ঢাকা     শনিবার   ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  পৌষ ১৩ ১৪৩১

‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে’

টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫১, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো চাঁদ বুঝি তা জানে’

তালাত মাহমুদ

শাহ মতিন টিপু : তোমারে লেগেছে এত যে ভালো/ চাঁদ বুঝি তা জানে,/ রাতের বাসরে দোসর হয়ে/ তাই সে আমারে টানে। তাকে চেনার জন্য এই একটি গানই যথেষ্ট। ‘রাজধানীর বুকে’ ছবিতে এ গানটি গেয়ে বাংলাদেশের মানুষের মন কেড়ে নিয়েছিলেন কিংবদন্তি এই সঙ্গীতশিল্পী।

 

২৪ ফেব্রুয়ারি এই মহানশিল্পীর ৯১তম জন্মদিন। ১৯৯৮ সালের ৯ মে তিনি প্রয়াত হন। অমর শিল্পী  তালাত মাহমুদের জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

 

তালাত মাহমুদ ছিলেন হিন্দি, উর্দু গানের, বিশেষত গজলেরও কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী। সুমধুর, মসৃণ সুরেলা কণ্ঠে তার গীত গজল তাকে `গজল সম্রাট` উপাধি এনে দিয়েছিল। হিন্দি সিনেমার প্লে-ব্যাকে গজলের জনপ্রিয়তা এসেছিল তালাতের হাত ধরেই। পাশাপাশি, সুদর্শন তালাত মাহমুদ বেশ কিছু হিন্দি সিনেমায় নায়কের ভুমিকায় অভিনয় করেছিলেন।

 

তালাত মাহমুদের জন্ম ভারতের লখনউতে সম্ভ্রাান্ত ও রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে। ছেলেবেলা থেকেই তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হন। লখনউ ছিল উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পীঠস্থান। পন্ডিত এস সি আর ভাট এর কাছে সঙ্গীতে তালিম নেন। সিনেমার প্রতিও ছিল তার প্রবল আগ্রহ, যা তার রক্ষণশীল পরিবার কোনও ভাবেই মেনে নিতে সম্মত ছিল না। একসময় অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে হয় তালাতকে সঙ্গীতের ও ফিল্মের ক্যারিয়ার বেছে নিয়ে পরিবার ত্যাগ করতে হবে, নয়ত সব ত্যাগ করে পারিবারিক ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করতে হবে।

 

তালাত সঙ্গীতের জীবন বেছে নেন এবং তার পরিবার সুদীর্ঘ এক যুগ পরে, কেবল তালাত সফল হওয়ার পরই, তার ক্যারিয়ারকে মেনে নেয়। সঙ্গীতে তালাতের ক্যারিয়ার শুরু হয় একজন বিশুদ্ধ গজল শিল্পী হিসাবে। তাকে ‘গজল সম্রাট’ হিসেবেও ডাকা হয়। ১৯৩৯ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তিনি দাগ, জিগর, মির এমন কয়েকটি সিনেমায় গজল গেয়ে সাড়া ফেলে দেন। এ সময়েই তিনি অল- ইন্ডিয়া রেডিওতে সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে যোগ দেন।

 

১৯৪১ সালে তালাত `সব দিন এক সমান নাহি থা` গজলটি রেকর্ড করেন। গজল শিল্পী হিসাবে তালাতের খ্যাতি ছড়িয়ে পরে। তালাত তখন লখনউ ছেড়ে চলে যান কলকাতায়, তিনি পৌঁছানোর আগেই তাঁর খ্যাতি কলকাতার সঙ্গীত জগতে পৌঁছে গিয়েছিল।

 

১৯৪৪ এ তার বিখ্যাত গজল, `তাসভির তেরি দিল মেরা বেহেলা না সাকো গি` বের হয়। গজলটি অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা পায় এবং এর সুবাদেই সারা ভারতবর্ষে তালাত মাহমুদের নাম ছড়িয়ে পরে। কলকাতার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তখনই তার বিষয়ে আগ্রহী হয়। সুদর্শন তালাত মোট ১৬ টি ছায়াছবিতে তখন অভিনয় করে ফেলেন।

 

রূপালি পর্দায় প্রথম নায়ক হিসেবে ‘সমাপ্তি’তে অভিনয় করেন ১৯৪৬ সালে। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৪৮ সালে। ছবিতে তার নায়িকা ছিলেন ভারতীয় দেবী। এর আগে ‘সাত নম্বর বাড়ি’ ছবিতে তার গাওয়া ‘আজি কথা নয়’ গানখানি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ ভাগ হলো। সেই সময়ে বাংলার জনতা তার মুখে শুনলো ‘দু’টি পাখি দুটি তীরে মাঝে নদী বহে/ছিড়িল বীণার তার মুছে গেল পরিচয়’...।

 

কলকাতায় থাকতেই তিনি `তপন কুমার` নাম নিয়ে বেশ কিছু বাংলা আধুনিক গান, চিত্রগীতি ও কয়েকটি নজরুল গীতি রেকর্ড করেন। গানগুলো বাংলা গানের কালজয় করে, এমনকি অন্য ভাষাভাষীদের মধ্যেও জনপ্রিয়তা পায়।

 

১৯৪৯ সালে কলকাতার পাট চুকিয়ে বোম্বেতে স্থায়ী নিবাস গড়েন। হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তালাতের জনপ্রিয়তা হয় গগনচুম্বী। বিশেষ করে অনিল বিশ্বাসের সঙ্গীত পরিচালনায় `আরজু` ছবিতে তার গাওয়া গজল তাকে অমরত্ব এনে দেয়। পাশাপাশি ১২ টি হিন্দি সিনেমায় তিনি নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন।

 

দিলীপ কুমার ও কামিনী কৌশলের অভিনয়ের সঙ্গে তালাত মাহমুদ ও লতা মুঙ্গেশকরের গলা এক অপূর্ব আলোড়ন তুলেছিল দর্শক সমাজে। ১৯৫২ সালে ‘দিল-এ নাদান’ ছবিতে তালাত মাহমুদ নায়ক হিসেবে অভিনয় শুরু করেন। ছবিটির পরিচালক ছিলেন এআর কারদার। নায়িকা ছিলেন নাদিরা। এরপর নায়ক হিসেবে ওয়ারিশ, ডাক বাবু, মালিক, কিনারে কিনারে, এক গাঁও কি কাহানি, রাফতার, লালরুখ প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন। মালিক এবং ওয়ারিশ ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন নায়িকা গায়িকা সুরাইয়া। ‘রাফতার’ ছবিতে ছিলেন নাদিরা।

 

১৯৬০সালে তিনি কিছু সময়ের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন ও এহতেশাম পরিচালিত `রাজধানীর বুকে` ছায়াছবিতে ইতিহাসের দুটি কালজয়ী গানে কণ্ঠদান করেন। তার ক্যারিয়ার মূলত কলকাতা থেকে শুরু হলেও, তার বাংলা গানের সর্বমোট সংখ্যা মাত্র ৪৯টি (`রাজধানীর বুকে`র দুটি গানসহ)।

 

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য : অনেক সন্ধ্যাতারা ফোটে ওই আকাশে, এই তো বেশ নদীর তীরে, ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে, আমার সে গান (রাজধানীর বুকে), ভেঙে গেল যদি বাসা, দুটি পাখি দুটি তীরে, ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে, হায় ভালোবাসা সে কি, হয়তো সে কথা তোমার স্মরণে নাই, যে বিরহ দিলে, তুমি সুন্দর যদি নাহি হও, রূপের ওই প্রদীপ জ্বেলে, ফুল দিতে যদি ভুল, তোমারে লেগেছে এত যে ভালো (রাজধানীর বুকে), তুমি বোঝো না তো কেন, তুমি চিরদিন যদি নাহি রবে মোর জীবনে, আধোরাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়, তুমি শুধু গেছো ভুলে, টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে, তুমি ফিরে এসো ও শোন গো সোনার মেয়ে।

 

চার দশকে তিনি ৮০০’র মতো গান করেন। তার উল্লেখযোগ্য তিনটি অ্যালবাম হলো- গোল্ডেন কালেকশন অব তালাত মাহমুদ, তালাত মাহমুদ ইন আ সেন্টিমেন্টাল মুড ও এভারগ্রিন হিটস অব তালাত মাহমুদ। ১৯৯২ সালে ভারত সরকার তাকে রাষ্ট্রীয় ‘পদ্মবিভূষণ’ খেতাবে ভূষিত করে।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫/টিপু/রণজিৎ

রাইজিংবিডি.কম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়