ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

পরিবেশ দূষণরোধে প্রণীত বিভিন্ন আইন বাস্তবায়নে দুরবস্থা

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২৪, ৭ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পরিবেশ দূষণরোধে প্রণীত বিভিন্ন আইন বাস্তবায়নে দুরবস্থা

হাসান মাহামুদ : পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট ও দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। পরিবেশের বিভিন্ন রকমের দূষণ রোধে বেশকিছু আইন, বিধি ও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সরকারের। কিন্তু তদারকির অভাবে এসবের বাস্তবায়নে দূরাবস্থা বিরাজ করছে। এমনকি জুডিশিয়াল অ্যাক্টিভিজমের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও পরিবেশ দূষণের মাত্রা বেড়েই চলছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ক্ষমতাবলে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। নীরব এলাকায় দিনে ৫০ ডেসিবল ও রাতে ৪০ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ রাতে ৪৫, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০, রাতে ৫০ এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ রাতে ৭০ ডেসিবল।

বিধিমালার আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য একমাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু শব্দ দূষণের বাস্তব পরিস্থিতি আমরা নিজেরাই দেখছি।

২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে পরিবেশ অধিদপ্তর বিভিন্ন সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে অপ্রয়োজনে হর্ন না বাজাতে গাড়িচালকদের অনুরোধ জানায়। এতে বলা হয়, ‘উচ্চমাত্রার শব্দ শ্রবণশক্তি কমায় ও শরীরের রক্তচাপ বাড়ায়, হৃদযন্ত্রের কম্পন বাড়িয়ে দেয়, হজম প্রক্রিয়া ব্যাহত করে, মাংসপেশির খিঁচুনি সৃষ্টি করে এবং সর্বোপরি শিশুদের বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত করে। এমনকি মৃত্যুও ঘটাতে পারে’। কিন্তু এই অনুরোধও রাখেনি কোনো গাড়িচালক।

এদিকে, জুডিশিয়াল অ্যাক্টিভিজমের মাধ্যমে জনস্বার্থে করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বা পত্রপত্রিকার খবর আমলে নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন আদেশ নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে হাইকোর্ট। তবে সঠিক তদারকির অভাবে পরিবেশ রক্ষায় উচ্চ আদালতের দেওয়া এসব রায় বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। এমনকি বিভিন্ন সময়ে মানুষ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতেও পড়ছে। রায় বাস্তবায়নের বিষয়টি তদারকি করতে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষকে একটি মনিটরিং সেল গঠনের জন্য ২০০১ সালে একটি নির্দেশনা দেয় হাইকোর্ট। নির্দেশনা দেওয়ার ১৬ বছর পার হলেও, তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি।

আইন থাকার পরও রাজধানীর প্রায় প্রতিটি ফুটপাত দখল হয়ে আছে। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৭ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে- ফুটপাত দিয়ে মোটরসাইকেল চালালে ৩ মাস কারাদণ্ড এবং ৩৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রেখে। কিন্তু রাজধানীর  ফুটপাত দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। শুধুমাত্র ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ‍কিছু ফুটপাত এবং বিভিন্ন দূতাবাসের সামনের অবৈধ দখল হওয়া কিছু স্থান ও ফুটপাত দখলমুক্ত করা গেছে। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) অনেক চেষ্টা করেও ফুটপাত দখলমুক্ত করা যায়নি। গুলিস্তান হকারমুক্ত করার লক্ষ্যে মেয়র কয়েক দফা চেষ্টা করেছেন। আশপাশের এলাকায় কয়েক দফা অভিযান চালোনো হয়। কিন্তু এখনো আগের চিত্রই রয়ে গেছে।

২০০১ সালে এ বিষয়ে ‘জনস্বার্থে’ বেশকিছু নির্দেশ দেয় উচ্চ আদালত। ওই রায়ে জনস্বার্থের সব রায় ও আদেশ বাস্তবায়নে তদারকি সেল গঠন করতে ২০০১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি আবু সায়েম আহাম্মেদ ও বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরীর বেঞ্চ সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিয়েছিল। ওই রায়ের ১৬ বছরেও সুপ্রিম কোর্টে কোনো মনিটরিং সেল গঠন করা হয়নি। মূল আর্জিতে দেওয়া অন্য আদেশগুলোও রয়ে গেছে উপেক্ষিত।

২০০৯ সালের ২৫ জুন হাইকোর্ট ঢাকার চারটি নদী রক্ষায় ১২ দফা নির্দেশনা দিয়ে ঐতিহাসিক রায় দেয়। রায়ে নদী তীরবর্তী স্থায়ী ও অস্থায়ী সব স্থাপনা উচ্ছেদ এবং নদীর সঠিক গতিপথ নির্ণয় করতে সিএস রেকর্ড অনুসারে নদীর সীমানা নির্ধারণে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। ২০১০ সালের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে এ রায় বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছিল। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন ওই রায় বাস্তবায়নের দাবিতে সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করছে। অথচ সেই রায় আজও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। রায় বাস্তবায়িত না হওয়ায় নদীর পারের মানুষগুলো দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে।

২০০৯ সালের ২৩ জুন হাইকোর্ট হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে সরিয়ে নিতে ট্যানারি মালিক ও সরকারপক্ষকে সময় বেঁধে দেয়। রায়ে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে রাজধানীর হাজারীবাগের সব চামড়া শিল্প প্রতিষ্ঠান সাভার এলাকার নির্ধারিত জায়গায় স্থানান্তর করতে বলা হয়। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রায় বাস্তবায়িত না হলে ট্যানারি শিল্প কারখানাগুলো বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হবে। এরপর আরো কয়েক দফা নির্দেশ, রায় এবং আপিলের রায় হয়। কয়েক দফা সময় বেঁধে দেওয়া হয়, দৈনিক ভিত্তিতে জরিমানা করা হয়। তবুও সব ট্যানারি এখনো সাভারে যায়নি।

হাইকোর্টের আদেশ ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের তোয়াক্কা না করে চট্টগ্রামসহ দেশের পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে অবাধে পাহাড় কাঁটা হচ্ছে। আর এর ফলে প্রতি বছরই পাহাড় ধসে প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। একই সঙ্গে পরিবেশও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পাহাড় কাটা বন্ধে হাইকোর্ট বহুবার বিভিন্ন আদেশ ও নির্দেশনা দিয়েছে। এ নির্দেশনা ও আদেশ উপেক্ষা করেই পাহাড় খেকোরা নির্বিচারে পাহাড় কেটে বসত ঘর ও দোকানপাট নির্মাণ করছে।

২০১২ সালের ১৮ জানুয়ারি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ এবং একটি মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। একইসঙ্গে ওই এলাকায় ব্যক্তিগত স্থাপনা নির্মাণ, ভরাট নিষিদ্ধ এবং ব্যক্তিগত স্থাপনা উচ্ছেদেরও নির্দেশ দেওয়া হয়। এসব নির্দেশনা আজও বাস্তবান করা হয়নি।

২০১২ সালের ৫ মার্চ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় কপোতাক্ষ নদে সকল মাটি ভরাট, দখল ও বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। জনস্বার্থে দায়ের করা এক রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে এই আদেশ দেয় আদালত। এসব নির্দেশনার পর কপোতাক্ষ নদ ভরাট কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ করা হলেও থেমে নেই কপোতাক্ষ নদ দখল। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সেই কপোতাক্ষ নদ এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে নদের অধিকাংশ জায়গায় পানি থাকে না।

এদিকে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের অধিকাংশ এলাকার রাস্তা ও অলিগলিতে আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে। খোলা ট্রাক ও কনটেইনারে আবর্জনা পরিবহনের ফলে পথে পথে ছড়িয়ে পড়ছে আবর্জনা, ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধসহ নানা রোগ ব্যধির জীবাণু। ডিএসসিসি কর্মকর্তারা বলছেন, জাইকার সহায়তায় আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মহাপরিকল্পনা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলে রাজধানীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বেশ উন্নতি হবে। তবে এ মহাপরিকল্পনা রাজধানীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কতটুকু সুফল বয়ে আনবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিজ দায়িত্ব পালনে যত্নবান না হলে রাজধানীর আবর্জনা পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক রাইজিংবিডিকে বলেন, পরিবেশ দূষণ এই মুহুর্তে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে সরকারের প্রণীত বিভিন্ন আইন এবং উচ্চ আদালতের বিভিন্ন রায় বা নির্দেশনার বাস্তবায়ন না হওয়া খুবই হতাশার।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান রাইজিংবিডিকে বলেন, জাতীয় স্বার্থে আমাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধ রয়েছে। তাদের জন্য একটি সুন্দর জীবন ও পরিবেশ নিশ্চিত করা আমাদের জাতীয় দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

তিনি সবাইকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানান।

আরো পড়ুন

*

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ জুন ২০১৭/হাসান/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়