ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পুষ্টি চাহিদার অন্যতম উৎসটি ৭০ বছরেও অবৈজ্ঞানিক

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২০ নভেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পুষ্টি চাহিদার অন্যতম উৎসটি ৭০ বছরেও অবৈজ্ঞানিক

হাসান মাহামুদ : সম্পূর্ণ ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোগ এবং দেশীয় পুঁজিতে তিলে তিলে গড়ে ওঠা একটি শিল্প ‘পোল্ট্রি’। দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণের অন্যতম প্রধান উত্স। প্রাণিজ আমিষের প্রায় এক তৃতীয়াংশ আসে এই পোল্ট্রি শিল্প থেকে। এটি বর্তমানে দেশের ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানমুখী একটি সমৃদ্ধ শিল্প।

কিন্তু ৭০ বছর ধরে এই খাতটি রয়ে গেছে অবহেলিত, এতে ঘটেনি উদ্যোক্তা ও বিজ্ঞানীদের মেধার সমন্বয়। খাতভিত্তিক সুষম উন্নয়নে সরকারের কোনো পরিকল্পনা গৃহীত হয়নি, এমনকি জিডিপিতে ২ দশমিক ৪ শতাংশ অবদান রাখা সম্ভাবনাময় এই খাতের জন্য সরকারি কোনো নীতিমালার বাস্তবায়নও নেই। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এই খাতে এখনো বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা-ভাবনার প্রভাব পড়েনি। ফলে ব্যক্তি পর্যায়ে নানা ঝুঁকি নিয়েই চলছে এসব খামার।

গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ ও নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প। বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ৬৫-৭০ হাজার ছোট-বড় খামার রয়েছে। এ ছাড়া আছে ব্রিডার ফার্ম, হ্যাচারি ও মুরগির খাবার তৈরির কারখানা। পোল্ট্রি শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি, কাঁচামাল ও ওষুধ প্রস্তুতকারক এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ খাতে জিডিপির আকার ছিল ৩২ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ছিল ২৯ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২ হাজার ২২০ কোটি টাকা। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে সরকারি মুরগি খামারে ৫৫ লাখ ৬৭ হাজার ৮৩৮টি এবং বেসরকারি খামারে ১ হাজার ৯৮ কোটি ৯৬ লাখসহ মোট ১ হাজার ৯৯ কোটি ৫২ লাখ ডিম এবং ৫৮ লাখ ৬২ হাজার টন মাংস উত্পাদিত হয়। এসব পরিসংখ্যান থেকে সহজেই এ খাতের দ্রুতবিকাশ সর্ম্পকে ধারণা পাওয়া যায়।

সম্ভাবনাময় এই শিল্পের বিকাশে সরকার খাতটিকে কর অব্যাহতি সুবিধা দিয়েছিল। কিন্তু আবার কর অব্যাহতি সুবিধা তুলে নিয়ে নতুন করে করারোপ করা হয়েছে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি পোল্ট্রি শিল্পের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং স্পর্শকাতর এ শিল্পে বিনিয়োগ নিরুত্সাহিত করছে। হতাশার বিষয় হচ্ছে, যেখানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আগামী তিন বছরের মধ্যে দেশের পোল্ট্রি শিল্পে মাংস ও ডিমের উৎপাদন দ্বিগুণ করার আহ্বান জানিয়েছেন, সেখানে এই খাতে নতুন করে করারোপ হয়েছে।

জাতীয়ভাবে পোল্ট্রি খামার তৈরির জন্য এবং পোল্ট্রি খাতের বিকাশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানসম্মতভাবে এই খাতটি গড়ে তোলার কোনো পরিকল্পনা বা কর্মসূচি এখনো সরকার গ্রহণ না করায় ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। বিভিন্ন খামারে হঠাৎ করেই নানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়া, উৎপাদন কম হওয়া প্রভৃতি এর প্রভাব বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে। ফলে ঝরেও পড়ছেন অনেক খামারি।

প্রাণিখাদ্যে ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রোমোটর : আমাদের দেশে প্রাণিখাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রোমোটরের (এজিপি) ব্যবহার একটি সাধারণ বিষয়। অথচ উন্নত বিশ্ব এটি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে ইউরোপিয়ান কমিশন ২০১৬ সালে এজিপি ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। এরপর আমেরিকা ও কানাডা একই নীতি অনুসরণ করে। অথচ সরকারের উদাসীনতার কারণে আমাদের দেশে এখনো এজিপির ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে। এমনকি এজিপির সঠিক বিকল্প না থাকা এবং এ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকায় ফিড মিলাররাও এ বিষয়ে সম্মক জ্ঞান রাখার প্রয়োজন মনে করে না। ফলে এজিপি ব্যবহার চলছেই।

যদিও পুষ্টিবিদদের মতে, এই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বন্ধ করা উচিত। পাশাপাশি সরকারের উচিত এর বিকল্পের ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে সহায়তা করা। এজিপির বিকল্প হিসেবে ভালমানের ফিড এসিডিফায়ার-এর ব্যবহারের পক্ষেও মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

পোশাক খাতের বায়ারদের মতো এ খাতও বিদেশি আগ্রাসনে পড়তে যাচ্ছে : গত কয়েক বছরে দেশের পোল্ট্রি শিল্পে বিদেশি পুঁজি আসতে শুরু করেছে। বর্তমানে দেশে এ খাতে সাতটি বিদেশি কোম্পানির বিনিয়োগ রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি ভারতের, একটি চীন ও অন্যটি থাইল্যান্ডের।

বলা হয়ে থাকে, যেকোনো খাতে বিদেশি বিনিয়োগ ইতিবাচক। কিন্তু যেহেতু সরকার এখনো দেশীয় পোল্ট্রি ব্যবসায়ীদের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে পারছে না, এ খাতের জন্য যেহেতু এখনো কোনো নীতিমালা হয়নি; সেক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের নির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা জরুরি। কারণ বিদেশি বিনিয়োগের সঙ্গে দেশীয় বিনিয়োগ বা ব্যবসায়ীদের কখনোই পেরে ওঠার কথা নয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের প্রায় ৩০ ভাগ পুঁজি নিয়ন্ত্রণ করছে এসব বিদেশি কোম্পানি। দেশীয় ব্যবসায়ী বেশি হলেও তাদের বিনিয়োগ সীমিত পর্যায়ে। ফলে বিদেশি কোম্পানিদের সঙ্গে যেন এক অসম প্রতিযোগিতা লেগেই আছে দেশি খামারগুলোর। ঝরে পড়ছে ছোট খামারগুলো। এক্ষেত্রে সরকার গবেষণালব্ধ, বিজ্ঞানসম্মত ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

পোল্ট্রি খাতের উন্নয়নে নীতিমালা ও পৃথক একটি বোর্ড গঠন প্রয়োজন : পোল্ট্রিখাতের উন্নয়নে ২০০৮ সালে করা হয়েছিল জাতীয় পোল্ট্রি উন্নয়ন নীতিমালা। যেখানে পোল্ট্রিকে প্রাণিজ কৃষিখাত ঘোষণা করে শস্যখাতের সমান সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে পোল্ট্রির জন্য। কিন্তু কাগুজে নীতিমালাতেই আটকে আছে যার উন্নয়ন। আর এ ক্ষেত্রে সরকারের উদাসীনতাকেই দায়ী করছে পোল্ট্রি শিল্পের অভিভাবক সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি কেন্দ্রীয় কাউন্সিল।

সংগঠনটির প্রেসিডেন্ট মসিউর রহমান বলেন, শুধু পরিকল্পনা হাতে কাজ হয় না, আইন শুধু পাশ করেও কাজ হয় না। প্রয়োজন এর বিধি, প্রয়োজন এর বাস্তবায়ন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপে পোল্ট্রির উন্নয়নে একটি পৃথক বোর্ড গঠনের প্রয়োজনীয়তা সর্ম্পকেও ধারণা পাওয়া গেছে। যে বোর্ড পোল্ট্রি শিল্পের অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের পক্ষ থেকে কাজ করতে পারবে। যে বোর্ড পোল্ট্রি খাতের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান হয়ে কাজ করবে।

আগামী দিনের চাহিদা পূরণ করতে অবশ্যই সরকার এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের এক হয়ে কাজ করতে হবে। এমনকি শুধু চাহিদা পূরণই যথেষ্ট নয়, নিরাপদ খাদ্য এবং ভোক্তার অধিকারের ব্যাপারেও সজাগ থাকা জরুরি। পোল্ট্রি শিল্পের জন্য গঠিত বোর্ড এসব বিষয়েও ভূমিকা রাখতে পারবে।

এমনকি রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক কারণসহ বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট প্রতিকূলতায় ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারার জন্য এই খাতকে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন বিমা আওতায় আনার ব্যবস্থা করা।

সামগ্রিক বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী রাইজিংবিডিকে বলেন, দেশের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ জন্য শিল্পের বিকাশ জরুরি। পোল্ট্রি শিল্প বিকাশের জন্য সরকার সব ধরনের সহায়তা দেবে।

তিনি আরো বলেন, পোল্ট্রি শিল্পের উত্পাদন আরো বাড়াতে এবং মান উন্নয়ন করতে উদ্যোক্তা ও বিজ্ঞানীদের মেধার সমন্বয় ঘটাতে হবে। নিরাপদ মুরগি ও ডিম উত্পাদনের মাধ্যমে দেশের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে।

পোল্ট্রি সংক্রান্ত কিছু চমকপ্রদ তথ্য : গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ ও নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প। যা গ্রামীণ পর্যায়ে পোশাক খাতের থেকেও বেশি। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) তথ্য মতে, বর্তমানে প্রায় ৬১ লাখ মানুষের জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পোল্ট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এর প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। কাউন্সিলের হিসেব মতে, এ খাতে প্রায় ২৪ লাখ নারী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন।

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা নিজেদের সমতার সীমারেখায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছেন। এ শিল্পের মতো এমন ব্যাপকভিত্তিক সফলতা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পুষ্টি চাহিদা পূরণের নজির আর কোনো শিল্পে নেই।

এই অঞ্চলে ১৯৪৭ সালে ছয়টি পোল্ট্রি খামার স্থাপনের মধ্য দিয়ে এ শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। স্বাধীনতার আগে যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) কোনো ধরনের ব্যবসা চালু করা কষ্টকর ছিল, তখনকার সময়েই ১৯৬৪ সালে ৩০ একর জমির ওপর গাজীপুরে ব্যক্তি উদ্যোগে পোল্ট্রি খামার গড়ে উঠেছিল। ১৯৮০ সালের দিকে দেশে বাণিজ্যিকভাবে পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে।

পোল্ট্রি খামার জেলা, উপজেলা থেকে ছড়িয়ে ইউনিয়ন থেকে গ্রাম পর্যায়ে চলে গেছে। কৃষির পর এটি বর্তমানে গ্রামীনপর্যায়ে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শিল্প বা খাত।

এই শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় দেড় কোটি মানুষের বেঁচে থাকা জড়িত। প্রায় ১ লাখ প্রাণী চিকিৎসক, পোল্ট্রি বিশেষজ্ঞ, পুষ্টিবিদ এ খাতে সরাসরি নিয়োজিত রয়েছেন।

আগে পোল্ট্রি ফিডের ভ্যাকসিন ও মেডিসিন আমদানি করা হতো। কিন্তু চাহিদা বাড়ায় এখন এসব ওষুধ দেশেই তৈরি করছে কয়েকটি ফার্মা। অভ্যন্তরীণভাবে পোল্ট্রি ফিড উত্পাদন বেড়ে যাওয়ায় দেশের ভুট্টাচাষিরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে। অর্থাৎ পোল্ট্রি শিল্প বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অন্য খাতকেও এগিয়ে নিতে সহায়তা করছে।

আগে শতভাগ প্যাকেটজাত ফিড আমদানি করতে হতো। পোল্ট্রি ফিড আমদানির পরিমাণ প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। বর্তমানে উত্পাদিত পোল্ট্রি ফিডের পরিমাণ ১ লাখ ৪০ হাজার টন।

বাংলাদেশে পোল্ট্রি একমাত্র পরিবেশবান্ধব খাত। এ শিল্পে ক্ষতিকর বর্জ্য বলে তেমন কিছু নেই। এ ছাড়া মুরগির বিষ্ঠা দিয়ে এখন বায়োগ্যাস ছাড়াও তৈরি হচ্ছে জৈব সার।

বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যক্তি ও মাইক্রোসফটের মালিক বিল গেটসও অনুধাবন করেছেন, লাভজনক পোল্ট্রি ব্যবসার মাধ্যমে খুব সহজেই দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব। পশ্চিম আফ্রিকার দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা মানুষের সহায়তায় মুরগি প্রতিপালনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তিনি। বিল গেটস সেখানে এক লাখ মুরগি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, বিনিয়োগ হিসেবে মুরগি খুবই ভালো। কারণ মুরগির দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ নভেম্বর ২০১৭/হাসান/এসএন/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়