ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

৫২০৭ ভবনের ১১৮৭টি চরম ঝুঁকিতে

আহমদ নূর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫৪, ২০ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
৫২০৭ ভবনের ১১৮৭টি চরম ঝুঁকিতে

আহমদ নূর: রাজধানীর মিরপুরের মুক্তিযোদ্ধা সুপার মার্কেট। পাঁচতলা এ ভবনে আবাসিক হোটেলসহ রয়েছে শতাশিক পোশাক, কসমেটিক্স, জুতা, মোবাইল ফোন, ইলেট্রনিক্স সামগ্রি এবং অন্যান্য সামগ্রির দোকান। প্রতিদিনই বিভিন্ন পণ্য কিনতে এখানে ভিড় জমান ক্রেতারা। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো- এ মার্কেটে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নাই বললেই চলে।

মার্কেটের পাঁচতলা ভবনের উপরে উঠার জন্য রয়েছে মাত্র দু’টি সিঁড়ি। এর একটি কখনো কাউকে ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। অন্য সিঁড়িটির অর্ধেকই বিভিন্ন মালামালে ঠাসা। ফলে ক্রেতাদের যাতায়াতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ চোখে না পড়লেও মার্কেটের দোকানগুলোতে রয়েছে জুতার কার্টন, পলিথিন, সিল্ক শাড়ী, বডি স্প্রেসহ নানা দাহ্য পদার্থ। ফলে এই মার্কেটে আগুনের সূত্রপাত হলে তা দ্রুত ছড়ানোর সম্ভাবনা রয়েই যায়। সম্পূর্ণ ভবনে রয়েছে মাত্র ছয়টি ফায়ার এক্সটিংগুইশার। সেগুলো আবার সিঁড়িতে রাখা। নেই ফায়ার হাইড্রেন্ট। তবে মার্কেটের পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশে প্রশস্ত সড়ক আছে। ফলে এখানে আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা উদ্ধার তৎপরতা ও আগুন নেভানোর কাজ করতে পারবেন।

মুক্তিযোদ্ধা সুপার মার্কেটের বিপরীতে থাকা বাগদাদ শপিং কমপ্লেক্সের অবস্থা আরো নাজুক। বহুতল এই ভবনের নিচ তলায় আছে নামমাত্র একটি ফায়ার এক্সটিংগুইশার, তাও বেশ পুরাতন। এটি ব্যবহারের কোনো নির্দেশিকাও দেয়া নেই সেখানে। মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এটি কীভাবে ব্যবহার করবে সে বিষয়ে তাদের কোন ধারণা নেই। বাগদাদ শপিং কমপ্লেক্সেও রয়েছে পোশাক, কসমেটিক্স, জুয়েলারি, জুতার দোকান। ভবনে নেই জরুরি বহির্গমন পথ।

একই এলাকার ‍মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সে পাওয়া যায়নি কোনো অগ্নি নির্বাপন সরঞ্জাম। ভবনটিতে বিভিন্ন পণ্যের দোকান ছাড়াও শতাধিক অফিস রয়েছে। আগুন লাগলে ভবনের নিচ তলায় থাকা লোকজনের বের হওয়ার কিছুটা সুযোগ রয়েছে। তবে দ্বিতীয় তলা থেকে উপরে থাকা লোকজনের বের হওয়ার সুযোগ কম। কারণ, অপ্রশস্ত সিঁড়ি এবং দ্বিতীয় তলা থেকে উপরের সব তলার বারান্দায় গ্রিল ও তারের বেড়া দেয়া।

‘আগুন লাগবে না, কখনো লাগেনি, ভবনের উপর আল্লাহর বিশেষ রহমত আছে’- এমন ধারণা করে নিজের সুরক্ষায় ভবন মালিক বা সেখানে থাকা ব্যক্তিরা অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে উদ্যোগী হননা।

বাগদাদ শপিং কমপ্লেক্সের জুয়েলারী ব্যবসায়ী মো. সুমন বলেন, ‘আমাদের এই ভবনে কখনো আগুন লাগেনি। আল্লাহর বিশেষ রহমত আছে।’

মিরপুর মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সের কাপড় ব্যবসায়ী শাহাদাৎ বলেন, ‘আগুন লাগবে না। নিচে আগুন লাগলেও আমি চিন্তা করছি না। আমার দোকান সিঁড়ির পাশেই রয়েছে। দৌঁড় দিয়ে বের হয়ে যাবো। সমস্যায় পড়বে উপরে যারা আছে তারা।’

বহুতল এসব ভবনে থাকা কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার তৎপরতা শুরু করার আগ পর্যন্ত তারা কী করবে সে বিষয়ে তাদের কোন ধারণাই নেই। এসব বিষয়ে জানার আগ্রহও তাদের মধ্যে কখনো তৈরি হয়নি।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের জরিপের পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে অধিদপ্তর থেকে পাঁচ হাজার ২০৭টি ভবন পরিদর্শন করা হয়। এতে সার্বিক মান বিবেচনায় ৫০২টি ভবনকে অগ্নি নিরাপত্তায় সন্তোষজনক বলে মনে করছে ফায়ার সার্ভিস। বাকিগুলোর মধ্যে ১ হাজার ১৮৭টি ভবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং তিন হাজার ৫১৮টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এরমধ্যে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় শপিংমল বা মর্কেট রয়েছে ৬৭৮টি। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ভবন রয়েছে ৩৩৬টি, বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা ভবন ১১টি, হাসপাতাল-ক্লিনিক ভবন ১৩৪টি, আবাসিক হোটেল ভবন ২৯টি, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের অফিস ভবন তিনটি। ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় শপিংমল-মার্কেট ৮৯৭টি, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এক হাজার ৭২টি, ব্যাংক ৫৯৩টি, হাসপাতাল-ক্লিনিক ৫০২টি, আবাসিক হোটেল ৪৩৩টি, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের অফিস ২১টি রয়েছে।

ঝুঁকিপূর্ণ নয়, এমন ভবনের তালিকায় রয়েছে শপিংমল-মার্কেট ২৪টি, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ১১৯টি, বিভিন্ন ব্যাংকের শাখা ভবন ২০১টি, হাসপাতাল, ক্লিনিক ৬৩টি, আবাসিক হোটেল ৭১টি, মিডিয়া সেন্টার ২৪টি।

এছাড়া ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ১০ জুন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিস দুই হাজার ৬৯৩টি ভবনে পরিদর্শন করেছে। এর মধ্যে মার্কেট ৮০টি, বহুতল ভবন ৩৩০টি, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক শাখা ভবন ৪৮৮টি এবং হাসপাতাল ১ হাজার ৭৯৫টি। চলতি বছরের পরিদর্শন জরিপের ফলাফল এখনো অপ্রকাশিত। তবে সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, বেশিরভাগ ভবনই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ সহকারী পরিচালক মো. শাহজাহান শিকদার বলেন, ‘ভবন পরিদর্শন আমাদের নিয়মিত কাজের একটি অংশ। পরিদর্শনে ভবন মালিকদের অগ্নি দুর্ঘটনা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়।’

তিনি বলেন, ‘মার্কেট পরিদর্শনে দেখা গেছে ব্যবসায়ীরা সিঁড়িতে মালামাল রাখেন। এতে স্বাভাবিক চলাচলেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। আর আগুন লাগলে সিঁড়ি ব্যবহার করা খুব কঠিন হয়। হাসপাতালগুলোতে আগুন লাগলে অনেক প্রাণহানির আশংকা থাকে। কারণ, রোগীরা তো জীবন বাঁচাতে দৌঁড়াতে পারবে না।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আগুন লাগার আশংকা কম থাকে। আগুন লাগলেও সেখানে প্রচুর খোলামেলা জায়গা থাকে। ফলে শিক্ষার্থীরা বের হতে পারবে, আমরাও উদ্ধার তৎপরতা চালাতে পারব। তাছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমরা নিয়মিত অগ্নি মহড়ার আয়োজন করে থাকি।’





রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ জুন ২০১৯/নূর/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়