ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পরাজয়ে ধুঁকছে জয়পাড়া

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২৪, ২৩ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পরাজয়ে ধুঁকছে জয়পাড়া

শাহেদ হোসেন : উপরে টিনের চালা, তবে চারদিক খোলা। ভেতরে একপাশে সামনে লুঙ্গি নিয়ে বসে আছেন জনাবিশেক বিক্রেতা। একটু এগিয়ে পশ্চিম পাশে দুজন বসে আছেন রঙিন সুতার স্তুপ নিয়ে। ছোট এই ছাউনিতে খুব বেশি লোক না হলেও সরগরম একটু বেশি।

চলছে লুঙ্গির দরদাম। কেউ একেক দোকান থেকে লুঙ্গি কিনে বাধাইছাদাই করছেন, আবার কেউ বিক্রেতার পাশে দাঁড়িয়ে দাম শোনার চেষ্টা করছেন।

ঢাকার দোহার উপজেলার জয়পাড়ার লুঙ্গির হাটের চিত্র এটি। প্রতি সোমবার সকাল ৮টা থেকে তাঁতীরা এই হাটে আসতে শুরু করেন। দুপুর দেড়টা নাগাদ ফাঁকা হয়ে যায় পুরো হাট। এর মধ্যেই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পাইকাররা ঐতিহ্যবাহী জয়পাড়ার তাঁতের লুঙ্গি কেনাটা সেরে ফেলেন।

জয়পাড়ার লুঙ্গির এতো সুনাম কেন? প্রশ্নটি করতেই তাঁতী আলাউদ্দিন ব্যাপারী হাতে এক ভিম লুঙ্গি তুলে দিয়ে বললেন- ‘হাত লাগায়া দ্যাখেন, তাইলেই বুঝতে পারবেন মিলের লুঙ্গির লগে আমগো জয়পাড়ার লুঙ্গির ফারাক। মিলের লুঙ্গি যতো পরবেন দেখবেন বস্তার মতো মোটা অইতাছে। আর এই তাঁতের লুঙ্গি যতো পরবেন দেখবেন আস্তে আস্তে নরম-মিহি অইতাছে।’

হাট কমিটির সদস্যরা ও তাঁতীরা জানিয়েছেন, ভালো সুতা, পাকা রঙ, নকশায় স্বকীয়তা ও ব্যবহারে আরামদায়ক হওয়ায় জয়পাড়ার লুঙ্গির সুনাম দেশজুড়ে। এই গ্রামের তাঁতীরা এই লুঙ্গির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বলেই এই লুঙ্গির নাম জয়পাড়ার লুঙ্গি। একটা সময় ছিল যখন ঢাকার লোকজন লুঙ্গি বলতে জয়পাড়া আর রুহিতপুরের তাঁতের লুঙ্গিকেই বুঝতেন। তবে যন্ত্রে বুননের লুঙ্গির সঙ্গে উৎপাদন ও দামে পাল্লা দিয়ে টিকতে না পেরে এই দুটি এলাকার লুঙ্গির বাজার অনেকটা কমে গেছে। যন্ত্রে বোনা লুঙ্গির চেয়ে তাতে ও হাতে বোনা লুঙ্গির দাম বেশি হওয়ায় সৌখিন মানুষ ছাড়া অন্যরা এই লুঙ্গি খুব একটা কিনতে চায় না।

জয়পাড়ায় লুঙ্গি বিক্রি হয় ভিম হিসেবে। এক ভিমে ৬টা লুঙ্গি বোনা হয়। একজন তাঁতী একা সপ্তাহে মাত্র দুই ভিম লুঙ্গি তৈরি করতে পারেন। কাপড়ের মান ভেদে ৬টা লুঙ্গি পাইকারি বিক্রি করা যায় ২ হাজার ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। আমানত শাহ লুঙ্গি জয়পাড়ার তাঁতীদের কাছ থেকে সরাসরি লুঙ্গি নেয়। এছাড়া স্থানীয় ফড়িয়াদের মাধ্যমে অনুসন্ধান, ফজর আলীসহ বিভিন্ন বড় বড় লুঙ্গি বিপণন প্রতিষ্ঠান এখান থেকে লুঙ্গি সংগ্রহ করে বলে তাঁতীরা জানিয়েছেন। তাদের মাধ্যমে বিদেশেও যাচ্ছে জয়পাড়ার লুঙ্গি।

অনেকেই পাবনা ও অন্যান্য অঞ্চলে উৎপাদিত পাওয়ার লুমের লুঙ্গি জয়পাড়ার বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। জয়াপাড়ার তাঁতের লুঙ্গি কিনতে গেলে প্রথমেই ক্রেতাকে কাপড়ে হাত দিয়ে এর মসৃনতা বুঝতে হবে। আর যারা তাও চিনতে পারবেন না, তাদেরকে খেয়াল রাখতে হবে লুঙ্গির পাড়ের দিকে। হাতে ও তাঁতে বোনা লুঙ্গির পাড়ে অবশ্যই ছিদ্র থাকবে। পাওয়ারলুমের লুঙ্গিতে এটি থাকবে না।

হাট কমিটির উপদেষ্টা মোহাম্মদ আলী ব্যাপারী জানান, জয়পাড়ার এই লুঙ্গির হাট শতবর্ষের পুরনো। এককালে এখানে শতাধিক তাঁতী বসতো। কিন্তু তাঁতের কাপড়ের চাহিদা কমে যাওয়ায় ধীরে ধীরে তাঁতীরা এই পেশা ছেড়ে যাচ্ছে। এখন জনাবিশেক তাঁতীকেও হাটের দিন পাওয়া যায় না।

 



তাঁতের কাপড়ের দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য মোহাম্মদ আলী অবশ্য মধ্যসত্বভোগীদের দুষলেন। ক্ষোভের সঙ্গেই তিনি বললেন, ‘আমাগো কাছ থেকে যেই লুঙ্গি ৫০০ টাকায় নিয়া যায়, মার্কেটে তারা সেগুলা হাজার টাকায় বিক্রি করে। আর এই কারণে দাম বেশি দেইখ্যা লোকজন তাঁতের লুঙ্গি কিনতে চায় না।’

তাঁতীরা যে ধীরে ধীরে তাদের আদি পেশা থেকে সরে যাচ্ছেন তার সঙ্গে সায় দিলেন হাটে লুঙ্গি বিক্রি করতে আসা আলাউদ্দিন ব্যাপারী। রায়পাড়া খালপাড়ের এই বাসিন্দা জানান, প্রায় ২৫ বছর ধরে তিনি এই হাটে আসছেন লুঙ্গি বিক্রি করতে। তার নিজের তাঁত মাত্র একটি। তার বোনা লুঙ্গি সব ৮৪ কাউন্টের। তাঁতের একটি লুঙ্গি বুনতে দুই দিনে প্রায় ৩৭ মুড়া সুতা লাগে। আর এক মুড়া সুতার দাম এখনকার বাজারে ৫০ টাকা। অন্যান্য খরচ মিলিয়ে একটি লুঙ্গি বাজারে আনতে খরচ পড়ে প্রায় আড়াই হাজার টাকা। সব মিলিয়ে লুঙ্গি বুনে এখন আর পোষায় না।

তাহলে এখনো এই পেশা ধরে রেখেছেন কেন জানতে চাইলে আলাউদ্দিন বললেন, ‘অন্য কোনো কাম শিহি নাইক্যা। এইডা ছাইড়া আর কই যামু?’ তবে নিজের দুই ছেলেকে এই পেশা থেকে পুরোপুরি দূরে রেখেছেন বলে জানান তিনি।

হাটে লুঙ্গি বিক্রেতাদের পেছনেই বসেছেন দুই তাঁত মিস্ত্রি। তাঁত যন্ত্র মেরামত করাই তাদের কাজ। তবে বাজারে বসেছেন চরকা, নালী, মাকুসহ লুঙ্গি বুননের আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্র নিয়ে। এদেরই একজন শহীদুল জানালেন, তিনি ৪০ বছর ধরে এই হাটে আসেন। যতো দিন যাচ্ছে তাঁতীর সংখ্যা ততোই কমছে। তাই তাঁত মিস্ত্রিদেরও এখন দুরাবস্থা চলছে।

হাট কমিটির উপদেষ্টা মোহাম্মদ আলী ব্যাপারী জানালেন, জয়পাড়া ইন্ডস্ট্রিয়াল সোসাইটি নামে তারা একটি সংগঠন করেছেন। এতে ২ হাজার ১৫৭ জন তাঁতী আছেন। প্রতি বছর তারা তাঁতীদের চিকিৎসা ও তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য আর্থিক সহায়তা দেন। সংগঠনের টাকা দিয়ে বাজারে দুটি ভবনও নির্মাণ করা হয়েছে। তারা চেষ্টা করছেন তাঁতীদের জন্য কিছু একটা করতে।

ফেরার সময় আবেগে আপ্লুত হয়ে এই লুঙ্গি ব্যবসায়ী বললেন, ‘আপনেরা একটু লেখেন। আমগো তাঁতীগো দুরাবস্থার কথা আপনেরা জানান।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ মার্চ ২০১৭/শাহেদ/ শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়