ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

কিংবদন্তির কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৪৮, ১৯ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কিংবদন্তির কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

রুহুল আমিন : আমি কিংবদন্তির কথা বলছি- কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ এই বিখ্যাত কবিতার জনক। আজ তিনি নিজেও কিংবদন্তী।বাংলা কবিতার এই কিংবদন্তী কবির ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।

আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি/তাঁর করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল/তাঁর পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিল/তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন/অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন/পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন/তিনি কবি এবং কবিতার কথা বলতেন। (আমি কিংবদন্তির কথা বলছি)

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী এক কবি। বণার্ঢ্য এক জীবনের অধিকারী ছিলেন ওবায়দুল্লাহ। সচিব, প্রশাসক এমনকি মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। কর্মজীবনে সুনামের সঙ্গে তিনি প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তারপরও তার কবি পরিচয় বাংলা সাহিত্যে উজ্জ্বলতম হয়ে আছে। তাই অন্যসব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত।

ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান এই কবি ১৯৩৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার বাহেরচর শুদ্রাখাদি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম আবু জাফর মুহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ খান। বাবা আব্দুল জব্বার খান ছিলেন বিচারক। হাইকোর্টের জজ হিসেবে তিনি অবসর নেন। পরবর্তীতে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন এবং পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার হন। মা সালেহা খাতুন ছিলেন গৃহিনী।

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ছিলেন শান্ত স্বভাবের। লেখাপড়াও ছিলেন গভীর আগ্রহী। বাবার কর্মস্থল ময়মনসিংহেই আবু জাফর ওবায়দুল্লার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে ১৯৪৮ সালে মাধ্যমিক পাস করেন আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। পরে ১৯৫০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিভাগ হতে এম.এ. পাস করেন। এমএ পাস করার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন।

১৯৫৭ সালে শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৮২ সালে তিনি সচিব হিসেবে অবসর নেন এবং মন্ত্রীসভায় যোগ দেন। কৃষি ও পানি সম্পদ মন্ত্রী হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন। পরে ১৯৮৪ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে যোগ দেন। আর ১৯৯২ সালে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থায় এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দেন। এই সংস্থা থেকে ১৯৯৭ সালে পরিচালক হিসেবে অবসর নেন। অবসর গ্রহণের পর ঢাকায় ফিরে একটি বেসরকারি সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে বেশ কয়েকদিন দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

কাব্যের আঙ্গিক গঠনে এবং শব্দ যোজনার বিশিষ্ট কৌশল তার স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করে। তিনি লোকজ ঐতিহ্যের ব্যবহার করে ছড়ার আঙ্গিকে কবিতা লিখেছেন। শব্দকে সুন্দর ও সাবলীলভাবে সাজিয়ে কবিতা লেখায় আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তৈরি করেছিলেন নিজস্ব ঢং। জীবনের বিভিন্ন সময়ে ছিলেন উচ্চ পদে আসীন। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। পদ মর্যাদা ও বিত্তের প্রতাপে বিশিষ্ট ও চঞ্চল হননি কখনো। এই সবে কখনো নিজেকে ভাসিয়ে দেননি তিনি। পদমর্যাদা আর সমাজের কোলাহল তাকে কখনো বিচলিতও করেনি। কবিতাই ছিল তার কাছে প্রিয়। তাই তো তিনি এতোসবের মধ্যে থেকেও যেন একমাত্র কবিতার জায়গায়ই ছিলেন সরব। আর সবখানে ছিলেন নির্লিপ্ত। তার কবিতায় মানুষ, প্রকৃতি পল্লী চিত্র, পাখি, ফুল, নদী, মাঠ, রাত্রি, চাঁদ, শৈশব, কৈশোর, বিষণ্নতা, প্রতিবাদ, এক অজানা দুঃখবোধ, শাশ্বত হাহাকার উঠে এসেছে।

রাজনৈতিক সচেতনতাও ছিল তার। ভাষা আন্দোলনের পটভূমির সরব উপস্থিতি ছিল তার কবিতায়। শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ছিলেন সরব। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রসমাজের আন্দোলন যখন চরম আকার ধারণ করে তখন আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। '৫২-র সেই মিছিল, পুলিশের গুলিবর্ষণ, শহীদ হওয়া ছাত্রদের লাশ তার মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। সেই ক্ষত থেকেই জন্ম নিয়েছিল তাঁর বিখ্যাত আবেগময় কবিতা ‘মাগো ওরা বলে' কবিতাটি।

'মাগো, ওরা বলে,/সবার কথা কেড়ে নেবে/তোমার কোলে শুয়ে/গল্প শুনতে দেবে না।/বলো, মা তাই কি হয়?/তাইতো আমার দেরি হচ্ছে/তোমার জন্যে কথার ঝুড়ি নিয়ে/তবেই না বাড়ি ফিরবো/লক্ষ্মী মা রাগ ক'রো না,/মাত্র তো আর কটা দিন!'।

আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো : সাতনরী হার (১৯৫৫), কখনো রং কখনো সুর (১৯৭০), কমলের চোখ (১৯৭৪), আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি (১৯৮১), সহিষ্ণু প্রতীক্ষা (১৯৮২), প্রেমের কবিতা (১৯৮২), বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা (১৯৮৩), আমার সময় (১৯৮৭), নির্বাচিত কবিতা (১৯৯১), আমার সকল কথা (১৯৯৩), মসৃণ কৃষ্ণ গোলাপ প্রভৃতি৷

কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তার সফল কর্মকাণ্ডের জন্যে জীবিত অবস্থায় ১৯৭৯ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৮৫ সালে একুশে পদক অর্জন করেন। বাংলা কবিতার এই কিংবদন্তী কবি ২০০১ সালের ১৯ মার্চ ৬৭ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।  তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ মার্চ ২০১৭/রুহুল/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়