ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পরীক্ষায় অসদুপায়কে নৈতিক স্খলন হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবিদরা

আবু বকর ইয়ামিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ২৭ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পরীক্ষায় অসদুপায়কে নৈতিক স্খলন হিসেবে দেখছেন শিক্ষাবিদরা

আবু বকর ইয়ামিন : পাশের হার থেকে শুরু করে বিদ্যালয়ে উপস্থিতি পর্যন্ত বিষয়গুলোকে আমলে নিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি গত কয়েক বছর ধরে ইতিবাচক। কিন্তু এর মধ্যে বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের প্রবণতা বৃদ্ধি। এর কারণ হিসেবে শিক্ষাবিদরা দায়ি করছেন কতিপয় শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর নৈতিক স্খলনকে।

পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে অনিয়মের কারণে প্রতিনিয়ত বহিষ্কার হচ্ছেন পরিক্ষার্থীরা। একইসঙ্গে শৃঙ্খলাভঙ্গ, নকল সরবরাহসহ নানাবিধ কারণে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অনেক পরিদর্শক শিক্ষকও বহিষ্কার হচ্ছেন। তবে পরীক্ষা হল থেকে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি পরিদর্শক বহিষ্কার হওয়ার বিষয়টিকে নীতিগতভাবে মেনে নিতে নারাজ শিক্ষাবিদ বিশ্লেষকরা।

প্রাইভেট বা কোচিংয়ের শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা, নৈতিক মূল্যবোধে অভাব, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যোগ্য লোক বাছাই প্রক্রিয়ায়ও অসচ্ছতা আছে বলে মনে করছেন তারা। যারা শিক্ষক হয়েছেন তারা অবশ্যই শিক্ষিত। তবে সুশিক্ষিত নন। যার কারণে এ জাতীয় ঘটনা ঘটছে। একমাত্র সুশিক্ষাই পারে এসব দুর্নীতির মূলে কুঠারাঘাত করতে।

আন্ত:বোর্ড সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী গত চার বছরে জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি মিলে ৬ হাজার ৯২ শিক্ষার্থী বহিষ্কার হয়েছেন। শিক্ষক বহিষ্কার হয়েছেন ৯৬ জন। চলতি বছরে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ৪৬২ শিক্ষার্থী বহিষ্কার হলেও কোনো শিক্ষক বহিষ্কারের খবর পাওয়া যায়নি। অবশ্য চলতি বছরে শিক্ষক বহিষ্কার না হওয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে সংশ্লিষ্টরা।

দেখা যায়, এসএসসিতে বহিষ্কৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০১৯ সালে বহিষ্কার হয়েছে ৭৩১ জন, ২০১৮ সালে এক হাজার ৭৫ জন, ২০১৭ সালে ৮৭২ জন, ২০১৬ সালে বহিষ্কার হয়েছে ২৪২ জন। শিক্ষক বহিষ্কার হয়েছেন ২০১৯ সালে ৮ জন, ২০১৮ সালে ৭ জন, ২০১৭ সালে ২০ জন, ২০১৬ সালে বহিষ্কার হয়েছেন ২১ জন শিক্ষক।

এছাড়া এইচএসিতে ২০১৮ সালে বহিষ্কার হয়েছে ৮৩৬ জন, ২০১৭ সালে ৭৭৯ জন, ২০১৬ সালে বহিষ্কার হয়েছে ২ জন শিক্ষার্থী। শিক্ষক বহিষ্কার হয়েছেন ২০১৮ সালে ১১ জন, ২০১৭ সালে ৩ জন। ২০১৬ সালে একজন শিক্ষকও বহিষ্কার হননি বলে বোর্ড সূত্রে জানা যায়।

জেএসসিতে ২০১৮ সালে বহিষ্কার হযেছে ৫০৫ শিক্ষার্থী, শিক্ষক বহিষ্কার হয়েছেন ৬ জন। ২০১৭ সালে ৫৬১ শিক্ষার্থী, ৭ শিক্ষক, ২০১৬ সালে বহিষ্কার হয়েছে ৩০৭ শিক্ষার্থী ও ৫ শিক্ষক। ২০১৫ সালে বহিষ্কার হযেছে ২২৭ শিক্ষার্থী ও ৮ শিক্ষক।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, যদিও শিক্ষার্থী বহিষ্কারও কোনোভাবে কাম্য নয়। তবে তারা বয়সে ছোট এবং তাদের সঠিক কাউন্সেলিংয়ের অভাবে তারা এমন কাজে জড়ায়। কিন্তু ওই শিক্ষার্থীদের যারা নৈতিকতা শিক্ষা দেবে, কাউন্সেলিং করবে কিংবা অপরাধ প্রবনতা থেকে ফিরিয়ে আনবে সেই শিক্ষকরাই যখন অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয় সেটি সত্যিই দু:খজনক। যারা নিয়োগ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত আছেন তাদের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত।

এ বিষয়ে এমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেছেন, যারা বহিষ্কার হচ্ছেন তারা কোনো না কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির কারনেই বহিষ্কার হচ্ছেন। সবাই আসলে শিক্ষকের গুণ আহরণ করতে পারেন না বলেই এ জাতীয় ঘটনা ঘটছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, বহিষ্কার কত হচ্ছে সেটার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে কিভাবে এটি কমিয়ে আনা যায়। পরীক্ষায় যাতে কোনো শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার না হতে হয় সেক্ষেত্রে কার্যকরী সকল পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষকদেরই ভূমিকা বেশি থাকবে। কিন্তু সে শিক্ষকরাই যখন অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে যায় তখন আর বলার কিছু থাকে না। এটি খুবই নিন্দনীয়।

তিনি বলেন, প্রাইভেট কোচিংয়ের ছাত্র কিংবা স্বপ্রণোদিত হয়ে হোক যেভাবেই হোক না কেন শিক্ষকদের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত হওয়ার বিষয়টি কখনো গ্রহণযোগ্য নয়।

এমন ঘটনাকে নৈতিকতার অনেক বড় অবক্ষয় হিসেবে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, এটিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। যারা পরীক্ষায় দুর্নীতি ধরবেন তারাই যদি দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকেন তাহলে তাদের থেকে কি শিক্ষা পাবে আমাদের তরুণ প্রজন্ম।

শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে আরো স্বচ্ছ করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করে এ  শিক্ষাবিদ বলেন, এখান থেকেই ধীরে ধীরে অন্যান্য অপকর্মের দিকেও জড়িত হয় জাতি গড়ার এ অভিভাবকরা। তাই আমাদের শুরুতেই এর টুটি চেপে ধরা উচিত। অর্থাৎ আমাদের নিয়োগ প্রক্রিয়াকে আরো স্বচ্ছ করা উচিত। সব বিষয়ে সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। যারা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট আছেন তাদেরকেই আগে স্বচ্ছ হতে হবে। অর্থ লেনদেন বা অন্যকোনো প্রক্রিয়ায় যদি কোনো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে তারা নানামুখী অপকর্মে লিপ্ত হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বিষয়টির গোড়াতেই গলদ দূর করতে হবে।

ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান জিয়াউল আহসান বলেন, মূলত সঠিক কাউন্সেলিংয়ের অভাবে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অনিয়ম করছে। যার ফলশ্রুতিতে বহিষ্কার হচ্ছে। কিন্তু যে শিক্ষককরা তাদের সঠিক দিক নির্দেশনা দিবেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলবেন তারাই যখন দুর্নীতিতে জড়ায় তখন বলার কিছুই থাকে না।

তবে দিন দিন এ প্রবনতা কমে আসছে জানিয়ে তিনি বলেন, একটা ঘটনা একবার ঘটার পর আমরা সেটি নিয়ে কাজ করছি। যার ফলশ্রুতিতে কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হতে আমরা আপ্রান চেষ্টা করছি। আমর সেটার ফল পাচ্ছিও। এবছর এখন পর্যন্ত একজন শিক্ষকও বহিষ্কার হননি। তবুও আমাদের তীক্ষ্ম দৃষ্টি রয়েছে। যারা এসবে জড়িত হচ্ছেন তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে পারলে এ জাতীয় ঘটনা নির্মূল করা সম্ভব বলে আমরা মনে করি।

কলেজ পর্যায়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত তরুণ শিক্ষক মামুনুর রশিদ বলেছেন, আসলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বা লেখাপড়া বাদ দেওয়ার পেছনে আমরা শিক্ষকরাই অনেকাংশে দায়ী। আমরা সঠিক শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে পারছি না। শিক্ষার মান বাড়ে বা শিক্ষার উন্নতি হয় শিক্ষকের গুণে। শিক্ষকদের দায়িত্ব কর্তব্য অনেক। এ মহান দায়িত্ব কর্তব্য কাজে অবহেলা দেখা দিলেই শিক্ষকদের মাঝে অবক্ষয় তৈরি হয়। যা শিক্ষার গতিপথকে থামিয়ে দেয়। শিক্ষকরা যদি আদর্শ হতে বিচ্যুত হয় তাহলে শিক্ষায় বিপর্যয় নেমে আসবে। শিক্ষার্থীর ওপর যাতে শিক্ষার প্রভাব পড়তে পারে সে জন্য শিক্ষককে সবসময় সচেতন থাকতে হয়।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ এপ্রিল ২০১৯/ইয়ামিন/হাসান/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়