১৯৩০ বিশ্বকাপ : নানা বাধা পেরিয়ে শুরু ফুটবলের মহাযজ্ঞ
মুহাম্মদ মেহেদী হাসান || রাইজিংবিডি.কম
বিশ্বকাপ জয়ের পর উরুগুয়ের খেলোয়াড়দের উল্লাস। পাশেই প্রথম বিশ্বকাপের ট্রফি
অপেক্ষা আর মাত্র কয়েক দিনের অপেক্ষা! তার পরেই শুরু `গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ`। বিশ্বকাপ ফুটবল। এক মাস সারা পৃথিবীকে এক সুরে বেঁধে রাখবে সেই এক খেলা। সারা বিশ্ব জুড়ে কয়েক কোটি মানুষ টিভির পর্দাতেই রোনালদো, মেসি, নেইমারদের পায়ের জাদুতে মগ্ন হবেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে এসে গেল ফুটবল বিশ্বকাপের মৌসুম। দরজায় কড়া নাড়ছে বিশ্বকাপ ফুটবলের মাসকট ‘জাভিবাকা’।
প্রায় শতবর্ষের কাছাকাছি চলে যাওয়া এই টুর্নামেন্টের শুরুটা হয়েছিল কিভাবে? ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসই বা কি ছিল? বিশ্বকাপের আগের আসরগুলো কেমন ছিল? রাশিয়া বিশ্বকাপের আগে এ প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনে। তাঁদের জন্য রাইজিংবিডি’র বিশেষ আয়োজন ‘‘ফিরে দেখা বিশ্বকাপ’’। ধারাবাহিকভাবে প্রচার করা হবে বিশ্বকাপের আগের ২০টি আসর। আজ প্রকাশ করা হচ্ছে প্রথম পর্ব।
১৯৩০ বিশ্বকাপ :
ফুটবল তখন ততটা জনপ্রিয় ছিলো না। এমনকি খেলতোও অল্প কিছু দেশ। তারপরও অলিম্পিকের দ্বিতীয় আসরেই অন্তর্ভুক্ত করা হয় ফুটবলকে। তবে তখনও অংশগ্রহণ করেনি জাতীয় দলগুলো। ১৯০৮ সালে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে সর্বপ্রথম ফুটবল আনুষ্ঠানিকভাবে খেলার মর্যাদা পায়। বছর ২০ কাটতেই এর জনপ্রিয়তা রীতিমতো আকাশচুম্বী। বিশেষ করে ১৯২৪ ও ১৯২৮ সালে ফুটবলই ছিল অলিম্পিকের মূল আকর্ষণ। তাতেই নড়েচড়ে বসেন ফিফার কর্তারা। অলিম্পিকের আদলে একটি ভিন্ন টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে চায় সংস্থাটি।
কিন্তু ওইদিকে এটা মেনে নিতে রাজী নয় আইওসি। বেশকিছু মতপার্থক্যও দেখা দেয় ফিফার সঙ্গে। আর এর জেরে অলিম্পিকের স্পোর্টস ক্যাটাগরি থেকে বাদই দেওয়া হয় ফুটবলকে। মূলতঃ এর রেশ ধরে অলিম্পিকের পরবর্তী আসরের আগেই তৎকালীন ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমে তার নিজের নামে ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেন।
উরুগুয়ের বিশ্বকাপ দল। স্বপ্নের ট্রফিটা প্রথম জিতেছিল তারাই।
সফলভাবে ১৯৩০ সালে উরুগুয়েতে প্রথম বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতার আয়োজনও করেন। তাতে শুরু হয় এক নতুন দিগন্ত। তবে বাঁধাও ছিল বেশ। ইউরোপের দলগুলো খুব ভালো চোখে দেখেনি। তাইতো নানা বাঁধা পেরিয়ে ইউরোপের মাত্র চারটি দল অংশ নেয় সে বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপের ইতিহাসে ওই একবারই ইউরোপের দলগুলোর চেয়ে ল্যাটিন দলের উপস্থিতি ছিল বেশি।
সে বছরটি ছিল উরুগুয়ের স্বাধীনতার শততম বার্ষিকী। আর তা উদযাপনের অংশ হিসেবেই বিশ্বকাপ আয়োজন করতে চায় দেশটি। তাদের চাওয়াকে মেনে নেয় ল্যাটিন আমেরিকার সবগুলো দল। ইউরোপিয়ানদের কাছ থেকে কিছু বাঁধা আসে। মূলত আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিতে চায়নি অনেক দেশই। এ জন্য অবশ্য বিশ্বকাপে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর যাবতীয় খরচও বহন করতে সম্মত হয় উরুগুয়ে। ফলে শেষ পর্যন্ত ভোটাভুটিতে উরুগুয়েকেই নির্ধারণ করা হয় বিশ্বকাপের ইতিহাসের প্রথম সাক্ষী হিসেবে। রাজধানি মন্টেভিডিওতে মোট তিনটি ভেন্যুতে আয়োজিত হয় ওই বিশ্বকাপ।
বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দল। রানার্সআপ হয়েছিল লাতিন আমেরিকার দেশটি।
সেবার মোট ১৩টি দেশ অংশ নেয়। ইউরোপ থেকে অংশ নেওয়া দেশ ৪টি– বেলজিয়াম, ফ্রান্স, রোমানিয়া ও যুগোস্লাভিয়া। ল্যাটিন আমেরিকার ছিলো ৭টি দল – পেরু, প্যারাগুয়ে, চিলি, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, বলিভিয়া ও উরুগুয়ে। বাকি দুটি দল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো। ১৮ দিনব্যাপী বিশ্বকাপের আসরটি ১৩ জুলাই শুরু হয়ে শেষ হয় ৩০ জুলাই। ১৩টি দলকে চার ভাগে বিভক্ত করে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম আসর।
ফিফা সভাপতি জুলেরিমে নিজের দেশে বিশ্বকাপ আয়োজন করতে না পারলেও নিজের দেশকে দিয়েই বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ আয়োজন করেন। ফ্রান্স এবং মেক্সিকোর মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে শুরু হয় বিশ্বকাপ। আর সে ম্যাচে ৪-১ গোলের জয় পায় ফরাসীরা। আর বিশ্ব আসরের প্রথম ম্যাচের হারের ধাক্কা এখনও পোহাচ্ছে মেক্সিকো। কারণ বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ২৫টি ম্যাচে হার দেখেছে যে তারাই।
ফাইনালে বল বিপত্তি: প্রথম অর্ধ খেলা হয় আর্জেন্টিনার বলে (ডানে), দ্বিতীয় অর্ধ খেলা হয় উরুগুয়ের বলে (বায়ে) ।
প্রতি গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন দল সেমি-ফাইনাল খেলার সুযোগ পায়। তবে মজার ব্যাপার সেমি-ফাইনালের দুটি ম্যাচের ফল হয় একই। ফাইনালের টিকেট কাটতে উরুগুয়ে ৬-১ গোলে হারায় যুগোস্লাভিয়াকে। আর যুক্তরাষ্ট্রকে ৬-১ গোলে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে আর্জেন্টিনা। তবে মজাটা বেশি হয় ফাইনালেই। ফাইনালে দর্শক উপস্থিত ছিল ৬০ হাজারের বেশি। কিন্তু দর্শকদের হাবভাব দেখে সন্দেহ হয় রেফারির। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দর্শকদের তল্লাশি করতে বলেন তিনি। এতে ১৬০০ রিভলভার পাওয়া যায় তাদের কাছ থেকে।
শুধু তাই নয়। এরপর বল নিয়েও লাগে আরেক বিপত্তি। দুই দলই চায় নিজেদের বল নিয়ে খেলতে। শেষে সিদ্ধান্ত হয় প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনার এবং দ্বিতীয়ার্ধে উরুগুয়ের বল দিয়ে খেলা হবে। আর প্রথমার্ধে নিজেদের বল দিয়ে দুটি গোল দেয় আর্জেন্টিনা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে নিজেদের বল দিয়ে উরুগুয়ে দেয় ৪টি গোল। ফলে ৪-২ ব্যবধানে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় উরুগুয়ে।
প্রথম বিশ্বকাপে কোন তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ না থাকলেও গ্রুপ পর্বের ফলাফল বিবেচনা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তৃতীয় স্থান দেওয়া হয়। এ বিশ্বকাপে তিনটি হ্যাটট্রিকসহ মোট গোল হয় ৭০টি। বিশ্বকাপের ইতিহাসের প্রথম হ্যাটট্রিক করেন যুক্তরাষ্ট্রের পেটানভ। আর সর্বাধিক ৮টি গোল করেন আর্জেন্টিনার গুলেইর্মো স্ট্যাবিল।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ মে/মুহাম্মদ মেহেদী হাসান/ইয়াসিন/এনএ
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন