ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

রুদ্ধ হচ্ছে রাজধানীতে শিশুর বিকাশের অধিকার

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৬, ২৯ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রুদ্ধ হচ্ছে রাজধানীতে শিশুর বিকাশের অধিকার

হাসান মাহামুদ : বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের শিশুদের অধিকারও চারটি গুচ্ছে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে তিনটি অধিকারই রাষ্ট্রের পাশাপাশি পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে সর্ম্পকিত। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, পারিবারিক দূরত্ব, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা প্রভৃতি কারণে রাজধানীতে বিশেষত বিকাশের অধিকারের ক্ষেত্রে শিশুদের রুদ্ধ হতে হচ্ছে।

এ সংক্রান্ত একটি গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য মতে, রাজধানীর অধিকাংশ শিশু সামাজিক ও পরিবেশগত কারণে বিকাশের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রাজধানীর ১৫টি সড়ক সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জড়িত বিভিন্ন কর্মকর্তা, চিকিৎসক এবং নগরবিদকে অন্তর্ভুক্ত করে রাইজিংবিডি ডটকমের পক্ষ থেকে পরিচালিত গবেষণায় এ চিত্র পাওয়া গেছে। গবেষণার জরিপের প্রশ্নমালায় শিশু অধিকার সনদে বর্ণিত অধিকারগুলোকে সরাসরি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তবে জরিপের উত্তরদাতাদের (রেসপন্ডেন্ট) মতামত ও সুপারিশে এ চিত্র বেরিয়ে আসে।

রাজধানীতে চলমান বাস্তবতায় মোটা দাগে তিনটি কারণকে চিহ্নিত করেছেন শিশুর বিকাশের অধিকার রুদ্ধের কারণ হিসেবে। কারণগুলো হচ্ছে- সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, পারিবারিক দূরত্ব এবং সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। এর মধ্যে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রভাবকটির ক্ষেত্রে জরিপভুক্ত ৭০ শতাংশ পিতা দায়ী করেছেন ভারতীয় তিনটি টেলিভিশন চ্যানেল, পাশ্চাত্য ফ্যাশন ট্রেন্ড এবং আকাশ সংস্কৃতির প্রতি মায়েদের আসক্তিকে। মায়েদের এই আসক্তির কারণে সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সন্তানদের পড়াশুনা এবং খোদ সন্তানদের প্রতি অবহেলা হয় বলেও অভিযোগ করেছেন উত্তরদাতা অধিকাংশ পিতা।

পারিবারিক দূরত্বকে দায়ী করেছন ৩৫ শতাংশ অভিভাবক (পিতা ২৫ এবং মা ৪৫ শতাংশ)। এছাড়া সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে দায়ী মনে করেন ৬৫ শতাংশ অভিভাবক। সামাজিক প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক নিয়মনীতি এবং বিভিন্ন অনুশাসন বাস্তবায়নের লঘুহারকে দায়ী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

শিশু অধিকার সনদে বর্ণিত অধিকারগুলোকে পর্যালোচনা করে সাধারণভাবে চারটি গুচ্ছে ভাগ করা যায়। প্রথমত, বেঁচে থাকার অধিকার। দ্বিতীয়ত, বিকাশের অধিকার। তৃতীয়ত, সুরক্ষার অধিকার। চতুর্থত, অংশগ্রহণের অধিকার। শিশুরা তাদের এসব অধিকার ভোগ করবে এটাই স্বাভাবিক ও রীতিসিদ্ধ। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে এবং উন্নয়নশীল ও দরিদ্র অনেক দেশেই শিশুরা এ অধিকারগুলো নিয়ে বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে না।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী শূণ্য থেকে ১৮ বছরের কম বয়সের প্রতিটি মানবসন্তানই শিশু। বাংলাদেশে জাতীয় শিশুনীতি অনুযায়ী শূণ্য থেকে ১৪ বছরের সব মানবসন্তানই শিশু। তবে এই জরিপে শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়েছে ছয় মাস থেকে ছয় বছর বয়সীদের।

জরিপের উত্তরদাতাদের মতামত অনুযায়ী, শিশু শুধু বয়সের মধ্যে বন্দি এক শরীরসর্বস্ব মানুষ নয়। তার মধ্যে রয়েছে সুপ্ত সম্ভাবনা, যা সমাজ ও দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। শিশুর সম্ভাবনার এ ভিত্তি জীবনের শুরুতেই রচিত হয়। সে কারণেই শৈশবকালটি শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জন্মগতভাবে সব শিশুই সমান সম্ভাবনাময়। কিন্তু সব শিশুর আর্থ-সামাজিকও পারিবারিক অবস্থা এক না হওয়ায় সবাই সমানভাবে বিকাশের সুযোগ পাচ্ছে না। অধিকাংশ সুবিধাবঞ্চিত শিশু ঝরে পড়ছে শিশুকালেই।

শিশুদের অধিকার নিশ্চিতে বিভিন্ন প্রচলিত বিভিন্ন আইন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জন্মগতভাবে শিশুদের বেড়ে ওঠা, বেঁচে থাকা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি ও সুরক্ষার অধিকার রয়েছে। ১৯৫৯ সালে ১০টি অধিকারের মূলধারা নিয়ে জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৯ সালকে শিশুবর্ষ হিসেবে পালন করা হয়। ১৯৮৯ সালে ১০টির পরিবর্তে ৫৪টি ধারা নিয়ে নতুন করে শিশু অধিকার সনদ ঘোষণা করা হয়। শিশুদের অধিকার আরো জোরালো করার লক্ষ্যে ১৯৯০ সালে বিশ্ব শিশু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সাউথ এশিয়ান আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) ২০০০-২০১০ সালকে শিশু অধিকার দশক হিসেবে ঘোষণা করে শিশুদের অধিকার সুরক্ষা এবং প্রতিষ্ঠা করার কাজে ভূমিকা জোরদার করার তাগিদ দেয়। সেই থেকে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র শিশু অধিকার সুনিশ্চিত করার কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু এখনো অধিকাংশ দেশ ‘শিশু অধিকার নিশ্চিত হয়েছে’ বলে ঘোষণা দিতে পারেনি।

শিশুদের বিকাশের অধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে জরিপভুক্ত অভিভাবক এবং বিশেষজ্ঞরা মোটা দাগে কিছু সুপারিশ দিয়েছেন। তাদের মতে, প্রতিটি শিশুকে শিক্ষা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল ও সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উপযুক্ত জীবনযাত্রার মান নিয়ে গড়ে ওঠার জন্য সুযোগ দিতে হবে। এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলোর মধ্যে রয়েছে শৈশবকাল (৩-৫) এবং বয়ঃসন্ধিকাল (১২-১৯) বছর। এ সময়ই শিশুদের পারিবারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সুষ্ঠু এবং সুন্দর পরিবেশে রেখে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। কারণ এ সময়টাই হচ্ছে শিশু বিকাশের উপযুক্ত সময়। এ সময়ে  যেন অসামাজিক, অনৈতিক, অপসাংস্কৃতিক পরিবেশের সংস্পর্শ না পায় তার দিকে নজর দিতে হবে। গড়ে তুলতে হবে শিশু বিকাশের সুরক্ষিত পরিবেশ।

তারা আরো বলছেন, শিশু অধিকার ও শিশু বিকাশের পরিবেশের পাশাপাশি শিশুদের সুরক্ষার অধিকারকেও নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে শিশুদের ক্ষতি করা হয়। যেমন- মারধর করা, শিশুশ্রমে নিযুক্ত করা, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ঠেলে দেওয়া, বিনা বেতনে কাজ করতে বাধ্য করা; ছেলে-মেয়ে, অবস্থা, জাতিভেদ ও উঁচু-নিচুর কারণে বৈষম্যের শিকার; অপহরণ ও বিক্রি করে দেওয়া; এসব পরিস্থিতি থেকে শিশুদের মুক্তি দিতে হবে। অন্যদের মতো শিশুর স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার রয়েছে। সে ক্ষেত্রেও শিশুদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। বেড়ে উঠতে দিতে হবে স্বাধীন ও সুরক্ষিত পরিবেশ।

জরিপের ফলাফল নিয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে মতামত গ্রহণ করা হয় মানবাধীকার কর্মী সুলতানা কামালের কাছ থেকে। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, সরকারি তথ্যমতে, দেশের প্রায় ১০ লাখ শিশু যাবতীয় মৌলিক ও সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। আর কেবল কিছু সুবিধা পাচ্ছে ৩৬ লাখ শিশু। সব শিশুকে সমান সুযোগ দিতে সরকারে উদ্যোগের কমতি নেই তারপরও ঘাটতি অনেক।

এসবের সমাধান হিসেবে এই মানবাধীকার কর্মী পরিবারের সদস্যদের আরো বেশি সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে সরকার আর জনপ্রতিনিধিদেরও আরো বেশি দায়িত্বশীল হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন।

প্রসঙ্গত, প্রতিবেদনটি তৈরিতে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে জরিপ পরিচালনা করা হয় রাজধানীর পনের সড়কের পাশে ৫০টি বাসভবনে। মোট ১০০ জনের মতামত গ্রহণ করা হয়। এরপর সাধারণ জনগণের মতামত ও বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট প্রশ্নমালার আলোকে বিশেষজ্ঞ মতামত নেওয়া হয় রাজধানীতে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের ১০ কর্মকর্তা, দুজন চিকিৎসক এবং একজন নগরবিদের। এপ্রিল থেকে মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত রাইজিংবিডির পক্ষ থেকে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। তবে জরিপে আগের সময়ের সঙ্গে তুলনা করার ক্ষেত্রে পূর্বের ছয় মাস (২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত) গণনা করা রয়েছে। মোট দশটি প্রশ্নের ভিত্তিতে পরিচালিত জরিপের আলোকে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।


**



 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ মে ২০১৭/হাসান/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়