ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

রদবদলের মারপ্যাঁচে তিতাস দুর্নীতির অনুসন্ধান

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৭, ২০ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রদবদলের মারপ্যাঁচে তিতাস দুর্নীতির অনুসন্ধান

এম এ রহমান মাসুম: মিটার টেম্পারিং ও মিটার বাইপাস করে গ্যাস সংযোগ দিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ, কেজি মেপে ঘুষ গ্রহণ এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের এমডিসহ ডজনখানেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চলছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান।

এক বছরের বেশি সময় ধরে তিতাসের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ব্যাপারে পৃথক পৃথক অনুসন্ধান চললেও অভিযোগ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সংগ্রহ ছাড়া অনুসন্ধান কাজের নেই অগ্রগতি। অভিযোগকারীদের আপত্তি ও বিভিন্ন কারণে বারবার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনে অনুসন্ধান কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। ফলে তিতাসের দুর্নীতি বিষয়ে অনুসন্ধান অনেকটা রদ বদলের মারপ্যাঁচে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।  

২০১৭ সালের অক্টোবরে টঙ্গী ও গাজীপুরে কর্মরত তিতাসের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরদ্ধে শতাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠানে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে ঘুষ গ্রহণ ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করে সংস্থাটি। অনুসন্ধান চলাকালে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপ-পরিচালক মো. আহমার উজ্জামান বদলি হলে পরিবর্তন করা হয় অনুসন্ধান কর্মকর্তা। পুরাতন ওই অভিযোগের সঙ্গে গাজীপুর, সাভার, ভালুকা ও নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে তিতাসের এমডিসহ পদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ‘কেজি মেপে ঘুষ লেনদেন’- এমন অভিযোগ যোগ করে নতুন একটি অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়।

দায়িত্ব দেওয়া হয় উপ-পরিচালক এ কে এম মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দলকে। টিমের অপর সদস্যরা হলেন উপ-সহকারী পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান ও মোহাম্মদ শাহজাহান মিরাজ। এই টিম দায়িত্ব নেওয়ার পর সেপ্টেম্বর মাসে দুই দফায় তিতাসের পাইপলাইন ডিজাইন বিভাগের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী সাব্বের আহমেদ চৌধুরী এবং ইলেকট্রিক্যাল কোরেশন কন্ট্রোল (ইসিসি) বিভাগের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিকুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দফায় তলব করা হয়। তবে দু’বারই অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে হাজির হননি তারা। এরই মধ্যে অজ্ঞাত এক কারণে আবারো অনুসন্ধান কর্মকর্তা পরিবর্তন করে নতুন করে টিম গঠন করা হয়। এবারেদায়িত্ব দেওয়া হয় উপপরিচালক মো. মনজুর আলমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের নতুন টিমকে।

এ অভিযোগে তিতাসের চলতি দায়িত্বে থাকা ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মীর মশিউর রহমান, পাইপলাইন ডিজাইন বিভাগের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী সাব্বের আহমেদ চৌধুরী, ইলেকট্রিক্যাল কোরেশন কন্ট্রোল (ইসিসি) বিভাগের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিকুর রহমান, গাজীপুরের চলতি দায়িত্বে থাকা মহাব্যবস্থাপক (বর্তমানে জিএম, ভিজিল্যান্স) এস এম আবদুল ওয়াদুদ এবং প্রাক্তন কোম্পানি সচিব ও বর্তমানে সুন্দরবন গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এমডি মোশতাক আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে।

অভিযোগে বলা হয়েছে, সাব্বের আহমেদ চৌধুরী গাজীপুর বিক্রয় অঞ্চলে এবং মো. আবু বকর সিদ্দিকুর রহমান টঙ্গী উত্তরের সিস্টেম অপারেশন বিভাগের ব্যবস্থাপক থাকার সময়ে ঘুষ নিয়েছেন প্রধানত স্থাপনা পুনর্বিন্যাস, গ্রাহকদের অবৈধ গ্যাস-সংযোগ, গ্যাসের অবৈধ লোড বৃদ্ধি, অনুমোদন অতিরিক্ত স্থাপনা ব্যবহারের অবৈধ সুযোগ এবংপছন্দসই পদায়নকে কেন্দ্র করে। অভিযোগে খুদে বার্তায় ঘুষের আলাপের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে ক্ষুদে বার্তার রেকর্ড উল্লেখ করে বলা হয়, গাজীপুরে অবস্থিত এএমসি নিট কম্পোজিট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী প্রদীপ দাসের কাছ থেকে তিতাস কর্মকর্তা সাব্বের আহমেদ চৌধুরী পরিবার যে ঘুষ নিয়েছে, এর মধ্যে ৫০ লাখ টাকা নেওয়ার একটি ঘটনা ২০১৬ সালের ১৩ অক্টোবরের। ওই দিন সাব্বের-প্রদীপের ক্ষুদে বার্তাগুলোতে ৫০ লাখ টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার কথোপকথনের রেকর্ড রয়েছে। একইভাবে গাজীপুরের ভিয়েলাটেক্স লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠান থেকেও সাব্বের আহমেদ ও মীর মশিউর রহমানের বিরুদ্ধে ঘুষের বিষয়টি উঠে এসেছে। অনুরূপভাবে মো. আবু বকর সিদ্দিকুর রহমানসহ সবুর, জাহাঙ্গীর, টেপা, নোমান ও কাদেরসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ রয়েছে।

অন্যদিকে তিতাসে মিটার টেম্পারিং ও মিটার বাইপাস করে গ্যাস সংযোগ দিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের আরো একটি অভিযোগের বিষয়ে একটি অনুসন্ধান করছে দুদক। যে অভিযোগে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে মীর মসিউর রহমানসহ ৮ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও উপপরিচালক মো. ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী। কিন্তু যথারীতি অসুস্থতার অজুহাতে হাজির হননি তারা। এরই মধ্যে গত ৪ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানটির এমডি মীর মসিউর রহমান, উপ-মহাব্যবস্থাপক এস এম আবদুল ওয়াদুদ, আবিডি-নারায়ণগঞ্জ শাখার মহা-ব্যবস্থাপক শফিকুর রহমান, ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসেস শাখার ব্যবস্থাপক শাহজাদা ফরাজী ও সহকারী কর্মকর্তা আবু ছিদ্দিক তায়ানীর দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে চিঠি দেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। কিছুদিন পরই এ অনুসন্ধান কর্মকর্তা পরিবর্তন করে উপপরিচালক গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরীকে নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়। দুদক ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল থেকে এ অভিযোগটি অনুসন্ধান করছে।

অন্যদিকে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সিবিএ সভাপতি ও দুই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ ছয়জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদের খোঁজে পৃথকভাবে একটি অনুসন্ধান চলছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)।

সিবিএ’র বর্তমান সভাপতি হাজী কাজীম উদ্দিন, অন্যান্য নেতা ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবৈধ গ্যাস সংযোগ ও মিটার টেম্পারিংসহ বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।

ওই অভিযোগে অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান এরই মধ্যে সিবিএ সভাপতি হাজী কাজীম উদ্দিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আয়াজ উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মোহাম্মদ নাসীর উদ্দিন, হিসাব রক্ষক আসাফুদ্দৌল্লাহ টুটুল ও সাভার মিটারিং এন্ড ভিজিলেন্স শাখার ডেপুটি ম্যানেজার মো. সিরাজুল ইসলামকে ১১, ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।

প্রায় একই ধরণের ও একই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগের পৃথক পৃথক অনুসন্ধান নিয়ে বিভিন্ন মহলের সমালোচনা রয়েছে। এমনকি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে বিভিন্ন সময় জিজ্ঞাসাবাদে এসে দাবি করছেন বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে পৃথক অভিযোগের অনুসন্ধানের ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বারবার কাগজপত্র ও বক্তব্য প্রদানসহ বিভিন্ন কারণে হয়রানির শিকার হতে হয়। অন্যদিকে অনুসন্ধান কাজ বিলম্বিত হয় বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন।

এ বিষয়ে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা উপপরিচালক প্রনব কুমার ভট্টাচার্য রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘অনুসন্ধান বা তদন্ত পর্যায়ে  কর্মকর্তা পরিবর্তন একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। বিভিন্ন কারণে এ পরিবর্তন হতে পারে। অনুসন্ধান কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূক কোনো অভিযোগ উঠলে বা অনুসন্ধান সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিলে যথাযথ অনুসন্ধানের স্বার্থে কমিশন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন করতে পারে।’

এদিকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তিতাসের করপোরেট হিসাব শাখার ব্যবস্থাপক হুমায়ুন কবীর খান, হিসাব শাখার উপমহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আব্দুর রশিদ, বেতন ও তহবিল শাখার উপব্যবস্থাপক মো. নাজমুল হক, প্রকৌশলী মো. মহিদুর রহমান ও প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা খানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। পেট্রোবাংলার তদন্তে প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে এ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ অক্টোবর ২০১৮/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়