ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বই মূদ্রণে দুর্নীতি: প্রশ্নবিদ্ধ এনসিটিবির সংশ্লিষ্টরা

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৯, ২৪ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বই মূদ্রণে দুর্নীতি: প্রশ্নবিদ্ধ এনসিটিবির সংশ্লিষ্টরা

এম এ রহমান মাসুম : প্রাথমিকের ২০১৭ সালের শিক্ষাবর্ষের প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ১৯ লাখ বই ছাপানোর দরপত্রের প্রক্রিয়াগত দুর্নীতির অভিযোগে প্রশ্নের মুখে পড়েছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

দক্ষিণ কোরিয়ার বই মূদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান তারা টিপিএস কোম্পানির অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মুখোমুখি হয়েছেন তারা।

বেশ কিছুদিন ধরে চলা অনুসন্ধানে দরপত্রে প্রক্রিয়াগত অনিয়মের বেশকিছু আলামত পেলেও অনিয়মের স্বপক্ষে পর্যাপ্ত দলিল এখনো দুদকের কাছে নেই। ফলে অনুসন্ধান কাজ চলছে ঢিমেতালে।

যথাযথ প্রমাণের অভাবে পার পেয়ে যেতে পারেন প্রশ্নবিদ্ধ এনসিটিবি’র কর্তা ব‌্যক্তিরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে এসব তথ‌্য জানিয়েছেন।

এর আগে অভিযোগ অনুসন্ধানে এনসিটিবি ও তারা টিপিএসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য নিয়েছেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও দুদকের উপ-সহকরী পরিচালক মুহাম্মদ শিহাব সালাম।

কোরিয়ান কোম্পানি টিপিএস দাবি করছে এনসিটিবি’র সংশ্লিষ্টদের কারণে দরপত্র বাতিল হয়েছে। অন্যদিকে এনসিটিবি বলছে চাহিদাকৃত নমুনা কাগজ সংযুক্ত না করার জন্য এমন ঘটনা ঘটেছে।

বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থার অর্থায়নে ২০১৭ সালের শিক্ষাবর্ষের প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়ের ১০ কোটি ৮৮ লাখ ৪৪ হাজার ৬৩১টি বই ছাপানোর জন্য মোট ২০টি প্যাকেজে ৯৮টি লটে দরপত্র আহ্বান করা হয়। তবে জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে ১৭টি লটের দরপত্র প্রক্রিয়া নিয়ে।

দুদকের অনুসন্ধান পর্যায়ের তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, অভিযোগকারী প্রতিষ্ঠান তারা টিপিএস কোম্পানি লিমিটেড মোট ২৬টি লটে দরপত্র জমা দেয়। ২০১৬ সালের ৩১ মে দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে এনসিটিবি’র প্রধান কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত অডিটোরিয়ামে সকল উপস্থিত দরদাতা ও তাদের মনোনীত প্রতিনিধিদের সামনে দরপত্র উন্মোচন করে দেখা যায় তারা টিপিএস মোট ১৭টি লটে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে মনোনীত হয়েছে। লট নম্বরগুলো হলো- ৭০৪, ৭১০, ৭১৩, ৭১৪, ৭৭৫,৭৭৬, ৭৮৩,  ৭৮৪, ৭৮৫, ৭৮৬, ৭৮৭, ৭৮৮, ৭৯৩, ৭৯৪ এবং ৭৯৮। ওই বছরের ১ জুন সাত সদস্যবিশিষ্ট দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি মূল্যায়ন কার্যক্রম শুরু করে এবং ৪ জুনের মধ্যে প্রাথমিক মূল্যায়ন কাজ সম্পন্ন করে।

কিন্তু মূল্যায়ন প্রতিবেদনের কপি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ‘তারা টিপিএস কোম্পানি লিমিটেড ১৭টি লটে প্রাথমিকভাবে সর্বনিম্ন দরদাতা নির্বাচিত হলেও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রাথমিক ইভাল্যুয়েশনের সময় তাদের দরপত্র গ্রহণ করা হয়নি। কারণ হিসেবে দেখা যায়, তারা টিপিএস কোম্পানি দরপত্রের সঙ্গে প্রিন্টিং পেপার ও কভার পেপারের স্যাম্পল জমা দেয়নি। শুধু প্রিন্টিং পেপার ও কভার পেপারের ১টি শিট দরপত্রের সঙ্গে জমা দিয়েছে। যাতে লট নম্বর উল্লেখ ছিল না।

অথচ বিড ডকুমেন্টের সেকশন-৩ ‘এক্সপেরিয়েন্স বা অভিজ্ঞতা ও টেকনিক্যাল ক্যাপাসিটি’ অংশে বলা আছে, ‘প্রত্যেক বিডারকে প্রতিটি বিডের জন্য প্রচ্ছদের নমুনা কপি ও প্রিন্টিং পেপারের নমুনা কপির পৃথক তিন সেট দাখিল করতে হবে। যা বিড ইভাল্যুয়েশন কমিটি কর্তৃক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। পরীক্ষায় যদি উত্তীর্ণ না হয় তাহলে বিড বাতিল বলে গণ্য হবে।

তবে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ ও অভিযোগে তারা টিপিএস বারবার দাবি করেছে তারা চাহিদাকৃত সকল নমুনা কাগজ সংযুক্ত করেছে। এনসিটিবি’র সংশ্লিষ্টরা ওই কাগজ সরিয়ে তাদের দরপত্র বাতিল করেছেন।

অন্যদিকে তারা টিপিএস কোম্পানির বাংলাদেশের প্রতিনিধি হারুন অর রশিদের সই করা অভিযোগে বলা হয়েছে, তারা টিপিএস কোম্পানি বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে ২০১৭ সালের প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক মূদ্রণ ও সরবরাহের জন্য ৯৮টি লটের মধ্যে ২৬টি লটের জন্য ২০১৬ সালের ১৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত দরপত্রে অংশগ্রহণ করে। উক্ত দরপত্রে অংশগ্রহণ করে বিধি ও দরপত্রের শর্তাবলী অনুযায়ী ২৬টি লটের প্রয়োজনীয় পে-অর্ডার, ব্যাংক গ্যারান্টি, বাৎসরিক টার্ন ওভার, প্রয়োজনীয় সংখ্যক কভারেজ ও প্রিন্টিং কপির নমুনা ও অভিজ্ঞতা সনদপত্রসহ এনসিটিবি’র টেন্ডারবাক্সে ফেলে। এরপর ২৬টি লটে সর্বনিম্ন দরদাতা মনোনীত হয় প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু একটি চক্র তারা টিপিএস কোম্পানিকে টেন্ডারে অযোগ্য প্রমাণ করা জন্য কোম্পানির মূদ্রিতব্য কাগজের নমুনা ও স্যাম্পল কপি দরপত্রের সঙ্গে জমা দেয়নি। অথচ তারা টিপিএস আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে তাদের দাখিলকৃত টেবিল অব কনটেন্টস-এ নমুনা জমা দেওয়ার বিষয় লিপিবদ্ধ করে। যা পরবর্তীকালে যাচাইকালেও সংযুক্তির বিষয়টির প্রমাণ পাওয়া যায়। ইতিমধ্যে এ বিষয়টি প্রকিউরমেন্ট এনটিটির সচিব ও ন্যাশনাল কারিক্যুলাম অব টেক্সটবুক বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ করে বিস্তারিত জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার না পেয়ে ১৭টি লটে সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়া সত্বেও তারা টিপিএসকে কেন কার্য্যাদেশ দেওয়া হলো না- সে বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে দুদকের সাহায্য প্রয়োজন।

অভিযোগটি ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট দুদকে দাখিল করা হয়।

এ বিষয়ে এনসিটিবির সদস্য প্রফেসর মিয়া এনামূল হক সিদ্দিকীর কাছে জানতে চাইলে তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। চেয়ারম্যান স্যার এ বিষয়ে বলতে পারবেন।’

অন্যদিকে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ন চন্দ্র সাহা বলেন, ‘এর কোনো ভিত্তি নেই। দরপত্রের সিডিউল ও পিপিআর অনুযায়ী যে সকল ঠিকাদার বিট করেছেন তারাই কাজ পেয়েছেন।

দুদক সচিব ড. শামসুল আরেফিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি অনুসন্ধান শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকার করেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ নভেম্বর ২০১৮/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়