ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

উপকূলের পথে

প্রশ্ন একটাই- আমরা কোথায় যাবো?

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৬, ১১ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রশ্ন একটাই- আমরা কোথায় যাবো?

রফিকুল ইসলাম মন্টু: পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। বহু বছর ধরে নদীর তাড়া খেয়ে এখন তিনি বড্ড ক্লান্ত। নিজের জমি-ভিটে শেষ হয়েছে অনেক আগেই। অন্যের ভিটেয় ঘর তুলে আছেন বেশ কয়েক বছর। শেষ সম্বল গরু তিনটি রাখার জন্য যে বাড়িতে জায়গা পেয়েছিলেন, সে বাড়ির লোকজন অন্যত্র চলে গেছে দ্বীপ ছেড়ে। ভাঙন ধেয়ে আসায় সেখানে থাকা যাচ্ছে না। থাকার ঘর গোছানো, তার ওপর রোজগারের তাগিদ; এ যেন অন্যরকম জীবন। যেখানে নেই স্থিতিশীলতা; বসতি আর কাজের নিশ্চয়তা।

সত্তর বয়সের জীবনে কতবার বাড়ি বদল করেছেন, হিসাব মেলাতে পারেন না চাঁদপুরের হাইমচরের আবু সরদার। এর পরের ঠিকানা কোথায় জানেন না। একই অবস্থা প্রতিবেশী আবদুস সামাদ হাওলাদারের। আরেক প্রতিবেশী তারেক মোল্লা পরিজনসহ ঢাকা চলে গেছেন। ফয়জন্নেছা’র ঝুপড়ি ঘর সরিয়ে নিয়েছেন অনেক আগেই। দুশ্চিন্তার শেষ নেই কোড়ালিয়া আদর্শ গ্রামের শতবর্ষী কেরামত আলী শনি কিংবা শাহাবুদ্দিন গাজীর। চরভৈরবী থেকে ইঞ্জিনবোটে দ্বীপ হাইমচরের সাহেবগঞ্জ বাজার। ভর দুপুরে বর্ষার কর্দমাক্ত পথ ধরে হাঁটি। ঘন বর্ষায় কোথাও এমন কাদা জমেছে যে, হাঁটাই মুশকিল। এগোই কোড়ালিয়া গ্রামের দিকে। গ্রামটি ছিল আরও অনেক দূরে, মেঘনায় গিলে খেয়েছে। এখন গ্রামটি চলে এসেছে সাহেবগঞ্জ বাজারের অতি নিকটে। গ্রামবাসীর হাতে আঁকা মানচিত্র থেকে হাইমচরের ধারণা পাই। ইন্টারনেটের কল্যাণে গুগল ম্যাপে সব এলাকার মানচিত্র পাওয়া গেলেও প্রথমবার কোথাও দিয়ে আমি স্থানীয় বাসিন্দাদের দিয়ে মানচিত্র আঁকিয়ে নেই আমার নোটবুকে। হাইমচরে প্রথমবার গিয়ে সেটাই করি।



সাহেবগঞ্জ বাজার থেকে কোড়ালিয়ার দিকে যেতে পথেই কয়েক জনের দেখা মেলে। কুশল বিনিময়, নাম-পরিচয় বিনিময়ের পর এলাকার সমস্যা নিয়ে আলাপ। আমার নোটবুক আর বলপেন এগিয়ে দেই আহমেদ গাইনের সামনে। বয়স ৫৫ বছর। হাইমচরের পুরানো বাসিন্দা। সঙ্গে ছিলেন মালেক প্যাদা, বয়স ৬০ বছর। আরেকজন দীন ইসলাম সরদার, বয়স ৪০ বছর। তপ্ত রোদের মাঝে আহমেদ গাইন হাইমচরের মানচিত্র আঁকেন, তার মাথায় ছাতা ধরেন দীন ইসলাম সরদার। একটি আয়তকার ভূখণ্ড আঁকলেন আহমেদ গাইন। পূর্বে মেঘনা নদী, পশ্চিমে শরীয়তপুরের গোসাইরহাট, উত্তরে মুন্সিগঞ্জ আর দক্ষিণে মুলাদি। আয়তকার মানচিত্রটিকে তিনি আবার আঁড়াআঁড়ি তিনভাগে ভাগ করলেন। সর্বদক্ষিণের অংশের নাম লিখলেন ‘হাইমচর’। মাঝখানে ‘নীলকমল’ আর উত্তরে ‘গাজিপুরা’। মানচিত্রটাই বলে দিচ্ছে মেঘনার বুকে জেগে ওঠা এই চরে তিনটি ইউনিয়ন। এক সময় এগুলো ছিল চাঁদপুরের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে। কালের বিবর্তনে ইউনিয়নগুলো বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়েছে।

মানচিত্র আঁকার সময় আমি চোখ ফেরাই পূর্বে, মেঘনার তীরে। নদীতে জোয়ারের পানি বেড়ে ঢুকেছে ফসলি মাঠ ও বাড়ি-ঘরে। খানিক হেঁটে একটা নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে তারেক মোল্লার ভিটে। গত বছরের বর্ষার শেষ দিকে এই বাড়িতেই দেখা হয়েছিল সদা হাস্যোজ্জ্বল আবু সরদারের সঙ্গে। তারেক মোল্লার অনুমতি নিয়ে তিনটি গরু রাখার জন্য ভিটের এক কোনে একখণ্ড জায়গা নিয়েছেন। সেখানেই ঘর তুলছিলেন। কখনো খুঁটি গাড়ছিলেন, কখনো বেড়া বাঁধছিলেন। এরই ফাঁকে তার সম্পর্কে জানি। দুই যুগেরও বেশি সময় আগে যখন এখানে এসেছিলেন, তখন কোন অভাব ছিল না তার। ৬/৭জন লোক নিয়ে জালনৌকা নিয়ে নদীতে মাছ ধরতেন। বেশ ভালো চলছিল। কিন্তু দিনে দিনে অবস্থা বদলাতে থাকে। জালনৌকা নেই, বাড়ি নেই, ভিটে নেই। আবু সরদার এখন মজুর। কাজের ফাঁকে কথা বলতে থাকেন আবু সরদার। কথার মাঝে কখনো দীর্ঘশ্বাস পড়ে।আমি বুঝি, এগুলো তার কষ্টের কথা। দীর্ঘশ্বাস পড়লেও দীর্ঘদেহী এই সংগ্রামী মানুষটা যেন সবই লুকিয়ে রাখছেন নিজের ভেতরে। কথা বলছেন আর হাসছেন। দ্বিতীয় স্ত্রী হাছিনা বেগমের কোলজুড়ে আসা ৫ বছর বয়সী শেফালী বাবার আশপাশে ঘোরাঘুরি করছিল। প্রথম স্ত্রীর কথা উঠতেই আবু সরদারের আরেকটা দীর্ঘশ্বাস। বলেন, প্রথম স্ত্রী আমিরন নেছা কঠিন অসুখে পড়েছিলেন। ব্ল্যাড ক্যানসার হয়েছিল। বহু ডাক্তার-কবিরাজ দেখানো হয়েছে। কোন কাজ হয়নি। কয়েক বছর বিছানায় থাকার পর তার মৃত্যু ঘটে। চিকিৎসায় অনেক টাকা চলে গেছে, বহু ধারদেনা করতে হয়েছে। সেই ধকল কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি আবু সরদারের। এর ওপর প্রাকৃতিক বিপদে সব এলোমেলো।



কোড়ালিয়া গ্রামে তারেক মোল্লার বাড়ি থেকে খানিক দূরে মাঠ পেরিয়ে মেঘনা নদীর খুব কাছে আবু সরদারের বাড়ি। বর্ষায় দ্বীপের মানুষজন কাদাপানি পেরিয়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যায়। কিন্তু শুকনোয় এখানকার মানুষের অবস্থা কেমন? সেই চিত্র দেখতেই কয়েক মাস পরে আবারও হাইমচর। অন্যান্য বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে আবু সরদারকে খুঁজি। গরু রাখার জন্য যেমন ঘর বেঁধেছিলেন তারেক মোল্লার বাড়িতে, ঠিক তেমনি নিজেদের থাকার জন্য ঘর বেঁধেছেন মনির বেপারীর বাড়িতে। অন্যের বাড়িতে চেয়েচিন্তে এক টুকরো জমি নিয়ে ঘর তুলে বসবাসকে স্থানীয় ভাষায় ‘ওকরাইত’ বলে। আবু সরদার সেভাবেই আছেন। ভর দুপুরে তার ঘর খালি। আবু সরদার মাঠে গেছেন আর তার স্ত্রী দূরে ক্ষেত থেকে মরিচ সংগ্রহে গেছেন। সারাদিন মালিকের ক্ষেতে মরিচ তুললে একটা ভাগ পাবেন শেফালি। বাড়িতে লোকজন আসার খবর পেয়ে আবু সরদার দ্রুত পায়ে বাড়ি ফিরেন। পরিচিত লোক, আরও একবার এই চরে দেখেছেন, গলায় ক্যামেরা, হাতে নোটবুক- আবু সরদার মনে মনে হয়তো ভাবেন, লোকগুলো কারা? কী কাজে আসে? কাছে এসে এই প্রশ্নগুলো করলেন আমাকে। আমি কী জবাব দেই? একজন মানুষকে ফলোআপ করতে হলে, তার তো আমাকে বার বার যেতেই হবে, কথা বলতে হবে, তথ্য নিতে হবে, ছবি তুলতে হবে। আমার উদ্দেশ্য তাকে কীভাবে বুঝাই। কেবলই রোদ থেকে ঘরে ফেরায় শরীর ঘামে চকচক করছে আবু সরদারের। হাফহাতা সাদা গেঞ্জিটা পুরোটাই ঘামে ভিজে গেছে। আবার জীবনের আলাপ- ক’দিন থাকতে পারবেন এখানে? আবু সরদার বলেন, নদী তো কাছে চলে এসেছে। আর কতদিন থাকতে পারবো জানি না। যে বাড়িতে আছি, এবাড়িও তো ভেঙে যাবে। এরপরে কোথায় ঠাঁই মিলবে জানি না।

মাটির ভিটি ছাড়াই আবু সরদারের ছোট্ট ঘর। মাটি দিয়ে ভিটি করার সামর্থ্য নেই তার। জোয়ারের পানি থেকে বাঁচতে কিছু ভাঙা টুকরো কাঠের তক্তা একত্রিত করে পাটাতন দিয়েছেন। হাঁটাচলা করতে গিয়ে কোথাও তক্তা নিচে পড়ে যায়। ঘরের এক কোণে একটি চৌকি। আবু সরদার বলেন, সারাজীবন সংগ্রাম করে এখানে এসেছি। নিজের জমি হারানোর পর এভাবে অন্যের জমিতে থেকেছি। এখন তো পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। কথার ফাঁকে তিনি বারবারই প্রশ্ন করেন, কী জন্য এগুলো জানতে চাইছি, কী হবে জেনে? আমি আবু সরদারের মুখের দিকে তাকাই, জবাব দিতে পারি না। মাথা নিচু করে ঘরের দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে খেয়াঘাটের পথ ধরি। আর ভাবি, এত গল্প আমার নোটবুকে, মানুষের কান্না, ক্ষোভ, কষ্ট- লিখে কী করতে পারছি? আবু সরদারের পাশাপাশি খোঁজ নেই তারেক মোল্লার। মাত্র ৫ বছর আগে হাইমচরে এসে দু’বার ভাঙনের শিকার হয়েছেন তিনি। কয়েক মাস আগে কোড়ালিয়ায় দেখে আসা তারেক মোল্লার সাজানো গোছানো বাড়িটি এই ক’মাসের ব্যবধানে আর পেলাম না। তার স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন দুপুরের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। দুই ছেলে আরমান আর ইব্রাহিম খেলছিল ঘরের চৌকির ওপরে। ঘরের চালায় লাউয়ের ডগা তরতর করে বেড়ে উঠছিল। ফটো ফোল্ডার থেকে সেই পুরানো ছবিগুলো দেখি। সবই এখন অতীত। যে মানুষটি নিজের টানাটানির মধ্যেও ভিটের এক কোণে আরেকজনকে গরুর জন্য ঘর তৈরির সুযোগ দিয়েছিল, সেই মানুষটির নিজেকেই দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে হলো। আমার জানা নেই, তারেক মোল্লা, তার স্ত্রী এবং দুই সন্তান কেমন আছেন?



কোড়ালিয়া আদর্শপাড়া কলোনীর সত্তরোর্ধ্ব ফয়জননেছাকে খুঁজি; কয়েক মাস আগে যার সাথে আলাপ হয়েছিল। তিনিও সেই ঘরে নেই। প্রায় কুড়ি বছর আগে স্বামী আইয়ূব আলী মাঝি মারা যাওয়ার পর বলা যায় ভাসমান অবস্থায়ই জীবন কাটাচ্ছেন ফয়জন নেছা। ছোট ছেলে মনির হোসেন ঢাকায় কাজ করে কিছু টাকা পাঠায়; তা দিয়ে কোনমতে জীবনটাকে চালিয়ে নিচ্ছেন। এই জীবনে সাত বার বাড়ি বদল করেছেন। এই কয়েক মাসের ব্যবধানে আদর্শপাড়া কলোনীও ছাড়তে হলো তাকে। আদর্শপাড়ার আরেক বাসিন্দা কেরামত আলী শনি, যার বয়স ১০০ বছর হলেও কথা বলতে পারেন স্পষ্ট। হাইমচর দেখেছেন বহু আগে থেকে। বললেন, সেকালের কথা, একালের কথা, কষ্টের কথা, আক্ষেপের কথা। শেষ বয়সে এসে তারও প্রশ্ন একটাই- আমরা কোথায় যাবো?




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ জুলাই ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়