ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

ছয় বছরেও শেষ হয়নি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৪৩, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছয় বছরেও শেষ হয়নি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত

মামুন খান : দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে ছয়  বছর। কিন্তু তারপরও শেষ হয়নি সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার তদন্ত। সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার পরও তদন্ত কাজে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।

২০১২ সালের এই দিনে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় নৃশংসভাবে খুন করা হয় মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক গোলাম মোস্তফা সারোয়ার ওরফে সাগর সারোয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন নাহার রুনা ওরফে মেহেরুন রুনি। ঘটনার পর পরই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেই ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে ৭২ মাসে এসে ঠেকেছে। কিন্তু এখনো কী কারণে, কারা খুন করেছে এ তথ্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।

পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পর র‌্যাবের তদন্তেও নেমে এসেছে স্থবিরতা। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এ পর্যন্ত আদালতের কাছ থেকে ৫৪ বার সময় নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত ১ ফেব্রুয়ারি মামলাটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু এদিন তদন্ত সংস্থা র‌্যাব প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। এজন্য ঢাকা মহানগর হাকিম বেগম মাহমুদা আক্তার প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ আগামী ১৩ মার্চ ধার্য করেন।

এদিকে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিএনএ পরীক্ষায়  ঘটনাস্থলে ‘অজ্ঞাত’ দুই পুরুষ ঘাতকের তথ্য পাওয়া গেছে। তবে তাদের নাম-ঠিকানা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি বলে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা যাচ্ছে না। সাগর-রুনি দম্পতির স্বজনসহ সন্দেহভাজনের ডিএনএন নমুনা র‌্যাবের হাতে এলেও ঘাতকদের শনাক্ত করা যায়নি। তাদের বাসা থেকে খোয়া যাওয়া মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ চালু হলে খুনিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।

এদিকে দীর্ঘদিনেও সাংবাদিক দম্পতি খুনের ঘটনায় তদন্ত সম্পন্ন না হওয়ায় নিহতের পরিবার ও গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও চরম অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের স্বদিচ্ছা থাকলেই এ হত্যার রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব বলে নিহতদের পরিবারের দাবি।

সাগরের মা সালেহা মনির বলেন, ‘দেখতে দেখতে ছয় ছয়টি বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু আমরা বিচার পেলাম না। সরকার একটু সহানুভূতি দেখালে এ হত্যার রহস্য বের হয়ে যেত। সরকারের স্বদিচ্ছায় খালেদা জিয়ার এত পুরনো দুর্নীতি বের হয়ে গেল, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের রহস্য বের হয়ে গেল, পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিৎ হত্যার রহস্য বের হয়ে গেল-আর আমার দুই সন্তান হত্যার রহস্য বের করা যাবে না!’

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, বিচার হবে। কই কী হল? কিছুই তো হল না। দীর্ঘদিন পার হয়ে গেল। আমার ছেলে ও ছেলের বউ দেশদ্রোহী ছিল না, তারা কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কাজও করেনি। তবে তাদের হত্যার রহস্য কেন উদঘাটন করা হল না।

তিনি আরো বলেন, সন্দেহভাজনদের ডিএনএ বিদেশে পরীক্ষা করানো হয়েছে। সেখানে দুই অজ্ঞাত ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেই দুই অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বের করতে পারল না! সেই ‘৪৮ ঘণ্টা’ ৬ বছরে পরিণত হতে চলেছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটাই অনুরোধ, তিনি যেন এ হত্যাকাণ্ডের  বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখেন। তিনি একটু সদয় দৃষ্টি দিলে এই তদন্ত আর ঝুলে থাকবে না।

আদালত সূত্র জানা গেছে, তদন্তের ৬ বছর সময়ে র‌্যাব এ মামলায় পাঁচবার তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করেছে। প্রথমে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর, এরপর ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি, ওই বছরের ৭ জুন, ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর ও সর্বশেষ গত বছরের ২১ মার্চ তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। দাখিল করা তদন্ত অগ্রগতি সংক্রান্ত প্রতিটি প্রতিবেদনে প্রায় একই ধরনের তথ্য লেখা রয়েছে।

সর্বশেষ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো আলামতের ডিএনএ পরীক্ষা করে ঘটনাস্থলে দুই জন অজ্ঞাত পুরুষ ব্যক্তির ডিএনএ পাওয়া গেছে। ওই দুই অজ্ঞাত আসামিকে শনাক্ত করতে জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। এছাড়া অন্যান্য অগ্রগতি প্রতিবেদনের মতো এবারের প্রতিবেদনেও বলা হয়, ঘটনাস্থল থেকে চুরি যাওয়া ল্যাপটপ বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে কি না-এ ব্যাপারে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ল্যাপটপ ব্যবহৃত হচ্ছে কি না-সে ব্যাপারে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। চুরি করা ল্যাপটপ কখনও ব্যবহার করা হলে তার তথ্য পাওয়া যেতে পারে। মামলার ভিকটিম মিডিয়া কর্মী হওয়ায় তদন্তকালে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে তদন্ত করা হচ্ছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন, বিভিন্ন আলাম পরীক্ষা, বিদেশি  বিশেষজ্ঞদের মতামত, বিভিন্ন ব্যক্তির সাক্ষ্য গ্রহণ, সমসাময়িক অন্যান্য হত্যাকাণ্ডে ঘটনা বিশ্লেষণ, ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী থানাসমূহে একই অপরাধ প্রক্রিয়ায় সংগঠিত অপরাধ ও অপরাধীদের বিষয়ে বিস্তারিতভাবে তদন্ত করা হচ্ছে। গ্রিল কাটা অপরাধে চোর-ডাকাতদের বিষয়েও নিবীড়ভাবে তদন্ত অব্যাহত আছে।’

প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের বছর ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার এবং রুনি নিজ ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন। পরদিন ভোরে তাদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় রুনির ভাই নওশের আলম রোমান রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। প্রথমে শেরেবাংলা নগর থানার এসআই মো. জহুরুল ইসলাম এ মামলার তদন্ত কাজ শুরু করেন। ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ডিবি উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলম এ মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন। এরপর সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের এক রিট পিটিশনে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল এ মামলার তদন্তভার র‌্যাবের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৯ এপ্রিল র‌্যাব সদর দপ্তরের সিনিয়র পুলিশ সুপার মো. জাফর উল্লাহ মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন। র‌্যাবের এ কর্মকর্তা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যাওয়ায় ২০১৪ সালের ১২ মার্চ এ মামলার তদন্তভার পান র‌্যাব সদর দপ্তরের   সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. ওয়ারেছ আলী মিয়া। তদন্তভার গ্রহণের পর এ কর্মকর্তা মামলার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সাগর-রুনির একমাত্র ছেলে মাহির সারোয়ার মেঘকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার জবানবন্দি ১৬১ ধারায় লিপিবদ্ধ করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসামি ও সন্দেহভাজনদের ডিএনএ পরীক্ষা করে এনে ওই প্রতিবেদন বিস্তারিত পর্যালোচনা করে তদন্ত করেন। এরপর ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে র‌্যাব সদর দপ্তরের সহকারী পরিচালক সহকারী পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন আহম্মদ এ মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন।

এদিকে মামলায় রুনির কথিত বন্ধু তানভীর রহমানসহ মোট আসামি ৮ জন। মামলার অপর আসামিরা হলেন, বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু ওরফে মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান অরুন, পলাশ রুদ্র পাল, তানভীর ও আবু সাঈদ।

আসামিদের প্রত্যেককে একাধিবার রিমান্ডে নেওয়া হলেও তাদের মধ্যে কেউ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেনি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/মামুন খান/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়