ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

হাজারো অভিযোগেও দুদক যখন নীরব

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২৯, ২৫ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হাজারো অভিযোগেও দুদক যখন নীরব

এম এ রহমান : দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জন্ম। মূলত লিখিত অভিযোগ ও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত দুর্নীতিসংক্রান্ত সংবাদ আমলে নিয়ে চলে দুদকের অনুসন্ধান। অভিযোগ আমলে নিতে সম্প্রতি যোগ হয়েছে দুদক হটলাইন-১০৬।

দুদক হটলাইনে প্রতিদিন কয়েক হাজার কল আসে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে। কিন্তু দুদকের তফসিলভু্ক্ত না হওয়ায় অনেক দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিতে পারে না সংস্থাটি। তফসিলভুক্ত না হওয়ায় লিখিত কিংবা মৌখিক (হটলাইনকেন্দ্রিক) অন্তত ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ অভিযোগ আমলে নেয় না দুদক।

ফলে ওই অভিযোগের বিষয়ে দুদকের করণীয় কিছু থাকে না। অর্থাৎ শুধু তফসিলের বিষয়ে জনসাধারণের স্বচ্ছ ধারণা না থাকায় অধিকাংশ অভিযোগে দুদককে নীরব ভূমিকা পালন করতে হয়। এ কারণে দুদক চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দুদকের তফসিল বিষয়ে জনসচেতনা বৃদ্ধির ওপর জোর দিয়েছেন।

গত ২৭ জুলাই হটলাইন-১০৬ চালু হওয়ার পর এ পর্যন্ত ১ লাখ ৩০ হাজার কল এসেছে। এর মধ্যে আমলযোগ্য অভিযোগের সংখ্যা তিন শ’র কিছু বেশি। এর মধ্যে থেকে হাতেগোনা কয়েকটি অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ রাইজিংবিডিকে বলেন, এতদিন দুর্নীতির লিখিত অভিযোগ আসত দুদকে। এখন হটলাইন-১০৬ করার পরে মানুষ সহজে অভিযোগ করার নতুন ক্ষেত্র পেয়েছে। এজন্য সরকার ও বিটিআরসিকে ধন্যবাদ। মানুষ চাইলেই পয়সা ছাড়াই অভিযোগ করতে পারছে।

তিনি বলেন, দুদকে হটলাইনে চালুর পর থেকে জন্ম নিবন্ধন, জমি, কাবিখা ও ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে বেশি অভিযোগ করছে। তবে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ আসছে ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে। অভিযোগের ৯০ শতাংশই দুদকের তফসিলভুক্ত নয়। আসলে বস্তুনিষ্ঠ অভিযোগ কিন্তু তত বেশি না। তবে অনেক ক্ষেত্রে তফসিলভুক্ত না হলেও আমরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলি।

তাই দুদকের অভিযোগ করার আগে জানতে হবে কোন কোন অপরাধ দুদকের তফসিলভুক্ত। শত্রুতাবশত কিংবা অযথা হয়রানির উদ্দেশ্যে অভিযোগটি দিয়েছে কি না এবং সবশেষে বিবেচিত যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তার দপ্তর, দাপ্তরিক মর্যাদা, বর্ণিত অপরাধ করার ক্ষমতা ও সুযোগ আছে কি না।

এ বিষয়ে দুদক সূত্র জানায়, দুদকে কোন ধরনের অভিযোগ নেওয়া হয়, আর কীভাবে অভিযোগ করতে হয়, তা জানা না থাকায় অনেকে ঠিকমতো অভিযোগ দিতে পারেন না। প্রয়োজনীয় তথ্যও দেন না অনেকে। তাই বাছাই পর্যায়ে বাতিল হয়ে যায় এসব অভিযোগ।

অভিযোগ যাচাই-বাছাইকালে সেসব বিষয় আমলে নেওয়া হয় তা হলো- 

সবার আগে নজর দিতে হবে কোন অভিযোগগুলো দুদকের তফসিলভুক্ত। এরপর যিনি অভিযোগ করেছেন, তার পরিচয়, নাম-ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর যথার্থ কি না, সেটা যাচাইয়ের পাশাপাশি অভিযোগটি সুনির্দিষ্ট ও বস্তুনিষ্ঠ কি না। তফসিলবহির্ভূত অপরাধ বিষয়ে ঢালাও অভিযোগ আসার কারণে দুদককেও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। এরপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অভিযোগটি দুদক আইন-২০০৪ ও দুদক বিধিমালা-২০০৭ অনুসারে কাজ শেষে আদালতে অপরাধ প্রমাণ করা যাবে কি না। প্রমাণে কী পরিমাণ অর্থ, শ্রম, মেধা, সময় ও উপকরণ প্রয়োজন হবে।

দুদকের তফসিলভুক্ত ও তার শাস্তির বিধানসহ উল্লেখযোগ্য অপরাধগুলো হলো : সরকারি চাকরিজীবিদের দায়িত্ব পালনের সময় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ বা উপঢৌকন গ্রহণ। এ ধরনের অপরাধে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ১৬১, ১৬২ ও ১৬৩ ধারায় এক থেকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের কথা বলা হয়েছে।

সরকারি চাকরিজীবিসহ বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক যদি বেআইনিভাবে নিজ নামে কিংবা বেনামে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন, দুদক আইনের ১৬৫ ধারায় তিন বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের কথা বলা হয়েছে।

সরকারি চাকরিজীবিদের আইন অমান্যের কারণে কোনো ব্যক্তির ক্ষতি হলে ও ইচ্ছাকৃত ভুল নথি উপস্থাপনে কারো ক্ষতি হলে আইনের ১৬৬ ও ১৬৭ ধারায় এক বছর থেকে ৩ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি অনুমতি ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করেন কিংবা অন্যায়ভাবে নিলামে কোনো সম্পত্তি কেনেন তাহলে দুদকে আইনের ১৬৮ ও১৬৯ ধারায় এক থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ডের বিধার রাখা হয়েছে।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যদি কোনো অপরাধীকে শাস্তি থেকে রক্ষার চেষ্টা করেন কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য সংরক্ষণে কারো কোনো ক্ষতি হলে তা দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এ অপরাধে আইনের ২১৭ ও ২১৮ ধারায় দুই থেকে তিন বছরের শাস্তি ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, সরকারি কর্মচারী এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী যদি সরকারি অর্থ বা সম্পত্তি আত্মসাৎ কিংবা ক্ষতিসাধন করেন, মিথ্যা হিসাব দাখিল করেন, জালিয়াতির কোনো দলিল বৈধ ব্যবহার করেন এবং অপরাধীর কাছে গোপন তথ্য ফাঁস করেন তা দুদক আইনের ৪০৯, ৪৭৭, ৪২০, ৪৬২, ৪৬৬, ৪৬৯ ও ৪৭১ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর ওই ধারায় ৭ থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে।

এ ছাড়া কোনো ধরনের দুর্নীতি ও ঘুষ থেকে উদ্ভূত অর্থপাচারসংক্রান্ত অপরাধ, সরকারি সম্পদসক্রান্ত অপরাধসহ সরকারি স্বার্থহানিকর কোনো দুর্নীতি সংশ্লিষ্ট অপরাধ দুদকের তফসিলভুক্ত।

অভিযোগে যা উল্লেখ থাকা উচিত: কোনো অভিযোগকারী যদি হটলাইন-১০৬ এ বা লিখিতভাবে অভিযোগ করতে চান তাহলে দুদকের তফসিলভুক্ত কি না সেটা আগে বুঝতে হবে। এরপর তফসিলভুক্ত হলে সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য ও প্রমাণসহ অভিযোগ দিতে হবে। আর যদি লিখিত অভযোগ করতে চান তাহলে আবেদনে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর লিখতে হবে। যেমন : কোনো ব্যক্তি অবৈধ সম্পদের বিষয়ে অভিযোগ করলে তাকে অবৈধ অর্থ ও সম্পদ অর্জন করে থাকলে তার নাম, পদবি, পেশা ও পূর্ণ ঠিকানা এবং একই সঙ্গে দিতে হবে স্থাবর সম্পদের (বাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট ও জমি ইত্যাদি) অবস্থান, পরিমাণ, আনুমানিক দামসহ ওই সব সম্পদের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা। এ ছাড়া ব্যাংক হিসাব, শেয়ার, এফডিআর, সঞ্চয়পত্রের সুনির্দিষ্ট তথ্য, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর ও ধরন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান, ধরন ও সুনির্দিষ্ট ঠিকানা এবং বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপন-সংক্রান্ত বিবরণ দিতে হবে।

সরকারি কর্মচারী বা ব্যাংকারদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে আত্মসাৎকৃত অর্থ-সম্পদের পরিমাণ ও সময়কাল; কোন দায়িত্ব থেকে, কখন, কীভাবে আত্মসাৎ করেছেন; ওই আত্মসাতের সঙ্গে আর কারা জড়িত থেকে সহযোগিতা করেছেন, তার বিবরণ থাকতে হবে। ক্ষমতার অপব্যবহারসংক্রান্ত ও অন্যান্য অভিযোগের ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি কখন, কীভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে লাভবান হয়েছে বা অন্যকে লাভবান বা ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন বা রাষ্ট্রীয় অর্থ-সম্পদের ক্ষতি করেছেন, তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ আগস্ট ২০১৭/এম এ রহমান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়