ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

হাওর বাঁধে অনিয়ম

দুদকের মুখোমুখি ২৩৯ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ২৮ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুদকের মুখোমুখি ২৩৯ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি

এম এ রহমান : হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারসহ ৬১ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার পর এবার ২৩৯টি স্থানীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) দুর্নীতির অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

পিআইসি সাধারণত পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় বাঁধ নির্মাণের পর বিভিন্ন সময় সংস্কার কাজগুলো করে থাকে। স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন থোক বরাদ্দের মাধ্যমে বাঁধ সংস্কার কাজ করে ওই কমিটি। দুদক মূলত ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ সংস্কার কাজে অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধেই আইনি পদক্ষেপ নেবে।

দুদক সূত্র জানায়, হাওর অঞ্চলের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের প্রথম ধাপ ছিল বাঁধের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা। সেই সকল অপরাধীদের সনাক্ত করে দায়িত্বে অবহেলা ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। দুদকের অনুসন্ধানের সময় এর বাইরে স্থানীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) অবহেলারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই এবার পিআইসি’র সদস্যদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করা হয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, পিআইসি মূলত পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় বাঁধ নির্মাণের পর বিভিন্ন সময় সংস্কার কাজগুলো করে থাকে। স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন থোক বরাদ্দের মাধ্যমে বাঁধের সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয়। প্রতি অর্থবছরে ওই কমিটির সদস্য সংযোজন ও বিয়োজন হয়ে থাকে। সাধারনত ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যা, স্থানীয় সংসদ সদস্য কর্তৃক মনোনিত দুইজন, উপজেলা পরিষদ থেকে একজন কিংবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কর্তৃক মনোনিত একজনসহ মোট পাঁচ থেকে সাত সদস্যের সমন্বয়ে ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠিত হয়। আর ওই কমিটি পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক বরাদ্দকৃত থোক বরাদ্দ থেকে বছরের বিভিন্ন সময় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংস্কারের কাজ করে থাকে। সুতরাং হাওর বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার দায় ওই কমিটির উপর বর্তায়।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, দুদকের অনুসন্ধান পর্যায়ে সুনামগঞ্জ জেলার আওতায় ২৩৯ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির অবহেলা ও অনিয়ম খুঁজে পাওয়া গেছে। তাই আমরা যখন হাওর ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেই তখন ওই পিআইসি কমিটির বিষয়ে অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা কমিশনে তুলে ধরি। কমিশন আমাদের উপস্থাপিত তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে দুদকের দলকে অনুসন্ধানের অনুমতি দেয়। মামলা দায়ের করার পরপরই পিআইসি’র বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছি। এ পর্যায়ে ওই কমিটির সদস্য পদের তালিকা ও তাদের কাজের বিবরণসহ নথিপত্র পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে তলব করা হয়েছে।

দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল এ বিষয়ে রাইজিংবিডিকে বলেন, হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধে অনিয়মের ব্যাপারে ইতিমধ্যে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলা দায়ের করার পর তদন্ত কাজ এগিয়ে চলছে। এ সংক্রান্ত যে কোনো অনুসন্ধান কিংবা তদন্তে যাদেরই সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে দুদক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।

এর আগে গত ২ জুলাই হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে সুনামগঞ্জ জেলা পাউবোর ১৫ কর্মকর্তা এবং ৪৬ ঠিকাদার ও প্রতিষ্ঠানসহ ৬১ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে দুদক। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানায় এ মামলা দায়ের করেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, সুনামগঞ্জের হাওরে প্রতিবছরের মতো এবারও বন্যা আসার সার্বিক তথ্য জানার পরও তা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে অপরাধজনিত বিশ্বাস ভঙ্গ করেছেন আসামিরা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৮৪টি প্যাকেজের অসমাপ্ত কাজের জন্য নতুনভাবে টেন্ডার আহ্বান না করে ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও আগের ঠিকাদারদের কাজের অনুমতি দেওয়া হয়। মোট ১৬০টি প্যাকেজের মধ্যে ৯টির কাজ শুরুই হয়নি। বাকি ১৫১টি প্রকল্পের কাজ আংশিক শেষ হয়েছে। এর মাধ্যমে অসৎ উদ্দেশ্যে বাঁধ নির্মাণে বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টি করে হাওরের কৃষক ও স্থানীয় জনসাধারণের আর্থিক ক্ষতিসাধন করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন আসামিরা।

পাউবোর ১৪ আসামি হলেন সুনামগঞ্জ জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী (বরখাস্ত) মো. আফছার উদ্দীন, সিলেট বিভাগের প্রাক্তন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নূরুল ইসলাম সরকার, প্রাক্তন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাই, সুনামগঞ্জের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস, খলিলুর রহমান, সেকশন কর্মকর্তা মো. শহিদুল্যা, ইব্রাহিম খলিল উল্লাহ খান, খন্দকার আলী রেজা, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. শাহ আলম, মো. বরকত উল্লাহ ভূঁইয়া, মো. মাহমুদুল করিম, মো. মোছাদ্দেক, সজীব পাল ও মো. জাহাঙ্গীর হোসেন।

এছাড়া ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, সিলেট, কুমিল্লার ৪৬ জন ঠিকাদার ও প্রতিষ্ঠান মালিকদের আসামি করা হয়েছে।

মামলার পরপরই রাজধানীর মতিঝিল এলাকা থেকে প্রধান আসামি সুনামগঞ্জ জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী (বরখাস্ত) মো. আফছার উদ্দীন ও ঠিকাদার বাচ্চু মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এছাড়া অনুসন্ধানে বাঁধ নির্মাণে দায়িত্ব পালনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অবহেলার তথ্য পাওয়ায় পানিসম্পদ সচিবসহ ঊর্ধ্বতন ১৩ কর্মকর্তার নাম আসামির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে চিঠি পাঠায় দুদক। কর্মকর্তারা হলেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান, অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) ড. মোহাম্মদ আলী খান, যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন-১, হাওর) নুজহাত ইয়াসমিন, যুগ্ম প্রধান (পরিকল্পনা অনু বিভাগ) মন্টু কুমার বিশ্বাস, পাউবোর মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর কবির, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পূর্ব রিজিওন) একেএম মমতাজ উদ্দিন। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং ও এনফোর্সমেন্ট কমিটির সাতজন হলেন যুগ্ম সচিব কাজী ওবায়দুর রহমান, শামিম আরা খাতুন, মো. খলিলুর রহমান, উপসচিব নন্দিতা সরকার, মুহম্মদ হিরুজ্জামান, সহকারী প্রধান আবু ইউসুফ মোহাম্মদ রাসেল ও মো. সিদ্দিকুর রহমান।

চলতি বছরের ২০ এপ্রিল দুদক পরিচালক বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে টিম কাজ শুরু করে। এই টিমের সদস্যরা হলেন উপপরিচালক আবদুর রহিম, সহকারী পরিচালক সেলিনা আক্তার মনি, সহকারী পরিচালক মো. ফারুক আহমেদ এবং উপ-সহকারী পরিচালক নেয়ামুল কাজী।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুলাই ২০১৭/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়