ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শনির উপগ্রহে হাইড্রোজেন!

এফ এ শোভন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০২, ১৭ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শনির উপগ্রহে হাইড্রোজেন!

প্রতীকী ছবি

এফ এ শোভন : নাসা দাবি করেছে, এটাই সময় ভিনগ্রহীদের আস্তানা শণাক্তকরণ ও প্রয়োজনীয় বাঁচার উপকরণ সম্পর্কে জানার। নাসা সমসময়ই এমন একটা স্থানের সন্ধান করেছে যেখানে ভিনগ্রহীদের বসবাস উপযোগী সব উপকরণ বিদ্যমান। এবং সম্প্রতি শনির উপগ্রহ এনসেলাডাসে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন হাইড্রোজেনের উপস্থিতি, যা প্রমাণ করে সেখানে ভিনগ্রহী তথা প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে।

হাইড্রোজেনের উপস্থিতি অবশ্যই জীবনের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত। চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো আমাদের সৌরজগতের অনেক জায়গায় প্রাণের উপস্থিতি থাকতে পারে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে সরাসরি কিছু ঘোষণা করা কঠিন নির্দিষ্ট প্রমাণাদি ও বিশ্লেষণ ব্যতীত।

পানি
পানির একটি অনুতে একটি হাইড্রোজেন পরমানু এবং একটি অক্সিজেন পরমানু বিদ্যমান। হাইড্রোজেনের ফলেই বিগ ব্যং সৃষ্টি এবং বৃহদাকৃতির নক্ষত্রগুলোর মূলেই রয়েছে অক্সিজেন। আমাদের ছায়াপথের সর্বত্র প্রচুর পানি রয়েছে। হেলিক্স ও ওরিয়ন নীহারিকা এবং ২০ মিলিয়ন বছরের পুরোনো নক্ষত্র ‘বেটা পিকটোরামে’ পানি শণাক্ত করা গিয়েছে।

পৃথিবীতে পানির আগমন
পানির অস্তিত্ব বহনকারী গ্রহাণু এবং ধূমকেতু থেকে সৌরজগতে পানির আগমন ঘটেছে। সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ এই ইঙ্গিত দেয় যে, ধূমকেতু-তে বরফ এবং তরল জল বিদ্যমান। কোটি কোটি বছর ধরে অগনিত গ্রহাণু এবং ধূমকেতু সংঘর্ষ ঘটেছে পৃথিবীর সঙ্গে। যার ফলশ্রুতিতে পৃথিবীতে পানির সূত্রপাত ঘটেছে।

জীবনের জন্য পানি কেন অপরিহার্য?
কোষঝিল্লি নামক কোষীয় অঙ্গানু পৃথিবীর সকল জীবকে বৈশিষ্ট্যে ভিন্ন করেছে পরিবেশ থেকে। বেঁচে থাকতে জীবের শক্তির একান্ত প্রয়োজন এবং যার জন্য জীব নানা ধরনের উপকরণ গ্রহণ করে এবং বিষাক্ত বর্জ্য ত্যাগ করে। পানিতে প্রায় অধিকাংশ পদার্থ দ্রবীভূত হয় বলে দেহের প্রতিটা কোষে পানির সংস্পর্শে খাদ্য স্থানান্তর হয়। একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা পর্যন্ত পানি তরল আকারে অবস্থান করে। এবং এর থেকেই পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার।

অন্য অনেক মৌলিক বা যৌগিক অনু রয়েছে যেগুলো তাপ ও চাপে তরলাকার ধারণ করে জীবের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম। কিন্তু তা পানির মতো পুরোপুরি নয়।

হাইড্রোজেন কেন গুরুত্বপূর্ণ?
হাইড্রোজেন মানেই জীবনের উপস্থিতি। যা কার্বনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শক্তি উৎপন্ন করে। এছাড়া হাইড্রোজেন সহজেই অধিকাংশ মৌলের বা যৌগের সঙ্গে দ্রবীভূত হতে সক্ষম। এই রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে বলা হয় মিথেনোজেনেসিস। এটা পৃথিবীতে জীব সৃষ্টির মূল ভিত্তি। এবং আমাদের গ্রহের প্রাণের অস্তিত্ব এই মিথেনোজেনেসিস থেকেই।

সৌরজগতের অন্য কোথায় মহাসাগর রয়েছে?
পৃথিবী একমাত্র গ্রহ নয় যেখানে মহাসাগর তথা পানির অস্তিত্ব রয়েছে। সৌরজগতের অন্যান্য স্থান যেমন উপগ্রহ, বামন গ্রহ বা ধূমকেতুতেও পানি বিভিন্ন অবস্থায় বিদ্যমান।

বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপা
বিজ্ঞানীরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপার ভূগর্ভে বরফের নিচে নোনা পানির মহাসাগর রয়েছে। বৃহস্পতির হিমায়নের ফলে এখানে পানি তরল ও বরফ উভয় অবস্থায় বিরাজ করে। এখানে বরফের খাজে কিছু ছোট ছোট গলিত গহবর বা লেকের সৃষ্টি হয়। হাবল স্পেস টেলিস্কোপে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ইউরোপার বহিরাবরণে ও পৃষ্ঠতলে সম্ভাব্য পানির উদগীরণ লক্ষ্য করা গেছে।

বৃহস্পতির উপগ্রহ গ্যানিমেড
সৌরজগতের সবচেয়ে বড় উপগ্রহ গ্যনিমেড। এবং এটাই একমাত্র উপগ্রহ যার নিজস্ব চৌম্বকক্ষেত্র রয়েছে। গ্যানিমেড পৃষ্ঠ থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত কিছু বরফ ও পানির স্তর রয়েছে বলেও ধারণা করা হয়।

বৃহস্পতির উপগ্রহ ক্যালিস্টো
ক্যালিস্টোর পৃষ্ঠ গর্তময় এবং কিছু কিছু বরফাবৃত অঞ্চলও দেখা যায়। বরফের আস্তরণ প্রায় ২৪ মাইল পুরু। এছাড়া এর তলদেশে ৬ মাইল গভীর মহাসাগর রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

শনির উপগ্রহ এনসেলাডাস
বিজ্ঞানীদের ধারণা মতে, শনির উপগ্রহ এনসেলাডাস এর জলধারা প্রায় ৬ মাইল গভীর হবে। এর দক্ষিণ মেরুর দিকে বরফের আবরণ প্রায় ২০ থেকে ২৫ মাইল গভীর। পৃষ্ঠের বড় বড় ফাটল থেকে জলরাশি স্পষ্ট দেখা যায়। ২০১৫ সালে স্পেসশিপ ‘ক্যাসিনি' উড়ে যাবার পথে সেখানে হাইড্রোজোনের উপস্থিতি পায় এবং প্রাথমিকভাবে যেটা জীবন ধারনের জন্য যথেষ্ট।



শনির উপগ্রহ টাইটান

টাইটানের ভূগর্ভে লবণাক্ত মহাসাগর আছে বলে অনেকের বিশ্বাস। যেটা পৃথিবীর মৃতসাগরের ন্যয়। নিচের দিকে প্রায় ৩০ মাইল পরে বরফের আস্তরণ রয়েছে। আবার এটাও ধারণা করা হয় টাইটানের মহাসাগর যথেষ্ট গভীর নয় এবং এর তলদেশে বরফ ও বালির স্তর রয়েছে অনেকগুলো। স্তরগুলো অনেকটা পুরু এবং তলদেশ পাথুরে প্রকৃতির।

শনির উপগ্রহ মিমাস
অনুসন্ধান মতে, মিমাসের কেন্দ্রে ফুটবল আকৃতির বিশাল জলরাশি রয়েছে। মিমাসের এরকম লুকায়িত সাগর যদি আদৌ থেকে থাকে তাহলে তার আনুমানিক গভীরতা ১৪ থেকে ২০ মাইল পর্যন্ত হবে।

নেপচুনের উপগ্রহ ট্রাইটন
নেপচুনের ট্রাইটনে কিছু উষ্ণ এলাকা বিদ্যমান যেখান থেকে ক্রমাগত নাইট্রোজেন গ্যসের উদগীরণ হয়। এর ফলে একে সৌরজগতের সর্বাপেক্ষা সক্রিয় উপগ্রহ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বৈশিষ্ট্য ও গঠনে আগ্নেয়গিরির মতো সক্রিয়তা থাকলেও এর ওপরিভাগ হিম শীতল এবং পৃষ্ঠতল বরফের মহাসাগরে আবৃত বলে ধারণা। কিন্তু তা সর্বজন স্বীকৃত নয়।

বামন গ্রহ প্লুটো
পর্বত সমান বরফ এবং নাইট্রোজেন ও মিথেনের হিমবাহ আশ্চর্যজনকভাবেই প্লুটোকে পৃথিবীতে পরিণত করেছে। ১০০ মাইলের বেশি দীর্ঘ রহস্যময় চ্যুতি রেখাগুলো প্রমাণ করে যে প্লুটোয় লুকায়িত মহাসাগর বিদ্যমান।

অন্যান্য নক্ষত্রগুলোর গ্রহ, উপগ্রহে মহাসাগর বা জলরাশির অস্তিত্ব আছে কিনা?

এইচএটি-পি-১১বি
নেপচুন আকৃতির এই গ্রহটির ওপরিভাগে জলীয়বাষ্পের সন্ধান পাওয়া গেছে। ধারণা মতে, এতে তরল পানি থাকার আশংকা অনেক বেশি। এটা প্রায় ১২০ আলোকবর্ষ দূরে এবং ৬ দিনান্তে এর সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত ঘটে। এর বাতাসে প্রচুর জলীয়বাষ্প বিদ্যমান এবং এটার আকাশ মেঘমুক্ত।

কেপলার ২২বি
কেপলার ২২বি হলো একমাত্র গ্রহ যার নির্দিষ্ট কক্ষপথ এবং বাসযোগ্য এলাকা রয়েছে বলে ধারণা। এর ওপরিভাগে তরল পানি থাকার সম্ভাবনা যথেষ্ট। পৃথিবীর তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বড় এ গ্রহটি আসলে পাথুরে নাকি গ্যসীয় গঠনে সৃষ্টি সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা সন্দিহান। এটা জানা সম্ভব হতো যদি এর আকাশে মেঘ থাকতো।

কেপলার ২৫২বি
কেপলার ২৫২বি গ্রহটি পৃথিবীর আকৃতির বাসযোগ্য গ্রহ বলে বিবেচিত এবং যার নক্ষত্রও প্রায় সূর্যের ন্যয়। এর নক্ষত্র সূর্য অপেক্ষা দশভাগ বৃহৎ এবং বিশভাগ বেশি উজ্জ্বল। এটা তার নিজস্ব নক্ষত্রকে প্রায় ৩৮৫ দিনের ব্যবধানে একবার প্রদক্ষিণ করে। এর বয়স প্রায় ৬ বিলিয়ন বছর এবং যেটা সৌরজগত অপেক্ষা বেশি পুরোনো।

কেপলার ৬২
এই গ্রহটির কক্ষপথে প্রায় ৬টি গ্রহ একইসঙ্গে আবর্তিত হচ্ছে। এর নক্ষত্র সূর্যের চেয়ে কম উজ্জ্বল এবং বয়স ৭ বিলিয়ন বছর। কেপলার ৬২ গ্রুপের দুইটি সদস্য হলো কেপলার ৬২ই এবং কেপলার ৬২এফ। কেপলার ৬২এফ ২৬৭ দিনে একবার এর নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করে। এটা পৃথিবী অপেক্ষা প্রায় ৪০ ভাগ বৃহৎ।

শনির এনসেলাডাস উপগ্রহে কি প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে?
আমরা জানি প্রাণের অস্তিত্ব রক্ষায় তিনটি জিনিস গুরুত্বপূর্ণ আর সেগুলো হলো- তরল পানি, বিপাক ক্রিয়ার জন্য শক্তি এবং এবং রাসায়নিক উপাদানসমূহ যেমন হাইড্রোজেন, কার্বন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং সালফার।

এটা বলা হয়ে থাকে যে, বসবাসের জন্য এনসেলাডাসে সকল উপাদান রয়েছে। তবে এটা এখনো নিশ্চিত না যে ফসফরাস এবং সালফার আছে কি না! তবে এনসেলাডাস এর কেন্দ্র পাথুরে এবং সেখানে উক্ত মৌলদ্বয় থাকার সম্ভাবনাও যথেষ্ট।

যা হোক, জীবন ধারণ সক্ষম কোনো স্থানে যে প্রাণের অস্তিত্ব থাকবে এটা শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কিছু ধারণা করাও ভুল। এ বিষয়টা মাথায় রেখে নাসা একটি ফলো অন মিশনে নেমেছে, যেটা ২০২০ সাল নাগাদ শেষ হওয়ার কথা। যেটা বিশেষত এনসেলাডাস এর ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করবে। এটা উপগ্রহে পানির অস্তিত্ব এবং প্রাণের সঞ্চার করে এমন অনু পরমানুর বিশ্লেষন সহ বর্হিজগতে প্রাণের অস্তিত্বের সন্ধান করবে।

পানি ব্যতীত ভিনগ্রহীদের জীবন ধারণ কি সম্ভব?
হ্যাঁ, অবশ্যই সম্ভব। এবং এর নজির স্বয়ং পৃথিবীতেই দেখা যায়। কারণ পানি ব্যতীত দুটি যৌগ রয়েছে যেগুলো পানির ন্যয় আচরণ করে এবং তরল এই যৌগগুলোয় প্রাণের সম্ভাবনা শতভাগ। এগুলো হলো অ্যামোনিয়া এবং মিথেন। পৃথিবীতে প্রাণেরও আগমনও এই দুটি যৌগ থেকেই। ধারণা করা হয় ভিনগ্রহীরা পানির বিকল্প হিসেবে এ সকল তরলের সন্নিধ্যে জীবন ধারণে সক্ষম।

তথ্যসূত্র : মিরর



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ এপ্রিল ২০১৭/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়