ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৪ বছর : থমকে আছে বিচার

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৩৬, ২৪ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৪ বছর : থমকে আছে বিচার

নিজস্ব প্রতিবেদক : রানা প্লাজা ধসের চার বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত মামলার বিচারে কোনো অগ্রগতি নেই। অনেকটা থমকে আছে।

২০১৩ সালের এই দিনে রানা প্লাজা ভবন ধসের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ১ হাজার ১৩৬ জন নিহত এবং আহত হন প্রায় ২ হাজার জন।

বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেওয়া ওই ঘটনায় ৩টি মামলা হয়। ত্রুটিপূর্ণ জেনেও শ্রমিকদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগে মামলাটি করে পুলিশ, সরাসরি হত্যার অভিযোগে আরেকটি মামলা করেন নিহত শ্রমিক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী শিউলী আক্তার এবং বিল্ডিং কোর্ড অনুসরণ না করার অভিযোগে ইমারত আইনে মামলাটি করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।

৩টি মামলার মধ্যে পুলিশের এবং নিহত শ্রমিক জাহাঙ্গীরে স্ত্রী শিউলী আক্তারের মামলা ২টির একসঙ্গে এবং অপরটির আলাদা তদন্ত হয়। ঘটনার দুই বছরের বেশি সময় পর ২০১৫ সালের ১ জুন তদন্ত শেষে আদালতে পৃথক দুটি অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর।

পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগে ভবন মালিক সোহেল রানা ও তার মা-বাবাসহ ৪১ জনকে এবং ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণের অভিযোগে সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়। দুটি অভিযোগপত্রে মোট আসামি ৪২ জন। এর মধ্যে সোহেল রানাসহ ১৭ জন দুটি মামলারই আসামি। এ ছাড়া রানা প্লাজা নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে পৃথক আরেকটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া ৩টি মামলার মধ্যে হত্যাসহ ২ মামলার বিচার অভিযোগ গঠনের পর উচ্চ আদালতে নির্দেশ প্রায় এক বছর ধরে নিম্ন আদালতে বিচার কাজ স্থগিত রয়েছে। ওই কারণে গত এক বছরে নিম্ন আদালত কোনো সাক্ষ্যগ্রহণ করতে পারেনি।

অন্যদিকে রানা প্লাজার ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অপর মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানির পর আগামি ৮ মে আদেশের জন্য ধার্য রয়েছে।

হত্যা মামলা : হত্যা মামলায় ২০১৫ সালের ১ জুন রানা, তার বাবা-মাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে সিআইডির সহকারি পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর। এরপর প্রায় এক বছর ধরে মামলাটির পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এবং পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের পর মামলাটি বিচারের জন্য প্রস্তুত হওয়ার পর ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়।

ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।

মামলার ৪১ আসামির মধ্যে মো. শাহ আলম ওরফে মিঠু, মো. আবুল হাসান ও সৈয়দ শফিকুল ইসলাম জনির বিরুদ্ধে আসামি সোহেল রানাকে পালাতে সহযোগিতার জন্য দণ্ডবিধির ২১২ ধারায় এবং অপর ৩৮ আসামির বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়। একইসঙ্গে ওই বছর ১৮ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ঠিক করা হয়। কিন্তু হত্যার ধারায় অভিযোগ গঠন করা ৩৮ আসামির মধ্যে ৭ জন চার্জ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে আবেদন করায় হাইকোর্ট মামলাটির নিম্ন আদালতের কার্যক্রম স্থগিত করে। ফলে ওই কারণে এখন পর্যন্ত সাক্ষ্য গ্রহণ করতে পারেনি আদালত।

সর্বশেষ গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণের ধার্য দিনের একই কারণে সাক্ষ্য গ্রহণ পিছিয়ে আগামী ৭ মে পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন বিচারক।

একইসঙ্গে ওইদিন বিচারক ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটরকে অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে মামলার স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়ে অথবা পৃথকভাবে মামলার অভিযুক্ত অপর আসামিদের বিচারকাজ চালানো যায় কি না সে বিষয়ে পরামর্শ করার পরামর্শ দেন।

এ সম্পর্কে পাবলিক প্রসিকিউটর খোন্দকার আব্দুল মান্নান বলেন, মামলার ৭ জন আসামি চার্জ গঠনের আদেশ চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে গিয়েছেন। হাইকোর্ট ওই ৭ জনের আবেদনে নিম্ন আদালতের পুরো মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেছেন। আমরা ওই কারণে নিম্ন আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ করতে পারছি না। আমরা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়কে চিঠি দিয়েছে, কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো রেসপন্স পাইনি।

রাজউকের ইমারত নির্মাণ আইনের মামলা : ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে রানা প্লাজা ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন ১৩ জনকে আসামি করে সাভার থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায়ও হত্যা মামলার সঙ্গে ২০১৫ সালের ১ জুন পৃথক একটি অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডির ওই কর্মকর্তা। অভিযোগপত্রে ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়। এই মামলার ১৮ আসামির মধ্যে ১৭ জনই হত্যা মামলা আসামি।

২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ  গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। একই সঙ্গে ওই বছরের ২৩ আগস্ট সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন।

অভিযোগ গঠনের পর আসামিদের মধ্যে ৩ জন চার্জ গঠনের আদেশ বাতিলের জন্য ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পৃথক ৩টি রিভিশন মামলা দায়ের করেন। ওই রিভিশন মামলার মধ্যে একটি গত ১০ এপ্রিল খারিজ হলেও অপর দুইটি রিভিশন মামলা বিচারাধীন থাকায় মামলাটিতে এখনো সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করতে পারেনি আদালত। মামলাটিতে আগামি ১৭ মে সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য আছে।

এ সম্পর্কে ওই আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর আনোয়ারুল কবির বাবুল জানান, আমরা সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন মামলা বিচারাধীন থাকায় আদালত সাক্ষ্যগ্রহণ করতে পারছেন না। গত ১০ মাসেও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা রিভিশন মামলার শুনানি করছে না। তারা কালক্ষেপণ করছেন। ঢাকার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আগামি ১৭মে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের রিভিশন মামলার আদেশ দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন। আর রিভিশন মামলার নিষ্পত্তি হলেই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে বলে জানান তিনি।

ইমারত নির্মাণে দুর্নীতির মামলা : রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পরপরই ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অনুসন্ধানে নামে দুদক। রানা প্লাজা ভবনে ৬ তলা নির্মাণে অনুমোদন থাকার পরও ৯ তলা ভবন নির্মাণ করে দুর্নীতি করায় ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা ও দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় সাভার থানায় ২০১৩ সালের ১৫ জুন মামলাটি করে দুদক।

মামলায় রানা ছাড়া অপর ১৭ জনকে আসামি করা হয়। কিন্তু তদন্তে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে রানার প্রভাব খাটানোর বিষয়ে বেড়েয়ে আসায় তাকেসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক মফিদুল ইসলাম।

অভিযোগপত্র দাখিল হওয়ার পর মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে আসলে চার্জ শুনানির পর্যায়ে কিছু ত্রুটি ধরা পরে। ফলে ২০১৬ সালের ৬ মার্চ মামলাটি পুনঃতদন্তের আদেশ দেন ওই আদালত। সম্প্রতি পুনঃতদন্তের প্রতিবেদন আদালতে দাখিল হওয়ার পর গত ১৯ এপ্রিল আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

অভিযোগ গঠনের শুনানি শেষে ঢাকার বিভাগীয় স্পেশাল জজ এম আতোয়ার রহমান আগামি ৮মে আদেশের জন্য দিন ঠিক করেছেন।

তিন মামলার আসামিদের অবস্থান : মামলা তিনটিতে এখনো সাত আসামি পলাতক রয়েছেন। এরা হলেন- সাভার পৌরসভার প্রাক্তন সহকারি প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, সাভার পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, নান্টু কন্ট্রাকটার, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, রেজাউল ইসলাম, নয়ন মিয়া ও সফিকুল ইসলাম।

কারাগারে রয়েছেন চার আসামি। এরা হলেন- ভবন মালিক সোহেল রানা, প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. সারোয়ার কামাল ও ইমারত পরিদর্শক মো. আওলাদ হোসেন। আবু বকর সিদ্দিক নামে এক জন মারা গেছেন।

তিন মামলা মিলে মোট আসামি ছিল ৪২ জন। সে হিসেবে ২৯ জন আসামি জামিনে আছেন। এরা হলেন- ভবন মালিক সোহেল রানার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কুলু খালেক, সোহেল রানার মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌর মেয়র আলহাজ রেফাত উল্লাহ, কাউন্সিলর মোহাম্মাদ আলী খান, উপসহকারি প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, নিউওয়েব বাটন লিমিটেডের চেয়ারম্যান বজলুস সামাদ আদনান, নিউওয়েব স্টাইপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুর রহমান তাপস, ইতার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামান, আমিনুল ইসলাম, মো. মধু, অনিল দাস, মো. শাহ আলম ওরফে মিঠু, মো. আবুল হাসান, সাভার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কমকর্তা উত্তম কুমার রায়, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের সাবেক উপপ্রধান পরিদর্শক মো. আব্দুস সামাদ, উপপ্রধান পরিদর্শক বেলায়েত হোসেন, পরিদর্শক প্রকৌশল মো. ইউসুফ আলী, পরিদর্শক প্রকৌশল মো. মহিদুল ইসলাম, ইথার টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস, মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, মো. আতাউর রহমান, মো. আব্দুস সালাম, বিদ্যুৎ মিয়া, সৈয়দ শফিকুল ইসলাম জনি, মো. আব্দুল হামিদ, আব্দুল মজিদ, মো. আমিনুল ইসলাম, মো. ইউসুফ আলী ও মাহবুল আলম।

আসামি রানার আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, রানা প্লাজার হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় চার্জ গঠন হয়েছে। কিন্তু আমরা চার্জ গঠনের সময় বার বার বলেছিলাম মামলা দুটিতে চার্জ গঠনের কোনো উপাদান নেই। কিন্তু তারপরও আদালত চার্জ গঠন করেছেন। এর বিরুদ্ধে আমাদের কিছু আসামি হাইকোর্টে গেছে। হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। উনাদের বিচার তো চলবে না। আর কয়েক আসামি রিভিশন মামলা দায়ের করেছেন। এটা নিষ্পত্তি না হলে সাক্ষ্যগ্রহণ করা যাবে না। আমরা চাই মামলাটির বিচার যেন দ্রুত শেষ হয়ে যায়।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা নামক ভবন ধসে ১ হাজার ১১৭ জনকে মৃত উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো ১৯ জন মারা যায়। এ ছাড়া ২ হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত হয়। মৃত উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ৮৪৪ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা রেখে ২৯১ জনের অসনাক্তকৃত লাশ জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। জীবিত উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ১ হাজার ৫২৪ জন আহত হন। তদের মধ্যে গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেন ৭৮ জন।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ এপ্রিল ২০১৭/মামুন খান/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়