ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ভূমি অধিগ্রহণের অর্থ আত্মসাৎ

এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ডিসি-এডিসি

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৫, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ডিসি-এডিসি

এম এ রহমান মাসুম : ভূমি মন্ত্রণালয়ের তদন্ত রিপোর্টে দায়িত্ব অবহেলার প্রমাণ ও গ্রেপ্তারকৃত তিন আসামির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে নাম আসা সত্ত্বেও এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে কিশোরগঞ্জের ডিসি, এডিসি ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা।

ভূমি অধিগহণের সরকারি তহবিলের ৫ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মো. সেতাফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার ও মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরপর রিমান্ড শেষে সেতাফুলের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির রেশ ধরে ও্ই মামলায় গ্রেপ্তার হন কিশোরগঞ্জের জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের অডিটর মো. সহিদুজ্জামান ও পিয়ন দুলাল মিয়া।

কিশোরগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তছলিমা আক্তারের এজলাসে ওই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে নাম ছিল কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) আজিমুদ্দিন বিশ্বাস, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দুলাল চন্দ্র সূত্রধর, অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মাইনুল ইসলামেরও।

আসামি অডিটর সহিদুজ্জামান ও পিয়ন দুলালের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসে কিশোরগঞ্জের জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম ও সুপার গোলাম হায়দারের নাম। শুধু তাই নয় ১১ জানুয়ারি দাখিল করা ভূমি মন্ত্রণালয় কর্তৃক তদন্ত রিপোর্টেও উঠে আসে ডিসি আজিমুদ্দিন বিশ্বাসের অবহেলার প্রমাণ।

কিন্তু পিয়ন দুলাল ও সহিদুজ্জামানকে দুদক গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও অদৃশ‌্য কারণে মূল হোতারা গ্রেপ্তার কিংবা জিজ্ঞাসাবাদের অনেকটা বাইরে রয়েছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এরপরও যেন দুদক জেগে ঘুমাচ্ছে।

আত্মসাৎ মামলার তদন্তের দায়িত্ব পালন করছে দুদকের বিশেষ টিম। দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ আবদুল ওয়াদুদের নেতৃত্বে গঠিত বিশেষ টিমের অপর সদস্যরা হলেন- সহকারী পরিচালক মনিরুল ইসলাম ও ফজলুল বারী। মামলার তদারকি করছেন দুদকের বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মো. নাসিম আনোয়ার।

এ বিষয়ে দুদক পরিচালক নাসিম আনোয়ার রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘কিশোরগঞ্জের অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে তদন্ত চলছে। এটা গোপনীয় বিষয়, এ পর্যায়ের বলার মতো কোনো উপাদান নেই।’

এ সংক্রান্ত অনিয়ম খতিয়ে দেখতে গঠিত তদন্ত রিপোর্ট গত ১১ জানুয়ারি ভূমি মন্ত্রণালয়ে দাখিল করেন কমিটি প্রধান। ৮৮ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে সেতাফুল ইসলামের অনিয়ম ও জেলা প্রশাসকের দায়িত্বের অবহেলার সত্যতা পাওয়া যায়, যার স্মারক নং-৩১.০০.০০০০.০৪৭.৬৮.১১৫.১৭.২১। মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র রাইজিংবিডিকে এসব তথ‌্য নিশ্চিত করেছে।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধিগ্রহণ অধিশাখা-১ থেকে তৈরিকৃত তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয় ছিল- ‘কিশোরগঞ্জ জেলার এল এ শাখার ইস্যুকৃত চেকের সাথে কেস নথি, রেজিস্ট্রার, লেজার বইয়ের স্থিতির সাথে হিসাবরক্ষণ অফিসের স্থিতিরি সমন্বয়সহ নিয়ম বহির্ভূতভাবে ৮ কোটি ৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা ফেরত প্রদানের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন।’

ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও তদন্তকারী কর্মকর্তা মির্জা তারিক হিকমতের সই করা রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রাক্তন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. মনিরুল ইসলাম পাটোয়ারি ২০১৭ সালের ৮ আগস্ট কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসককে ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মো. সেতাফুল ইসালামের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করা, ভূমি অধিগ্রহণ শাখার নথিতে (নথি নং ৩১.৪১.৪৮০০.০০৮.০৬.০২১.০৬) ক্ষতিপূরণের প্রতিটি চেক পাশ করার পূর্বে জেলা প্রশাসক বা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে যাচাই করার প্রস্তাব দেওয়া হলেও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান না করা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দুলাল চন্দ্র সূত্রধর ও অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মো. মাইনুল হক সেতাফুল ইসলামের নিকট থেকে ১৪০টি এলএ চেকের প্রাপকের অংশ উদ্ধার করার পরও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া এবং ২০১৭ সালের ৩ ডিসেম্বর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক দুলাল চন্দ্র সূত্রধরের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী নিয়ম বহির্ভূতভাবে বিভিন্ন এলএ কেসের আওতায় ৪৮টি এলএ চেকের মাধ্যমে ৮ কোটি ৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা বিতরণ করায় সেতাফুল ইসলামকে ওই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান ও ইস্যুকৃত কিন্তু পাওয়া যায়নি এমন ১৩টি চেক ফেরত প্রদানসহ নিয়ম বহির্ভূতভাবে ২০৫টি এলএ চেক নিজ হেফাজতে রেখে ইস্যু করার কারণ দর্শানোর সুপারিশ করলেও হিসাব না নিয়ে সেতাফুল ইসলামকে অবমু্ক্ত করার বিষয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) আজিমুদ্দিন বিশ্বাসকে ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য অনুরোধ করা।

যদিও মন্ত্রণালয়ের তদন্ত রিপোর্টের বিষয়ে দুদক পরিচালক নাসিম আনোয়ারের কাছে জানতে চাইলে তিনি আবগত নন বলে রাইজিংবিডিকে জানান।

গত ৩ ফেব্রুয়ারি মামলার প্রধান আসামি মো. সেতাফুল ইসলামের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে কিশোরগঞ্জের ডিসি আজিমুদ্দিন বিশ্বাস ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) দুলাল চন্দ্র সূত্রধর, অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মাইনুল ইসলাম, জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের অডিটর মো. সহিদুজ্জামান ও পিয়ন দুলালের নাম উঠে আসে। কিশোরগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তছলিমা আক্তারের এজলাসে তিনি ওই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

এরপরই তার জবানবন্দির জের ধরে গত ৬ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তারকৃত আসামি জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের অডিটর কিশোরগঞ্জের জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের অডিটর মো. সহিদুজ্জামান ও পিয়ন মো. দুলাল মিয়া গত ১৩ ফেব্রুয়ারি একই এজলাসে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। যেখানে কিশোরগঞ্জের জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম ও সুপার গোলাম হায়দারের অর্থ অত্মসাৎ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার কথা উঠে আসে।

এ বিষয়ে আদালতে দেওয়া তাদের জবানবন্দির সূত্রে জানা যায়, সেতাফুল ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষতিপূরণের ২ কোটি টাকা একটি চেকের মাধ‌্যমে এবং ৭ ডিসেম্বর অপর চেকের মাধ‌্যমে ২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের অফিসার ও সুপারের সহায়তায় উত্তোলন করেন। সেতাফুল কিশোরগঞ্জ জেলা ডিসি অফিসের মাইক্রোবাস ব‌্যবহার করে ব‌্যাংক থেকে ওই টাকা উত্তোলন করেন। এ সময় হিসাবরক্ষণ অফিসের পিয়ন দুলাল সেতাফুলের সঙ্গে থেকে উত্তোলনকৃত টাকা বহন করেন, যা তিনি (দুলাল) ১৬৪ ধারায় আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন বলে জানা যায়।

জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের প্রায় ১৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে পালিয়ে যান সরকারের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা সেতাফুল ইসলাম, এমন অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মো. সেতাফুল ইসলামকে গত ১৭ জানুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার করার পর দুদকের সহকারী পরিচালক রাম প্রসাদ মণ্ডল বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। ঘটনাকালীন সেতাফুল ইসলাম কিশোরগঞ্জ জেলায় ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তিনি জনপ্রশাসন ক্যাডারের ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তা।


** 




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/এম এ রহমান/সাইফুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়