প্রত্যন্ত অঞ্চলে জঙ্গিবাদের পেছনে চার কারণ
আহমদ নূর : দেশে বর্তমানে ‘ক্যান্সার’ হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘জঙ্গিবাদ’। রাজধানীতে প্রতিহত হয়ে বিভিন্ন জেলা শহরে এখন জঙ্গিদের আস্তানার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা একে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, জঙ্গিদের উত্থানটাই ছিল রাজধানীর বাইরে। তাই, রাজধানীর বাইরে অবস্থান করার অর্থ তারা আর শক্তিশালী নয়।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে জঙ্গিদের আস্তানা তৈরির পেছনে চারটি মূল কারণ চিহ্নিত করেছেন অপরাধ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। সূচনালগ্ন থেকে জঙ্গিদের অবস্থান পর্যালোচনা করে বিশ্লেষকরা এসব কারণ চিহ্নিত করেছেন।
এই চারটি কারণের মধ্যে রয়েছে- ব্লক রেইডসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন অভিযান থেকে নিজেদের রক্ষা করা, সংকটকালীন সময়ে নিরাপদ জায়গায় থাকা এবং বড় হামলার জন্য নিরপাদ দূরত্বে থেকে সরঞ্জাম তৈরি ও সংগ্রহের কাজ করতে তারা ঢাকার বাইরে অর্থাৎ প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকে। অন্যদিকে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে ঢাকা বা এর আশপাশের এলাকা থেকে মফস্বল শহর বা প্রত্যন্ত এলাকা অনেক নিরাপদ বলে তারা চিন্তা করছে।
এ ক্ষেত্রে যেসব জায়গা তারা তাদের আস্তানা হিসেবে গড়ে তুলছে সেসব জায়গা যেন অন্য কারো সন্দেহে না আসে এমন বিষয় জঙ্গিদের পরিকল্পনায় থাকছে। এ জন্য তারা বাসা ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দিচ্ছে। কৌশল হিসেবে তারা প্রতিবেশীদের ব্যস্ততা দেখাচ্ছে, যেন কেউ সন্দেহ করতে না পারে বা কেউ সহজে মিশতে না পারে।
তাই জঙ্গি নির্মূলে ও বিস্তার ঠেকাতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নজরদারির পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেশিরভাগ জঙ্গি সংগঠনগুলোর উত্থান এবং তাদের আস্তানাগুলো ছিল বিভিন্ন জেলা শহরে বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ১৯৬৮ সালে আত্মপ্রকাশ করা বাংলাদেশের প্রথম মাওবাদী সংগঠন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রম ছিল দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা ও যশোরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে।
১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল মাওলানা আব্দুস সালাম হরকাতুল জিহাদ আল ইসলাম (হুজি) বাংলাদেশ শাখার ঘোষণা দেন। এরপর সংগঠনটি তাদের বেশিরভাগ কার্যক্রমের পরিচালনা করে জেলাশহরগুলোতে। এর মধ্যে ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে উদিচি সোসাইটিতে ও ৮ অক্টোবর খুলনার আহমদিয়া মসজিদে বোমা হামলা চালায় তারা। ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় শেখ হাসিনার সভামঞ্চে বোমা হামলার চেষ্টা চালায় হুজি। এ ছাড়া ২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা, গোপালগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাট, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জে বেশ কয়েকটি হামলা চালায় এ জঙ্গি সংগঠন।
নব্বইয়ের দশকে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ করে জঙ্গি সংগঠন জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে এ সংগঠন তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করত।
১৯৯৮ সালে ঢাকা বিভাগের পালামপুর নামের একটি জায়গা থেকে শায়েখ আব্দুর রহমান জামাত-উল-মুজাহিদীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে এতে যোগ দেন জাগ্রত মুসলিম জনতার প্রতিষ্ঠাতা বাংলা ভাই। ২০১৬ সালে ব্রিটেন সরকারের প্রকাশিত প্রসক্রাইবড টেররিস্ট অর্গানাইজেশন্সে (নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন) বলা হচ্ছে, ২০০২ সালের ২০ মে জেএমবির আট সদস্য গ্রেপ্তারের পর এটি প্রথম আলোচনায় আসে। বগুড়া, সিরজগঞ্জ, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, নওগাঁ, নাটোর, রাজশাহী, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, বাগেরহাট, যশোর, খুলনা, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, চাঁদপুর, লক্ষীপুর এবং চট্টগ্রামে জেএমবি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করত।
গতবছর ঢাকার গুলশানে জঙ্গি হামলার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিদের আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। শুধু এ বছরের মার্চ মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঁচটি জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় গোয়েন্দারা। এর সবক’টি ঢাকার বাহিরে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ও অপরাধ বিশ্লেষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘হলি আর্টিজানে হামলার পর থেকে ঢাকায় যখন ব্লক রেইডসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো হলো তখন জঙ্গিরা সারভাইব করার জন্যই ঢাকার বাহিরে যাওয়া শুরু করল। যুদ্ধের নিয়মই হচ্ছে, যখন সম্মুখ সমরে কেউ পরাস্ত হয়ে যায়, তখন স্বাভাবিকভাবে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে আশাপাশে জায়গায় অবস্থান নেয়। কারণ সেসব জায়গা তাদের জন্য নিরাপদ থাকে। জঙ্গিরাও ঠিক একই কারণে অর্থাৎ নিজেদের নিরাপত্তার কারণে ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দাদের বাড়তি তৎপরতা দেখে জঙ্গিরা তাদের আস্তানাগুলোকে ঢাকার বাহিরে নিয়ে গেছে। তারা ভাবছে ঢাকায় থাকাটা অনেক ডিফিকাল্ট। জঙ্গিরা নিজেদের নিরাপত্তার বিষেয় জেলা ও মফস্বল শহরগুলোতে অনেক আস্থাশীল। অন্যদিকে তারা সেখান থেকে বোমা তৈরি বা অস্ত্র সংগ্রহ করে নিজেদের কাছে রাখতে পারছে। প্রয়োজনে তা আবার ঢাকায় নিয়ে আসতে পারছে।’
তিনি বলেন, ‘জঙ্গিরা জেলা বা মফস্বল শহরগুলো অবস্থান করে সেখানে তাদের সদস্যদের নানা প্রশিক্ষণ দিতে পারছে। সেক্ষেত্রে সেখানে তাদের কেউ সন্দেহই করতে পারবে না বলে তারা ভাবছে।’
এদিকে মাহফুজুল হক মারজান বলেন, ‘যেহেতু জেলা শহর বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে জঙ্গিরা আস্তানা গড়ে তুলেছে সেহেতু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ওইসব এলাকার ক্ষেত্রে আরো সজাগ থাকতে হবে। জঙ্গিদের মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে রিক্রুট করা হয়। সেদিকেও নজরদারি বাড়াতে হবে।’
জঙ্গি সমস্যা সমাধানে এ অপরাধ বিশ্লেষক আরো বলেন, ‘জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে পাল্টা মতাদর্শ তৈরি করতে হবে। তা না হলে গোয়েন্দা তৎপরতায় কিছু জঙ্গি মারা যাবে। পরে আবার তা তৈরি হবে। কিন্তু স্থায়ীভাবে এর সমাধান হবে না।’
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ এপ্রিল ২০১৭/নূর/হাসান/সাইফুল
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন