ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

তখন মনে হয়েছে, হ্যাঁ আমি লেখক হয়েছি: শওকত আলী

অজয় কুমার রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:২০, ২৫ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তখন মনে হয়েছে, হ্যাঁ আমি লেখক হয়েছি: শওকত আলী

শওকত আলী

বাংলাদেশের ষাটের দশকের গল্প-উপন্যাসে গ্রাম ও শহরকেন্দ্রিক নাগরিক জীবনের যে আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন এবং সংগ্রামশীলতা কিংবা সামষ্টিক জীবনে সামাজিক-রাজনৈতিক যে প্রভাব, কথাসাহিত্যে প্রকাশের ক্ষেত্রে শওকত আলীর দক্ষতা অসামান্য। একই সময় তিনি কথাসাহিত্যে স্বাতন্ত্র্য ভাষা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। আজ না ফেরার দেশে তিনি চলে গেলেন। শক্তিশালী এই কথাসাহিত্যিককে প্রণতি জানিয়ে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অজয় কুমার রায়।

অজয় কুমার রায়: আপনারা ৫২ সালে এই বঙ্গে এসেছিলেন। সাতচল্লিশের দেশভাগের কালে না-আসার কারণ কী ছিল?
শওকত আলী: আমার বাবা মুসলিম লীগ রাজনীতির বিরোধী রাজনীতি করতেন। তিনি মনে করতেন এ দেশটা হিন্দু-মুসলমানের নয়; আমরা সবাই ভারতীয় অর্থাৎ আমার বাবা দেশভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে দেশ যখন ভাগ হয়ে গেল তখন হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নটা বড় করে দেখা দিল। তারপরও আমরা থাকলাম। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা যখন প্রকট আকার ধারণ করে,  তখন আমরা প্রায় একঘরে হয়ে গেলাম- তখনই পূর্ববাংলায় চলে এলাম।

অজয় কুমার রায়: দেশভাগের সময় কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা কি আপনার হৃদয়ে দোলা দিয়েছে?
শওকত আলী: আমি দেখেছি মুসলমানদের ঐক্য। তাদের ঐক্যের বিরুদ্ধে কিছুই তখন হতো না। কিন্তু আমার বাবা কংগ্রেসের রাজনীতি করতেন; ফলে নানান প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয়েছে আমাদের। যেমন সামাজিকভাবে দুই পক্ষ থেকে খুবই হেয়জ্ঞান করতো : এক. মুসলিম লীগের সমর্থকরা আমাদের অন্যভাবে দেখতো; দুই. ওখানকার হিন্দুরা মুসলমান বলে নানান সমস্যা করতো। আমার বাবা হোমিওপ্যাথি ডাক্তার ছিলেন, ফলে হিন্দুরা মুসলমান বলে আসতো না। আর মুসলিমরা কংগ্রেস বলে আসতো না। সেজন্যে দিনদিন বাবার রোগী একেবারে কমে গেল। আমরা খুব অর্থ কষ্টে পড়ে যাই। দেশভাগের ফলে আমরা এরকম সমস্যার সম্মুখীন হলাম। এসব ঘটনা এখনো আমার মনে পড়ে।

অজয় কুমার রায়: এদেশে  আসার পর অর্থাৎ পূর্ববাংলায় আসার পর মুসলিম লীগ ও অন্যান্যরা আপনাদের কীভাবে দেখতেন?
শওকত আলী: যেহেতু আমার বাবা কংগ্রেসের রাজনীতি করতেন, সেহেতু আমাদের তারা ভালভাবে দেখতেন না। এমন কি সামাজিকভাবেও  আমরা বঞ্চিত হতাম।

অজয় কুমার রায়: সেসময় অর্থাৎ ১৯৫২ সালে এদেশে ভাষা আন্দোলন তুঙ্গে। ভাষা আন্দোলনের কোনো প্রভাব আপনার মধ্যে পড়েছিল কি?
শওকত আলী: হ্যাঁ পড়েছিল। বাবা যেহেতু মুসলিম লীগবিরোধী ছিলেন সেহেতু ভাষা আন্দোলনের প্রতি আমাদের পুরোপুরি সমর্থন ছিল। তখন আমি দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজের ছাত্র। মিটিং মিছিলে যেতাম।

অজয় কুমার রায়: আপনার প্রাথমিক শিক্ষা কোন স্কুলে হয়েছিল?
শওকত আলী: রায়গঞ্জের একটা পাঠশালায়। যেটা আমার পৈতৃক ভিটা ছিল। এরপর আমরা সপরিবারে চলে যাই হুগলি জেলার শ্রীরামপুরে। সেখানে একটি খ্রিষ্টানদের মিশনারি স্কুলে ভর্তি হই। সেখানে আমরা তিন বৎসর ছিলাম। মা সেই মিশনারি স্কুলে শিক্ষকতার একটা চাকরি পেয়েছিলেন এবং বাবা একটা হোমিওপ্যাথি ডাক্তারখানা খুলেছিলেন।

অজয় কুমার রায় : লেখালেখিতে আসার পেছনে পারিবারিক কোনো অবদান আছে কি?
শওকত আলী: আমাদের পরিবারটা আসলে শিক্ষিত ছিল। তখনকার দিনে যাকে আভিজাত পরিবার বলা হতো। আমার বাবা-মা দুজনেই শিক্ষিত ও  রাজনীতি সচেতন ছিলেন। আমার দাদার জমিদারী থাকলে তখন জমিদারী প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। অল্পকিছু জমি ছিল। আমার ভাই-বোনেরা সবাই পড়াশোনা করতো।

অজয় কুমার রায়: লেখালেখির প্রতি আপনার আগ্রহ জন্মালো কীভাবে?
শওকত আলী:  বিশেষ করে বাবার আগ্রহে আমার লেখালেখি শুরু হয়। আমার বাবা লেখালেখি করতেন।

অজয় কুমার রায়: আপনার লেখালেখি জীবনের শুরুটা কেমন ছিল ?
শওকত আলী:  সে সময় তো সহজে মুসলমানদের লেখা ছাপা হত না। যেহেতু বাবা মুসলিম লীগবিরোধী রাজনীতি করতেন সেহেতু মুসলিম পত্রিকাওয়ালারা আমার লেখা পছন্দ করত না। হিন্দু পত্রিকাওয়ালারা তো মুসলমান বলে ছাপাতই না। এই জন্য শুরুটা খুব কঠিন ছিল। আমার বাবা লেখালেখি ও সাংবাদিকতা করতেন, সেখানে বাবার নাম খোরশেদ আলী সরকার সংক্ষিপ্ত করে ‘কে সরকার’ নামে ছাপা হতো।

অজয় কুমার রায়: আপনার বাবার কি কোন  বই বের হয়েছিল?
শওকত আলী: একটা বই বের হয়েছিল তাঁর বন্ধুদের সহযোগিতায়। রায়গঞ্জ থেকেই। গল্পের আকারে উনার জীবনে দেখার অভিজ্ঞতাগুলো সে বইয়ে তুলে ধরেছেন তিনি।

অজয় কুমার রায়: আপনি কি গল্প-উপন্যাস দিয়ে  লেখালেখি শুরু  করেছেন? সাহিত্যের অন্য শাখায় কি লিখেছেন?
শওকত আলী: গল্পই দিয়ে শুরু করেছিলাম। কবিতা ও শিশুদের জন্যেও লিখেছি। কবিতার বই নেই। তবে শিশুসাহিত্যের দুটি-তিনটে বই প্রকাশিত হয়েছিল। এখন নাম ভুলেই গেছি। ঢাকা থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল। অনেক আগেই নতুন একটা প্রকাশনী বের করেছিল। নামটাও মনে করতে পারি না এখন।

অজয় কুমার রায়: দিনাজপুরে আসার পর কি লেখালেখি করেছেন?
শওকত আলী: করেছি। দু-একটি দিনাজপুরের পত্রপত্রিকায়  লেখা ছাপা হলো। তখনও আমার চিন্তাধারা কলকাতাকেন্দ্রীক ছিল।

অজয় কুমার রায়: আপনার ‘দিনগুজরান’ বইয়ের গল্পগুলোর পটভূমি পাকিস্তানি ক্যাম্পের বিহারীদের জীবন কাহিনি। এতে কোন অনুভূতি আপনাকে বেশি নাড়া দিয়েছে?
শওকত আলী: আমি সে সময় দেখেছি মুসলমানদের দুর্দশা। পাকিস্তানে যারা বাস করছিল তারা ধারণা করতে পারছিল না। স্বাধীনতার আগে বিহারী ও পাকিস্তানপন্থিদের দ্বারা সাধারণ মুসলমান, আর স্বাধীনতার পর স্বাধীনতাকামী মুসলমান দ্বারা বিহারী মুসলমান নির্যাতিত হচ্ছে।

অজয় কুমার রায়: মুক্তিযু্দ্ধের সময় আপনারা কীভাবে ছিলেন? আপনাদের সমর্থন কোন পক্ষে ছিল?
শওকত আলী: আমরা তো বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলাম। দিনাজপুরেই ছিলাম। আমার মায়ের জন্যেই সেখানে থাকতে পেরেছিলাম। আমাদের তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি। তবে আমার বাবা সেখানে থাকতে পারছিলেন না। চলে যান ভারতের মালদহে। সেখানে তার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব ছিল। বেশ কিছুদিন সেখানে ছিলেন।

অজয় কুমার রায়: ‘প্রদোষে  প্রাকৃতজন’ প্রকাশিত হওয়ার পরই তো সর্বত্র আপনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে?
শওকত আলী: তা হয়েছে। বইটার আলোচনা দেখতাম বিভিন্ন জায়গায়। এই বইটা যে বিদেশেও চলে গিয়েছিল, এটা আমি জানতাম না। লন্ডনের একটা বিখ্যাত পত্রিকায়ও একজন বিখ্যাত মানুষ আলোচনা লিখেছিলেন। এখন নামটা  ভুলে গেছি। তখন আমার মনে হয়েছে হ্যাঁ আমি লেখক হয়েছি।

অজয় কুমার রায়: একজন লেখকের জন্যে কি এটা খুব প্রয়োজন?
শওকত আলী: হ্যাঁ প্রয়োজন। যে জেনুইন লেখক সে চাইবে তার লেখাটা যেন আরেকজন জেনুইন লেখক আলোচনা করে। আমার এ লেখাটি নিয়ে ঢাকা থেকে কমেন্ট শুরু হলো। অধ্যাপকদের কেউ কেউ আলোচনা করলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্যে প্রথম মূল্যায়ন করেছিলেন অধ্যাপক অজিত গুহ। তিনি আমাকে বিভিন্নভাবে উৎসাহ দিতেন। কিন্তু সেসময় তিনি সে রকম কোনো সুনাম অর্জন করেননি, এমন কি তার কোনো প্রভাবও ছিল না। এর মধ্যে থেকে আবার দু-একজন মুসলিম লেখক তাদের মধ্যে আনিসুজ্জামান বইটা পড়েছেন, ইংরেজিতে একটা আলোচনা লিখলেন এবং অন্যদের পড়তে আগ্রহ জুগিয়েছেন।

অজয় কুমার রায়: ‘দক্ষিণায়নের দিন’ উপন্যাসটি অসাধারণ। তবে এই বইয়ে তিনটি উপন্যাস একত্রিত এবং চরিত্রগুলো অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেমন তৎকালীন ঢাকার মধ্যবিত্তের সামাজিক জীবনের চিত্রটাই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তখন কি আপনি ঢাকায় ছিলেন?
শওকত আলী: ঐ সময় আমি ঢাকায় এমএ পড়ি। তখন ঢাকায় যে শিক্ষিত পরিবারগুলো ছিলো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে। যেহেতু আমরা ভারত  থেকে এসেছি, আমাদের বলা হতো হিন্দুদের সঙ্গে এদের সর্ম্পক। তখন কিছু শিক্ষিত লোক ও লেখক যারা আমার বাবাকে আগে থেকেই চিনতেন তারা আমার লেখা পড়েছিলেন। তারা বাবাকে বলেছিলেন, ওকে লিখতে বলো। লেখাগুলো পত্রিকায়  যেন ছাপায়। প্রথমত ‘ইত্তেফাক’ আমার লেখা ছাপাতো না।  বেশ পরে ছাপা হলো। এছাড়া  তখন ‘মিল্লাত’ ও ‘সংবাদ’এ আমার লেখা ছাপা হলো।

অজয় কুমার রায়: মানুষ কেন বই পড়বে সে ব্যপারে কিছু যদি বলেন?
শওকত আলী: প্রথমত কথা হচ্ছে, লেখালেখির ব্যপারটা; লেখালেখি বলতে অন্তরের কোনো তাগিদ, কোনো অনুভব তাকে লেখার ব্যাপারে আকৃষ্ট করে। তখন হিন্দুরাই লেখালেখি করত। পরে মুসলমানরা লেখালেখি শুরু করেছে।

অজয় কুমার রায়: সাহিত্য ও রাজনীতির মধ্যে কতটা সর্ম্পক বলে মনে করেন?
শওকত আলী:  মুসলমানদের পাকিস্তান আন্দোলন হয়ে গেছে বা হবে এরকম একটা অবস্থা হয়েছে, সেখানে মুসলিম নামের প্রচারটাই প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামী সাহিত্য গল্প, উপন্যাসের মধ্যেও প্রধান হয়েছে। এই অবস্থাটার একটা ভালো দিক আছে। তার কারণ মুসলমানদের মধ্যে যে পড়াশোনার অভাব ছিল এই অভাবটা অনেকটা দূর হয়ে গেল। এর আগে হিন্দুরাই লেখালেখি করত, পড়াশোনা করত। তারপর মুসলমানরা যখন লেখা শুরু করলো তখন তাদের লেখাও পড়তে হলো। শুরু হলো হিন্দু-মুসলমান দুটোই পড়া। কাজী নজরুল ইসলাম জনপ্রিয় হয়ে গেলেন। মুসলমান হিসেবে তাকে নেওয়া হলো। হিন্দুরা দেখল, আরে মুসলমানদের সর্ম্পকে বেশি পড়ি না, পাঠক তো এদেরই বেশি। সে সময় নজরুলের পাঠক ছিল অসংখ্য। তাদের মধ্যে প্রগতিশীল চিন্তাধারার যারা ছিল তারা মুসলিম বিরোধিতা কমিয়ে দিল। কলকাতা তো পুরোটাই তাই ছিল। তার মধ্যে থেকে নতুন মুসলমান লেখক আবিষ্কৃত হতে থাকল এবং বেশি সংখ্যক অল্প বয়সী ছিল। নজরুলের বয়স তখন ত্রিশ-বত্রিশ ছিল। তার মধ্যে থেকে যারা নাম করে ফেলেছে তাদের বয়স চল্লিশের বেশি হবে না। তারা প্রতিষ্ঠিতও হয়ে গেল। তবে  এই ব্যাপারে মুসলমান তরুণদের মধ্যে অর্থাৎ মুসলমানদের জাগরণের যে ব্যাপারটা তাতে কিন্তু বাংলা সাহিত্যের একটা ভূমিকা আছে। প্রথমত বাঙালি মুসলমানরা সাহিত্য পড়ত না, সাহিত্য পড়ার দিকে ঝুঁকল, তারপর নজরুলের আরো অনুসারী হয়ে উঠতে শুরু করল। তখন বাংলা সাহিত্যের মধ্যে দুটো ভাগ হয়ে গেল। একদিকে মুসলমান লেখক, অন্যদিকে হিন্দু লেখক। এ রকম অবস্থা ছিল। একসময় বৃটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু হলো। নজরুল তখন বৃটিশবিরোধী লেখা লিখতে শুরু করলেন। তখন বিষয়টা আলোড়ন তুলল। তখন সবার মনে হলো- দেশ মানে দেশের জনগণ। সে হিন্দু, না মুসলমান সেটা বড় না। দেশ মানে দেশের ঐতিহ্য, দেশের সংস্কৃতি। সেটা হিন্দু না মুসলমানের সেটা বড় কথা না।

অজয় কুমার রায়: তরুণ লেখকদের উদ্দেশে কিছু বলুন?
শওকত আলী: পাঠকদের উদ্দেশে একটা কথা হচ্ছে, আমরা মানুষ এবং মানুষের জীবনের কথা, মানুষের কল্পনার কথা, মানুষের আশার কথা, মানুষের ভবিষ্যতের কথা- এই বিষয়গুলোর ছাপ যে লেখার মধ্যে আছে, অনুপ্রেরণা আছে এটা পড়তে হবে। তাহলে সাহিত্যচর্চা হবে। প্রকৃত সাহিত্য ওখান থেকে তৈরি হয়।

 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ জানুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়