ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ছাত্রলীগের সর্বোচ্চ দুই পদে নারী নেতৃত্বের খরা ঘুচবে কবে ?

নৃপেন রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪৫, ৬ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছাত্রলীগের সর্বোচ্চ দুই পদে নারী নেতৃত্বের খরা ঘুচবে কবে ?

নৃপেন রায় : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ৬৯ বছরে পদাপর্ণ করেছে এই সংগঠন। গৌরবময় পথচলায় ২৮তম সম্মেলন অতিবাহিত করে আরেকটি সম্মেলনের জন্য এগুচ্ছে। 

এই সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেন্দ্রীয় কমিটির দুই বছরের মেয়াদ গত ২৬ জুলাই পূর্ণ হয়েছে। সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক- এই দুই পদে কোন ছাত্রী এখন পর্যন্ত অধিষ্ঠিত হননি। আগামী সম্মেলনে সংগঠনের এই দুই উচ্চ পদে কোন নারী নেত্রী কি আসবেন ? 

বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস, ছাত্রলীগের ইতিহাস স্বাধীনতার ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের যথার্থতাও মেলে সংগঠনের গৌরবোজ্জল ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সম্মুখস্থানে ছিল ছাত্রলীগ। এসব আন্দোলন-সংগ্রামে সংগঠনের অসংখ্য নেতাকর্মী শহীদ হয়েছেন। আবার অনেকে এখন নেতৃত্ব দিয়ে সম্পৃক্ত হয়েছেন আওয়ামী রাজনীতির নীতি-নির্ধারনী পর্যায়ে। অনেকে দলছুট হয়ে চলে গেছেন অন্য সংগঠনে। 

নিত্য সংগ্রামের ভেতর দিয়েই পথ পাড়ি দিতে দিতে ছাত্রলীগ সম্মেলন করেছে। কিন্তু কোন সম্মেলনেই সংগঠনের সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক পদে কোন নারী নির্বাচিত হননি। ফলে এই সংগঠন তার প্রধান দুটি পদে কোন ছাত্রীকে নেতা হিসেবে পায়নি। 

জন্মলগ্ন থেকে এ পর্যন্ত সংগঠনের সম্মেলন ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৪৮ সালে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। আহ্বায়ক ছিলেন নাঈম উদ্দিন আহমদ। এরপর ১৯৪৮-১৯৫০ মেয়াদে সভাপতি দবিরুল ইসলাম এবং সাধারন সম্পাদক খালেক নেওয়াজ খান নির্বাচিত হন। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৫০-১৯৫২ মেয়াদে সভাপতি খালেক নেওয়াজ খান ও সাধারন সম্পাদক কামরুজ্জামান। ১৯৫২-১৯৫৩ মেয়াদে সভাপতি কামরুজ্জামান ও সাধারন সম্পাদক এম.এ.ওয়াদুদ। ১৯৫৩-১৯৫৭ মেয়াদে সভাপতি আব্দুল মোমিন তালুকদার ও সাধারন সম্পাদক এম.এ.আউয়াল। ১৯৫৭-১৯৬০ মেয়াদে সভাপতি রফিকুল্লাহ চৌধুরী ও সাধারন সম্পাদক আমহার আলী। এই কমিটিতে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হক শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। ১৯৬০-১৯৬৩ মেয়াদে সভাপতি শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও সাধারন সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি। ১৯৬৩-১৯৬৫ মেয়াদে সভাপতি কে.এম.ওবায়দুর রহমান ও সাধারন সম্পাদক সিরাজুল আলম খান। ১৯৬৫-১৯৬৭ মেয়াদে সভাপতি সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী ও সাধারন সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক।

১৯৬৭-১৯৬৮ মেয়াদে সভাপতি ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী ও সাধারন সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক। ১৯৬৮-১৯৬৯ মেয়াদে সভাপতি আব্দুর রউফ ও সাধারন সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী। ১৯৬৯-১৯৭০ মেয়াদে সভাপতি তোফায়েল আহমদ ও সাধারন সম্পাদক আ.স.ম আব্দুর রব। ১৯৭০-১৯৭২ মেয়াদে সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারন সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ ও ইসমত কাদির গামা। ১৯৭২-১৯৭৩ মেয়াদে সভাপতি শেখ শহিদুল ইসলাম ও সাধারন সম্পাদক এম.এ.রশিদ। ১৯৭৩-১৯৭৪ মেয়াদে সভাপতি মনিরুল হক চৌধুরী ও সাধারন সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান ও মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন (ভারপ্রাপ্ত)। ১৯৭৬-১৯৭৭ মেয়াদে এম.এ.আউয়াল (আহ্বায়ক), ১৯৭৭-১৯৮১ সভাপতি ওবায়দুল কাদের ও সাধারন সম্পাদক বাহালুল মজনুন চুন্নু। ১৯৮১-১৯৮৩ মেয়াদে সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও সাধারন সম্পাদক আ.খ.ম.জাহাঙ্গীর। ১৯৮৩-১৯৮৫ মেয়াদে সভাপতি আব্দুল মান্নান ও সাধারন সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক। ১৯৮৬-১৯৮৮ মেয়াদে সভাপতি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ ও সাধারন সম্পাদক আব্দুর রহমান। ১৯৮৮-১৯৯২ মেয়াদে সভাপতি হাবিবুর রহমান (বহিস্কৃত) ও শাহে আলম (কার্যকরী), পরে সাধারন সম্পাদক হন অসীম কুমার উকিল। ১৯৯২-১৯৯৪ মেয়াদে সভাপতি মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরী এবং সাধারন সম্পাদক ইকবালুর রহিম। ১৯৯৪-১৯৮৮ মেয়াদে সভাপতি একেএম এনামুল হক শামীম ও সাধারন সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্না। ১৯৮৮-২০০২ মেয়াদে সভাপতি বাহাদুর বেপারী ও সাধারন সম্পাদক অজয় কর খোকন। ২০০২-২০০৬ মেয়াদে সভাপতি লিয়াকত সিকদার ও সাধারন সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবু। ২০০৬--২০১১ মেয়াদে সভাপতি মাহমুদুল হাসান রিপন ও সাধারন সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন। ২০১১-২০১৫ মেয়াদে সভাপতি এইচ.এম.বদিউজ্জামান ও সোহাগ সাধারন সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম। এরপর সর্বশেষ সম্মেলনে ২০১৫ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস, এম জাকির হোসাইন নির্বাচিত হন। সোহাগ-জাকিরের কমিটি গঠনতন্ত্র অনুযায়ী গত ২৬জুলাই দুই বছর মেয়াদ পূর্ণ করেছে।

তবে লিয়াকত সিকদার ও নজরুল ইসলাম কারা অন্তরীণ থাকার ফলে তাদের অবর্তমানে ছাত্রলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মারুফা আক্তার পপি ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে কিছুদিন সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি পরবর্তী কাউন্সিলে সভাপতি পদে প্রার্থী ছিলেন। কিন্তু ওই কাউন্সিলে ছাত্রলীগের জন্য বয়সসীমার খড়গ ২৯ বছর করা হয়। সেই কাউন্সিলে সভাপতি ও সাধারণ নির্বাচিত হন মাহমুদুল হাসান রিপন ও মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন। মারুফা আক্তার পপি বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য বলে প্রাক্তন ছাত্রনেতারা জানান।

সংগঠন সূত্র জানায়, ‘ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে ছাত্রী নেতাদের আসার আভাস না থাকলেও তাদের সরব উপস্থিতির ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। 

শেখ কামালের ৬৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শুক্রবার ঢাকায় বাংলা একাডেমীর আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে ছাত্রলীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি বলেন, ‘আজকে অনেক উপস্থিতি। অনেক তরুণ। এখানে যারা আছে, বাইরে তার চেয়েও বেশী। আমার খুব ভাল লাগছে।

ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে এত মেয়ে কখনো আসে না। এটা খুব ভাল লক্ষণ। আমরা আশাবাদী, বাংলাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী হচ্ছে নারী। নারীদের এই অংশগ্রহণ খুব আশার ব্যাপার। এর আগে গত ২২ জুলাই ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সম্পাদকম-লীর সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে শিগগিরই ছাত্রলীগের সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হবে বলে তিনি জানান। 

ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দেশে এই মুহূর্তে বন্যা পরিস্থিতি বিরাজমান। তবে এইটুকু বলতে পারি, শিগগিরই সম্মেলন হবে। আশা করি খুব শিগগিরই জানতে পারবেন, ছাত্রলীগের সম্মেলন কবে এবং সেটা বেশি দেরি হবে না।’ 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের প্রাক্তন কয়েকজন নেতা জানান, ‘ছাত্রলীগ সরকারি দলে থাকলে একরকম আর বিরোধী দলে গেলে আরেক রকম প্রেক্ষাপটে পরিচালিত হয়। হয়ত এ কারণে নীতি-নির্ধারকরা ছাত্রলীগের ‘সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক’ পদে নারী নেতৃত্বকে সংগঠন সামলানোর জন্য ফিট মনে করেন না। আবার অনেকে ক্ষেত্রে দক্ষ ও গ্রহণযোগ্য সাংগঠনিক দক্ষতাসম্পন্ন ছাত্রী নেত্রীরও সংকট থাকে। এক্ষেত্রে ছাত্রলীগের অলিখিত অভিভাবক আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সুদৃষ্টি দিলে হয়তবা এই খরা আগামীতে কোন সম্মেলনে ঘুচতে পারে।’ 

এই বিষয়ে ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নুসরাত জাহান নুপুরের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি একটি মিটিং’য়ে আছেন জানিয়ে পরে কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

মহিলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রোজিনা নাসরিন রোজী ে ব্যাপারে রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘ছাত্রলীগে যোগ্যতাসম্পন্ন মেয়ে কমবেশী সবসময় থাকে। অনেক সময় মূল্যায়ন করা হয় না। হয়ত নীতি-নির্ধারকরা ভাবেন, মেয়েরা ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট ভালভাবে করতে পারবেন না, রাতের অন্ধকারে কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হলে যেতে পারবে না। ছেলেরা কমান্ড মানবে না? আসলে এসব কিছু না, মেয়েদের দায়িত্ব দেওয়া হলেই তারা দায়িত্ব পালন করতে পারবে। মেয়েরা পারে না, পৃথিবীতে এমন কাজ কম আছে।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ আগস্ট ২০১৭/নৃপেন/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়