয়ার ইতিহাস। বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হওয়ার ইতিহাস। সুতরাং এটাও একটা বড় ঘটনা এবং ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটা অবশ্যই জাতীয়ভাবে স্মরণ রাখা দরকার।’

এমাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ স্বীকৃতিটা প্রয়োজন। এর জন্য মধ্যপ্রাচ্য, ফ্রান্স, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে বাঙালিরা অবস্থান করছেন তারা দিবসটি নিয়ে আলোচনা করতে পারে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি মেলাতে বিভিন্ন উদ্যোগ প্রয়োজন। যেকোনো জায়গা থেকে এমন একটি প্রস্তাব ইউনেস্কোর প্রধান কার্যালয়ে পৌঁছানো যেতে পারে। এর জন্য একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। এর একটি বিশেষ সুবিধা হলো কমিটি গঠনের মাধ্যমে কোনো প্রস্তাব দিলে ইউনেস্কো সেটি গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে এক জাতির ব্যাপার তুলে না ধরে আরো কয়েক জাতির নাগরিক এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকলে সহজ হয়। যেমন ২১ ফেব্রুয়ারির স্বীকৃতির জন্য ভারত, চীন, জার্মানি, জাপানসহ আর্ন্তাজিতক ৯টি জাতির তরুণ প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। গণমাধ্যম এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে।

এ প্রসঙ্গে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, জাতীয় সংসদের এমন একটি উদ্যোগ সত্যিই খুশির খবর। ২৫ মার্চের যে গণহত্যা হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব আছে বলে আমার জানা নেই। কাজেই অবশ্যই আমরা জাতিগতভাবে যদি সেটি পালন না করি খুবই দুঃখজনক হবে। সংসদের এমন উদ্যোগকে স্বাগত। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমার ধারণা সরকার সচেষ্ট হলে ২৫ মার্চও আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে। আমি মনে করি এর জন্য আরো ভালোভাবে চেষ্টা করতে হবে। ভবিষ্যৎ  প্রজন্ম বিষয়টি আলাদাভাবে জানতে পারবে। দেশের সম্পর্কে জানতে আরো আগ্রহী হবে, উৎসাহী হবে, দেশের জন্য মমত্ব বাড়বে।

ব্যারিস্টার এম আমীর উল ইসলাম বলেন, ২৫ মার্চের যে হত্যাকাণ্ড সেটি পৃথিবীর জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। এটিকে জার্মানির হিটলারের হলোকাস্টের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। তুলনামূলকভাবে এটি তার চেয়েও মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ছিল। নারী শিশু নির্বিশেষে সব ধরনের মানুষের ওপর যে অত্যাচার তারা করেছিল আন্তর্জাতিক আইনে এটি অনেক বড় অপরাধ। এটি গণহত্যা দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিকভাবে যে প্রক্রিয়ায় স্বীকৃতি পেয়েছে সেভাবে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেতে পারে।

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর উদ্দিন খান মামুন বলেন, এটি জাতীয় পর্যায়ে প্রভাব ফেলবে। উপজেলা পর্যায়ে যখন দিবসটি পালিত হবে, গণহত্যার কথা যখন বার বার স্মরণে আসবে তখন একটি প্রভাব ফেলবে। আবার অন্যদিকে সরকার যদি চেষ্টা করে আমরা জাতীয়ভাবে পালন করছি আমরা এটার স্বীকৃতি চাই যে এটা গণহত্যা ছিল তাহলে একটা প্রভাব পড়বে। পাকিস্তান যেসব কাজ করছে এগুলো প্রতিহত করা যাবে। তবে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়াটা সম্ভব হবে না। বিভিন্ন দেশের সংসদে দিবসটির কথা স্মরণে জাতিসংঘের উদ্যোগ নিতে পারে। জাতিসংঘ গণহত্যার তালিকায় দিবসটি নিয়ে আসতে পারে। এ বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।

শনিবার প্রায় সাত ঘণ্টা আলোচনার পর সংসদে সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদসহ ৫৬ জন সংসদ সদস্য এই আলোচনায় অংশ নেন।

প্রস্তাবে বলা হয়, ‘সংসদের অভিমত এই যে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যাকে স্মরণ করে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হোক এবং আন্তর্জাতিকভাবে এ দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা হোক।’

আলোচনা শেষে স্পিকার ড. শিরিন শারমিন প্রস্তাবটি ভোটে দিলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। এ সময় সকল সংসদ সদস্য তাতে সমর্থন জানান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলোচনায় অংশ নিয়ে এই প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এই গণহত্যার প্রমাণ লাগে না। বিশ্বের বিভিন্ন প্রত্রিকায় এসেছে- কীভাবে গণহত্যা হয়েছে।’

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ মার্চ ২০১৭/ইয়ামিন/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়